আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: কালিদহের কূহক



আন্ধার কুন্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে আমাদের বহুল ব্যবহৃত ব্যালকনিতে, খানিক পরে জট ছাড়িয়ে লেপে দেবে সামনের ফ্ল্যাটের মিতুদের জানালা; সেই অপেক্ষায় বসে আছি। নিসংগ কাপে একটা মরা মাছি ঘূর্ননের সুত্র শিখছে, চা'য়ের বিগত উষ্ণতা আর ক্যাটকেটে মিস্টি আমার জিভের তলায় কবে শুকিয়ে গেছে! এইযে আমি অন্ধকারকে একটু কাট-ছাট করে আঁধার না বলে বল্লাম আন্ধার, তার পেছেনে আমার পিতামহের শীর্ন, চিড়বিড়িয়ে ওঠা রগের কালো হাতটার ভূমিকা আছে। বছরে-দুবছরে তিনি একবার এই রদ্দি শহরে উত্তরের খরখরে বালু, ফসল অথবা ফসলহীনতার ঘ্রান ইত্যাদি নিয়ে হাজির হতেন এবং আমাদের বহুল ব্যবহৃত ব্যালকনিতে আমার প্রিয় চেয়ারটি দখল করে মিতুদের জানালার দিকে পা তুলে দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটিয়ে দিতেন। তিনি শীর্ন রগ ওঠা হাতটা নেড়ে গ্রামের আকালের কথা বলতেন। নদীর ভাংগন, বান ইত্যাদির ভেতর তার শীর্ন হাতটা সেঁধিয়ে খুব জোরে নাড়তেন যেন তার ছেলের চোখে আকালের ব্যাপকতা ঠিকঠাক গড়ে উঠতে পারে, আবার খানিক পরে সেই হাতটা বাউরি বাতাস সমৃদ্ধ ক্ষরার অংকনে জোরে ওঠানামা করলে আমি দেখতে পেতাম শীর্ন হাতটাতে রগগুলো চিড়বিড়িয়ে ফুলে উঠছে।

তো আমার পিতামহের অংকিত এইসব চিত্র আমার বাবার চশমার ফাঁক গলে খবরের কাগজে ঝরে পড়ে দেশের গুরুত্তপুর্ন খবরের মাঝে থই না পেলে, তিনি দু'চিমটি গুল তার ফ্যাকাসে জিভ ও গালের ভাঁজে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের বহুল ব্যবহৃত ব্যালকনিতে মিতুদের জানালার দিকে পা দুটি তুলে বলতেন; "এইখান থাইকে তাও ইকটু আকাশ-বাতাস দেখা যায়!" ব্যালকনির কাঁধে পা দুটো তুলে দিলে তার ডোরাকাটা তহোবনের ফাঁক দিয়ে প্রাচীন অন্ডকোষ ঝুলে পড়ে দৃশ্যমান হলে আমি যুগপৎ বিরক্ত এবং অস্বস্তি বোধ করতাম এবং আমার হঠাৎ মনে পড়ে যেত সেই বালকবেলায় তার বাড়ির পেছনে মানকচুর ঝাড়ের শেঁকড়ের কাছাকাছি পুরোন ছায়-গোবর মেশানো মাটিতে পাকা তালের শাঁসপুর্ন বিচির কাঠিন্য পুঁতে দিতাম আর আমার কালো কালো চাচাতো ভাইয়েরা বলত; "কদিন বাদে এ্যার ভিতরে লরম লরম শাস আইসবে!" পিতামহের প্রাচীন অন্ডকোষের সাথে তালের বিচির কাঠিন্যের বিষয়টি আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে যায়, যখন তিনি বলে ওঠেন; "হায়রে কালিদহ!" আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কালিদহের নাম এতোবার শুনেছি যে, চোখ বুঁজেও বলে দেয়া যেতে পারে, অনেক অনেক কাল আগে গর্ভিনী পদ্মার ফুলে ওঠা পেটের চাপে দক্ষিন নারায়নপুরের পায়ের কাছে একটা গভির দহের সৃস্টি হয়েছিল, যার মিশমিশে কালো পানিতে নারায়নপুরের লোকেরা নামতে সাহস পেত না। আমার পিতামহ তার প্রায় বাঁঝা জমিতে বছরের বেশির ভাগ সময়টা নিজেকে নিংড়ে খুব সামান্যই পেতেন। বছরের বাকি সময়টার খোরাকির ভাবনা তাকে কালিদহের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সেই থেকে তার গায়ে বেলে-দোঁয়াশ মাটির সাথে সাথে শ্যাওলা জড়ানো আঁষটে গন্ধ আমাদের বাবাদের নাকে ঢুকে মগজে বিবিধ আড়স্টতার জন্ম দিত, কারন সেকালে তাদের সমবয়সিরা তাদের; "ঐযে জোলার ব্যাটা য্যাছে, ঐযে মাছুয়ার ব্যাটা দ্যাখ! দ্যাখ!" ইত্যাদি বলে বেলে দোঁয়াশ মাটির শুস্কতা থেকে কালিদহের মিশমিশে কালো পানিতে নামিয়ে দিত। "বুঝলিরে ভাই, চৈত মাসের দুপ্পহারেও কালিদহে ডুব দিলে একহাত দুরে কিছু দেখা যায় না, এমুন গহির আর ঠান্ডা।

