সকল ব্লগার ও ভিজিটর যদি আমার ধারাবাহিক উপন্যাসটি পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ রাখেন কৃতজ্ঞ থাকব- এখন থেকে প্রতি শনিবার পর্ব পোস্ট করব--লেখক
ছোটগল্প -
ছন্দপতন
পার্থসারথি
মহুয়া অনুভব করল সুদীপ্তর প্রতি ওর একটা অদৃশ্য টান আছে। টান না থাকলে বুকের ভেতরটা এমন শূন্য শূন্য লাগবে কেন ! বন্ধু-বান্ধব সবাই আছে অথচ সুদীপ্ত নেই বলে মহুয়ার কেন যেন মনে হচ্ছে কিছুই নেই। বিরাট শূন্যতায় সে হাবুডুবু খাচ্ছে। শরতের আকাশটাও মনটাকে টানছে না।
সুদীপ্তর সাথে বন্ধুত্ব অনেক দিনের।
প্রথম কাশেই পরিচয় । কিছুদিনের ব্যবধানে সম্পর্ক তুই-তে গড়ায় । তারপর সময়ের সি ঁড়িতে অসম্ভব রকমের চেনা । তবে দৃষ্টিতে সৃষ্টি প্রলয়ের আহ্বান , এমনটি কিন্তু নয়। ভাবনামৃতের স্বাদে প্রলুব্ধ হয় নি একথাও মহুয়া কিংবা সুদীপ্ত কেউ বলতে পারবে না ।
অবশ্য তা ছিল আশা ভঙ্গের মুহূর্ত । দু’জনার নি:শ্বাসে তন্দ্রাচ্ছন্নতার প্রভাব ছিল ভীষণ রকমের। শরতের আকাশ যেমন শুভ্র মেঘের হৃদয়কে বুকে আগলে রাখে ওরাও তেমনি ; পরস্পর এর চেয়ে গভীরে ওরা কখনও পে ৗঁছেনি। মহুয়া নিজেকে যতটুকু জানে তেমনি জানে সুদীপ্তকে । সুদীপ্তও মহুয়ার পছন্দ-অপছন্দকে মূল্যায়ন করে অন্য সবকিছুর উর্ধ্বে ।
আজকের এই মুহূর্তটুকু মহূয়ার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে । ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রকৃতি যেমন সু পরিবর্তনে অচেনা হয়ে ওঠে তেমনি আজ মহুয়ার মনোভূমি । চনমনে ভাবটা মহূয়াকে অস্বস্তিকর অবস্থায় এনে ঠেকিয়েছে। বসন্তের মাতাল হাওয়া চোখের পাতায় পাতায় এনে দিচ্ছে কপোত-কপোতীর সুখময় মুহূর্তের বর্ণালী নেশা । চাতক-চাতকীর মত এক বুক আশা নিয়ে বসে আছে মহূয়া।
মনের ভেতর তোলপাড় করে যাচ্ছে সুদীপ্তর অনুপস্থিতি । এ শূন্যতা যেন যুগ-যুগান্তরের ।
মহুয়ার চোখের গভীরতায় সুদীপ্ত নিখোজ হয়ে গেল । নিজের অস্তিত্বকে টের পেয়ে সুদীপ্ত বুঝতে পারল মহূয়ার টানে অতলান্তে ছিল । সুদীপ্তর কাছে মহূয়া প্রশ্নাতীত ।
মহূয়ার বাড়িয়ে দেয়া হাতে সুদীপ্ত বসিয়ে দিল নিজের হাত । দু’হাতের উষ্ণতায় অদৃশ্য টান ভালোবাসার মোহনায় একীভূত হল । নদীর নাম সুদীপ্ত অথবা মহুয়া ।
নদী স্রোতের টানে সভ্যতার হাটে মিশে গেল । কর্মময় জীবনের ব্যস্ততায় খাচায় বন্দী পাখি ।
দু’জনার সমান ব্যস্ততা। কাজের ভীড়ে নিজেরাই যায় হারিয়ে। পাখি ডাকা সকালেই ব্যস্ততা শুরু । পড়ন্ত বিকেলে কান্ত সুদীপ্ত । প্রথম পর্বের রেশ যেতে না যেতেই মহুয়ার দ্বিতীয় পর্বের হাতছানি ।
ডাক পড়ে সুদীপ্তর- ‘ ধর , হাল ধর , আমায় কেন একলা ছাড়ো । ’
সুদীপ্তর উত্তর- আমি এখন কান্ত । কিছুতেই হাত ছে াঁয়াতে পারব না । ’
‘ তুমি যেমন কান্ত , আমিওতো । ’ - সোফায় গা ছড়িয়ে মহুয়া বসতে বসতে বলল ।
ওসব আমার নয় ।
কেন নয় ?
আমার দ্বারা ঘর-কন্নার কাজ হবে না । এসব আমার ধাতে সয় না ।
ফ াঁকিবাজি কথা বলো না। আমি চাই সবকিছুতেই দু’জনার সমান আধিপত্য এবং সমান বিচরণ থাকুক।
ঘর-গেরস্থালি সম্পূর্ণ তোমার এক্তিয়ারে থাকুক ।
আর অন্য সবে ? -- মহুয়া সুদীপ্তর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে ।
মহুয়ার প্রশ্নে সুদীপ্ত কিছুটা ভড়কে যায় । সুচতুর সুদীপ্ত পরণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে - যেমন চলছে , চলুক ... ।
‘ এটা ভারি অন্যায় , সুদীপ্ত ।
সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে কীভাবে নিশ্চিন্তে থাক ?’ -- মহুয়ার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠল।
এত আবেগ প্রবণ হলে চলবে নাকি ? এসব তো চিরদিন তোমরাই চালিয়ে এসেছ । এখন এমন ‘না’ ... ‘না’ ... করছ কেন ?
