ব্যাপারটা লজ্জারই বটে। দুই দুই বার রফিক স্যার বাড়ি এসে টাকা চেয়ে গেছেন।
আমার ছোট দুই ভাই এস এস সি পরীা দেবে। ওরা এলাকার ‘মিরপুর কোচিং’ নামে একটি কোচিংয়ে পড়েছিল। পরীা কাছাকাছি হওয়ায় পড়া শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু দুই মাসের টাকা বাকি পড়ে রইল। দুই হাজার টাকা। তখন পরিবারে খুব টানাটানি চলছে। অতএব মিরপুর কোচিংয়ের সত্বাধিকারী রফিক স্যারকে শেষপর্যন্ত টাকাটা আর শোধ করা হয় না। সেটা ২০০২ সালের কথা।
এখন ২০০৮। ইতোমধ্যে ছয় ছয়টি বছর পেরিয়ে গেছে। এই ইতোমধ্যে রফিক স্যারের সঙ্গে আমার বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই ওনাকে দেখামাত্রই মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছি। ভাব করেছি দেখিই নি।
অথবা কাছাকাছি কোনো গলি থাকলে সেখানে ঢুকে পড়েছি। পাওনাদার এড়াতে মানুষ যা করে আর কী। তবে গত বছর এলাকার একটি সেলুনে একেবারে তার মুখের ওপর পড়ে গেলাম। দৃশ্যটা এরকম : চেয়ারে বসা আমার শরীরের উর্দ্ধভাগ কাফন-সাদা কাপড়ে মোড়ানো। নাপিত আমার চুল কাটছে।
এমন সময় সেলুনে একজন ঢোকে। আয়নায় চোখ পড়তেই দেখি আমার পাশেই দাঁড়ানো রফিক স্যার। ণিকের জন্য চোখাচোখি। তারপর যা করতে হয়Ñ দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলি। চোখ তো বটেই মাথাও নিচু করে আড়ালের চেষ্টা করি।
অবশ্য ভেতরে ভেতরে আমি তখন ভয়ানক কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। একটা লোক যার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, চোখাচোখি হল, আমার চেয়ারের পাশে সে দাঁড়ানো, অথচ আমি তার সাথে কথা বলতে পারছি না। চোরের মতো নিজেকে লুকিয়ে ফেলছি। কী লজ্জা! আমার কানে এল তিনি নাপিতকে জিজ্ঞাসা করছেন, কখন আসলে খালি পাব? তারপর বেরিয়ে যান। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
রফিক স্যারের সঙ্গে আমার মুখোমুখি কথা হয়েছিল দুইবার। একবার তার কোচিংয়ে ভাইদের পড়াশুনার অবস্থা জানতে আমি নিজেই গিয়েছিলাম। তখনই পরিচয়। আরেকবার আমাদের বাড়িতে উনি যখন টাকা চাইতে আসেন তখন। দুইবারের সাাতে মোটামুটি তার সাথে একটা সম্পর্ক দাঁড়ায়।
কথাবার্তা হয়। ওনার সম্বন্ধে জানি। জানি ওনার কোনো চাকরিবাকরি নাই। এই কোচিংই সম্বল। আর টিউশনি করেন।
জগন্নাথ কলেজ থেকে গণিতে পাস করেছেন। বয়স ৩৪-৩৫। বিবাহিত। বউ নিয়ে কোচিংয়ের ভিতরেই থাকেন।
তো রফিক স্যারের কাছে দেনা হওয়ার পর যে কয়বারই তাকে এড়িয়ে গেছি প্রতিবারই মনে মনে ঠিক করেছি নিজের আর্থিক অবস্থাটা একটু সুস্থির হলে টাকাটা শোধ দিয়ে আসব।
এই সুস্থির সময়টা আসল ছয় বছর পরে সেদিন। এটা শুনে আপনার মনে হতেই পারে, মাত্তর দুই হাজার টাকা শোধ দিতে ছয় বছর লাগল? এতটাই খারাপ অবস্থা! আদতে ব্যাপারটা তা না। যখন ওনার কাছে টাকাটা দেনা হয় তখন সমস্যা ছিল বটে তবে মাস ছয়েক পরে সেটা শোধ দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু যা হয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার।
টানাটানির সংসার। টাকাটা যেহেতু সময়মতো শোধ দেওয়া হয়নি, দেব দেব করে আর দেওয়াও হয় না। সংসারে এক প্রয়োজন যায় তো আরেক প্রয়োজন এসে দাঁড়ায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাই।