একদিন ছুটু লা (নৌকা) খান লিয়া কালিদহে গেছি মাছ ম্যারতে। দু তিন বার জাল ফ্যালে ছুটু ছুটু ক'খান ব্যালা মাছ তুল্যাছি লা'য়ে, দেখি কি দহের মাঝ খানে পানি হইলকে উঠছে! হামি ভাবনু কি বড় গজাইড় কি বুয়াল হ্যবে মনে হয়, তাড়াতাড়ি লা'খান বাহে নিয়া গেনু মাঝ খানে। যায়া দেখি ঐখানকার পানি আরো গহির আর কালো, পানির দুলানিতে লা টাল খ্যাছে, কিন্ত কুনো মাছ দেখতে পাইনু না। দহের মাঝ খানটায় লা লিয়্যা কয়খান পাক দিয়ার পর দেখি, হামার লা'য়ের থ্যাকা বড় এক খান মাছ, লা'য়ের তল দিয়্যা হেল্যা য্যাছে! এ্যাতো বড্ডা মাছ দেখ্যা হামি লা বাহা ভুইল্যা গেছেনু!....." তো এরপর আমার পিতামহ তার ছোট নৌকার চাইতেও বড় মাছটির বর্ননা দিতেন এমন ভাবে যে, আমাদের বিস্ফরিত চোখ বেয়ে অলৌকিক মাছটি তার সমুহ বিশালত্ব নিয়ে ঠিক মগজের ধুসরে জায়গা করে নিয়েছিল এবং বছরে-দুবছরে তিনি আমাদের শহরে গ্রামের আকাল নিয়ে হাজির হলে, সেই মাছটি মাঝে মাঝে ঘাই মেরে উঠত! আমার পিতামহ এরপরে বহুবার, বলা ভালো বেশিরভাগ সময় কালিদহ চষে বেড়িয়েছেন তার নৌকার চাইতেও বড় মাছটির খোঁজে। কখনো কখনো মাছটি তাকে দেখা দিত; প্রাচীন শ্যাওলার নিলাভ আস্তর আর দহের মিশমিশে কালো পানি ওর প্রকৃত রংটা তার চোখে বিস্তৃত হতে পারত না, ফলে তিনি আমাদের মাছটির রং সম্পর্কে কোন ধারনা দিতে ব্যার্থ হতেন।