দেখ সুদীপ্ত, আমিও কিন্তু তোমার মত রক্ত-মাংসে গড়া একজন স্বতন্ত্র মানুষ । তোমার যেমন ইচ্ছে-অনিচ্ছে , স্বাদ-আহলাদ আছে আমারও থাকাটাই স্বাভাবিক।
মহুয়া তুমি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছো।
প্রথমেই তোমাকে বলেছিলাম, মেয়ে-মানুষের চাকরি-বাকরির দরকার নেই। চাকরি ছেড়ে পায়ের উপর পা তুলে দিব্যি আরামে জীবন কাটাতে পারো।
তা পারতাম যদি না মানুষ হতাম। কিন্তু আমি তো একজন মানুষ । তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়েছি কি ঘরে বসে থাকার জন্যে? তুমি পারলে , আমি পারব না কেন ?
তাহলে কর , এত খ্যাটখ্যাট ভাল লাগে না।
চুপচাপ কাজ কর ।
অফিস শেষে তুমি যেমন বিশ্রাম চাও আমার শরীরও তো চায় , না কি ?
ইচ্ছে হয় তো চুপচাপ বসে থাক।
চুপচাপ বসে থাকলে কি সংসার চলবে?
সে আমার জানার বিষয় নয় ।
তাহলে কি তুমি সংসারের কেউ নয় ?
আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি ?
তবে এত নির্লিপ্ত থাক কেন ? তোমার ভাবে-সাবে মনে হয় সংসারটা শুধু আমার একার । এখানে তুমি অতিথি।
যা ভাবো তাই । এবার চুপ কর ।
এ হল প্রতিদিনকার প্রতিচ্ছবি। দিন দিন দু’জনার মনের টান হালকা হয়ে আসে। সূর্য ওঠে ।
অস্ত যায়। সময়ের সন্ধিণে দু’জনার মাঝে তিক্ততা বাড়ে । ে ঁবচে থাকা মানে, আশা-দূরাশার স্বপ্ন বুনে যাওয়া। প্রতিদিনকার পুনরাবৃত্তিতে ডায়েরীর পাতায় ছন্দ পতনের পূর্বাভাস। প্রতিটি সূর্যোদয়ের বেড়ে চলে সম্পর্কের দূরত্ব ধীরে ধীরে একজন অন্যজনের কাছে হয়ে ওঠে অচেনা মানুষ।
একই ছাদের নীচে বসবাস অথচ সম্পর্কের ফাটলে এক বিশাল মহাদেশ। সুদীপ্ত এবং মহুয়া বুঝতে পারে যে মাস ছয়েকের ব্যবধানে দু’জন দু’জনার কাছ থেকে অসীম দূরত্বে চলে সেছে। একে ে ঁবচে থাকা বলা চলে না ; জীবন্মৃত। নি:শ্বাসে নি:শ্বাসে কষ্টেরা বেড়ে ওঠছে ক্রমশ: । প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে ভীষণ একাকীত্বে।
এর মুক্তি প্রয়োজন। কিন্তু মহুয়ার ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে যায়। ভেঙে চুড়মাড় হয়ে যায় মহুয়ার স্বপ্নময় জীবনের ছন্দপতনের ভয়ে। গর্ভে এসে গেছে সুদীপ্তর ঔরসজাত আগামীর প্রতিধ্বনি। তাহলে! মহুয়া চিন্তার সাগরে অসম্ভব রকমের নিরুপায়।
এব্যাপারে সুদীপ্ত একেবারে নির্লিপ্ত। সুদীপ্তর সাফসাফ জবাব, এ ব্যাপারে আমার কোন চাওয়া-পাওয়া নেই ।
মহুয়া সুদীপ্তর এমনতর জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অন্তত:পে এটুকু আশা ছিল সুদীপ্ত ভালবাসার বীজকে নতুনভাবে রোপনের কথা বলবে।
মহুয়ার ভেতরটা হঠাৎ জমাটবাধা পাথরের মত ঘণীভূত হয়।
নি:শঙ্খচিত্তে নিজের ভেতরই ঘোষণা করল, সুদীপ্তর বীজকাহিনীর এখানেই সমাপ্তি ঘটুক। একথাতো আর সহজে ভাবা যায় না; এক সমুদ্র দু:খ বুকের ভেতর বাসা ে ঁবধেছে। তারপর মহুয়া নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়; ‘পৃথিবীটাই মায়া , মায়া করলেই মায়া আর নয়ত সম্পূর্ণ কায়া । ’
তারপর ভালবাসার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি। অবশ্য ভালবাসার সমাপ্তি একদিনে হয় নি।
আজ শুধু শেষাংশটুকু নি:শেষ হল। এখন দু’জন সমান্তরাল লাইনে সমান্তরাল যাত্রী । এক গ্রহ যেমন কচ্যূত না-হওয়া পর্যন্ত অন্য গ্রহকে স্পর্শ করতে পারে না তেমনি মহুয়া কিংবা সুদীপ্তও পারবে না। সমান্তর্লা ে ঁহটে যুগ যুগ পথ এগিয়ে যাবে কিন্তু কখনও আর কাছাকাছি আসবে না।
মহুয়ার শেষ উচ্চারণ-‘ ভাল থেকো ! ’- (১৪-০৩-১৯৯৮ বাসাবো,ঢাকা।
)
শেষ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।