তবে আমরা ধরে নিতাম কালিদহের খুব গহন আর শীতল পানির সাথে প্রাচীন শ্যাওলা আর দক্ষিন নারায়নপুরের মানুষের ভয় মিলেমিশে একটা অব্যাখ্যাত রং মাছটিকে দিয়েছিল, যেটা ছিল না কালো, না ধুসর, না নিলাভ। "কুন জাতের মাছ? হামি কুনুদিন ঠাহর কইরতে পারি নি। বাঘা আইড়? ধুর ক্ষ্যাপা, বড় আইড় ভরা লদ্দি ছাড়া কুন্ঠে প্যাবি? গজাইড়ও না। সিন্দুইরা দুখান মুচ নাকের পান্জর দিয়া বারিয়ে লাম্বা হয়ে প্যাটের কাছে চইল্যা গেছে! আর কুনু মাছের দেইখাছিস এমুন?..." মাছটি দাদার নৌকার পথপ্রদর্শক হয়ে দহের দক্ষিনে; হিজলের অধমুখি ডালগুলো যেখানটায় নিজেদের ডোবানোর জন্য বাতাসের সাথে আঁতাত করে বার বার হেলে পড়ত, সেখানটায় নিয়ে যেত, যেখানটায় দহের তাবৎ বুড়ো মাছগুলো হিজলের ডাল বেয়ে নেমে আসা সুর্য্যকণার লোভে খাবি খেত। "বুইঝলিরে ভাই, ছ'স্যার ওজনের একটা বুয়্যাল পায়্যাছিনু ওঠ্যে!" বলতে বলতে অলৌকিক মাছটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার গলা বুঁজে আসত এমনকি বাঘ মার্কা গুলের প্রকপ ছাড়াই তার মুঁদে আসা চোখে কালিদহের নিস্তরংগ কোলাহল জেগে উঠত।

আর আমি এতোকাল পরে ছয় সের ওজনের বোয়ালের রুপালী উৎপাতে নিজের জিভে লালা জমতে দেখি। আরো দেখি আমাদের বাবাদের এঁটো হাতে ছয় সেরি বোয়ালের আঠালো তেল নাছোড়বান্দা হয়ে ঝুলে আছে, ঝুলতে ঝুলতে তাদের নাকের শিকনি টানার সাথে পৌঁছে যাচ্ছে মাথায়, কিছু তেল তাদের হেঁসেল ঘরের কালি-ঝুলিতে মেখে থাকে দীর্ঘদিন, বাড়ির মহিলারা পরবর্তিতে ছয়-সেরি বোয়ালের তেল-চর্বির গন্ধ ছড়িয়ে দেয় দক্ষিন নারায়নপুরের এ মাথা থেকে ঐ মাথা তক। যুদ্ধের পরে যেবার বড় একটা আকাল পিতামহের গ্রাম মুচড়ে ধেয়ে গিয়েছিল পুরো দেশটার দিকে, যেবার তার বেলে-দোঁয়াশ মাটিও পেট চিরে কিছু দিতে না পারার আক্ষেপে পুড়ে গিয়েছিল, যেবার তার বড় মেয়েটা খিঁচুনি দিয়ে চোখ বুঁজে আর কখনো খোলেনি; সেবার বড় একটা কোঁচ নিয়ে তিনি কালিদহে তার ছোট নৌকাটা ভাসিয়েছিলেন। ঐ মাছটাকে যদি কোন ভাবে গেঁথে ফেলা যায়, তো বড় আকালের ক'টা দিন বাড়ির হেঁসেলে প্রতিক্ষিত আগুনটা জ্বলবে। "সারা দিনমান ঢুঁড়্যা মরনু, কিন্তক মাছটাকে প্যানুনা।

একবার, খালি সন্ধ্যার মনে অর ল্যাজ খান দেখতে প্যায়াছিনু। হামি সারাদিনম্যান দহে লা লিয়্যা ঘু্র‌্যা বেড়াতুন.....মাছটাকে দেখতে প্যাতুন না! হপ্তা কি দু'হপ্তা পরে হ্যবে, দেখনু কি, দহের মাঝখানে পানি পাক খ্যাছে। তাড়াতাড়ি লা বাহে য্যায়া দেখি, মাছটা দহের মাঝ খ্যানে চিৎ হয়্যা, উপুড় হয়্যা পাক খ্যাছে! হামাখে দেখতে প্যায়া, লা ঘিরে চক্কর দেয়্যা শুরু করলে। ওর পাকের মধ্যে পইড়া হামার লা তো এই ডুবে সেই ডুবে, এমুন অবস্থা! হামি চোখ ভইরা ওখে দেইখ্যাছিনু সেদিন, কিন্ত ভাই জি হামি কহিতে পারবো না তোমাকে কি দেইখ্যাছিনু হামি!!......." চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে বা কাৎ হয়ে, নৌকা ঘিরে সাঁতরানো মাছটির ভেতর তিনি কি দেখেছিলেন তা আমাদের জানা হয়ে ওঠেনি, বরং তার শীর্ন রগওঠা হাতটা আমদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় তার বাড়ির নিরন্ন উঠোনে, যেখান তার মেজ ছেলে, আমার বাবা, শুন্য চোখে নির্মেঘ আসমানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ফাটলে গ্যাঁজাল উঠিয়ে পড়ে থাকলে, আমার পিতামহের হাত থেকে কোঁচখানা পড়ে যায় এবং চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে বা কাৎ হয়ে সাঁতরানো মাছটি তাকে ঘিরে কালিদহের গহন, হিম জলের আলেখ্য তৈরী করতে থাকে এবং আমার পিতামহের কাছে মাছটি হয়তবা হজরত খিজির হয়ে ওঠে অথবা দক্ষিন নারায়নপুরের মানুষের সম্মিলিত ভয়ের যোগফলে মাছটি অপার্থিব কোন দেও হয়ে ওঠে অথবা কিছুই হয়ে ওঠে না........তিনি শুধু চিৎকারে করে কার কাছে যেন ক্ষমা চেয়ে কেঁদে উঠেছিলেন!! তো এরপর আমার পিতামহ কখনই কালিদহের গহিন, শীতল পানিতে, তার ছোট নৌকার চাইতেও বড় মাছটিকে, যেটা না কালো না ধুসর না নিলাভ; আর সাঁতরাতে দেখেননি। কিন্ত মাছটির খোঁজে তার যাত্রা কখনই থেমে থাকেনি, এমনকি পদ্মা ফি বছর গর্ভবতি হয়ে দক্ষিন নারায়নপুরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত খেয়ে ফেললে কালিদহের জীবাশ্ম কোন এক চরের বালিয়াড়ির মধ্যে হয়ত জমে থাকে পুনঃর্জন্মের আকাংখায়, তারপরেও কালিদহের সেই মাছটির তালাশে ছেদ পড়েনি।

এমনকি বছরে-দুবছরে আমাদের রদ্দি শহরে তিনি গ্রামের আকাল নিয়ে হাজির হলেও, আমাদের বহুল ব্যবহৃত ব্যালকনির কাঁধে দু'পা তুলে তার সেই তালাশ জারি থাকত। পিতামহের কালো, শীর্ন রগ চিড়বিড়িয়ে ফুলে ওঠা হাতটার প্ররোচনায় এই যে আমি অন্ধকারকে কেটে ছেটে আঁধার না বলে বলছি, আন্ধার, এর কারন হতে পারে তার শবযাত্রায় কালিদহের জীবাশ্মের উপর দিয়ে হাটতে না পারার অপারোগতা। কুন্ডলি পাকানো আন্ধার জট ছাড়িয়ে মিতুদের জানালা লেপে দিলে আমি দেখি, কালিদহের জীবাশ্মে প্রোথিত আমার পিতামহের নৌকার চাইতেও বড়, না কালো না ধুসর না নিলাভ মাছটি খুব অলস সাঁতরাচ্ছে আমাদের শহরে। আমি আরো দেখি আমার পিতামহের গ্রামের আকাল মাছটির দীর্ঘ সিঁদুরে মোচে জট পাকিয়ে গর্ভিনী পদ্মার তলপেটের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আমাদের বহুল ব্যবহৃত ব্যালকনির সামনে মোচড়াচ্ছে খুব!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.