আমারও তো কিছু সাধ-আহাদ আছে। আমার কষ্টের টাকা দিয়ে ভাইরা কবে কোথায় পড়েছিল তার দেনা শোধ করতে হবে কেন? তাছাড়া প্রায় মাসে আমি নিজেই ধারে পড়ে যাই। অতএব রফিক স্যারের দেনার কথা আমার পিতা ভুলে যান, আমিও একরকম ভুলে যাই।
কিন্তু ওই যে বললাম এই ছয় বছরে যে কবারই দেখা হয়েছে প্রতিবারই মনে মনে ঠিক করেছি টাকাটা এক সময় শোধ দেবই। কী দরকার একজন মানুষের কাছে সারা জীবন ছোট হয়ে থাকার? লোকটার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে সংকোচ বোধ করব, চোখের দিকে তাকাতে পারব না, কথা বলা তো দূরের কথা।
অথচ তার কাছে কোনো ভয়াবহ অপরাধ তো আমাদের নেই। মাত্র দুইটা হাজার টাকার জন্য কেন মিছিমিছি এই যন্ত্রণা পুষে রাখব? টাকা তো জীবনে কম কামাব না। অতএব সেদিন রফিক স্যারকে সস্ত্রীক রিকশায় যেতে দেখে ভাবলাম মাসের বেতনটা হাতে পেয়েই দিয়ে দেব। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ। ছোটখাট একখানা চাকরি করছি।
খরচটরচ পুষিয়ে জমার খাতায় যদিও তেমন কিছু রাখার অবস্থা আসেনি এখনো।
মাসের মাঝামঝি সময়। মাসের বেতন হয়েছে অনেক দেরিতে। বেতনটা পেয়েই ব্যাংক থেকে টাকা তুললাম। সাথে রফিক স্যারের জন্যও দুই হাজার অতিরিক্ত।
ইচ্ছা, বাসায় গিয়ে ছোট ভাইদের সাথে কথা বলে পরদিন সকালে গিয়ে দিয়ে আসব। মেজটা খুব সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। সুতরাং সেজটাকে সাথে নিয়ে যাব। কিন্তু ও আবার ১০টা/১১টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। আর আমি ৯টা/১০টার দিকে বের হয়ে যাই।
এসব ভাবতে ভাবতে বাস স্ট্যান্ড থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরছিলাম। ভিতরে এক ধরণের টলমলে আবেগ ও ভাল লাগা কাজ করছিল। ছয় বছর পর এই পাওনাটা পেয়ে নিশ্চয়ই তিনি ভয়ানক অবাক হবেন। তখন কী বলতে পারেন তিনি? সবচে বড় কথা টাকাটা দেওয়ার পর এতদিন তার কাছে আমি যে ছোট হয়ে ছিলাম সেটা ঘুচবে। এবার তার চোখে আমি বড় হয়ে যাব।
বাসায় যাওয়ার পথে রফিক স্যারের কোচিং পড়ে। সেটার সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেলাম। আজকেই দিয়ে আসব টাকাটা? ছোটভাইয়ের ঘুম ভাঙিয়ে সকাল সকাল নিয়ে আসা তো কম ঝক্কি না। ধুর, এখনই দিয়ে যাই; শুভ কাজে দেরি করতে নেই। মিরপুর কোচিংয়ের মেইন গেটে নক করলাম।
দাড়িওয়ালা, খালি গায়ের এক যুবক গেট খোলে। রফিক স্যারকে চাইলাম। জানালাম, আমি এক অভিভাবক, টাকা দিতে এসেছি। শুনেÑ ও, একটু দাঁড়ানÑ বলে যুবকটি ভেতরে গেল। এক মিনিট বাদে গায়ে পাঞ্জিাবি গলিয়ে হাতে তালা নিয়ে বেরিয়ে আসে।
মেইন গেটে তালা লাগাতে লাগাতে বলল, স্যার পাশের বাসায় থাকে, আসেন। বোঝা যাচ্ছে স্যারের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আগে কোচিংয়ের ভিতরেই পরিবার নিয়ে থাকতেন। এখন সেটাকে পুরোপুরি কোচিং বানিয়ে আলাদা বাসায় থাকেন।
একেবারে গায়ে লাগানো পাশের বিল্ডিংয়ের নিচতলা।
বিদ্যুৎ ছিল না। তবু রাস্তার ল্যামপোস্টের আলোতে সবকিছু স্পষ্ট। রাস্তার দিকের জানালায় যুবকটি নক করল, স্যার আসছেন? ভেতর থেকে পরুষ কণ্ঠের প্রশ্ন, কে? এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানালায় রফিক স্যারের মুখ। যুবকটি আমাকে দেখিয়ে বলল, একজন অভিভাবক আসছে। রফিক স্যার ভাল করে আমার দিকে তাকালেন।
আমি মুখে একটু হাসির ভাব এনে সালাম দিলাম এবং তার চোখের দিকে তাকালাম। দেনা শোধ করতে না-পারার লজ্জায় যে চোখকে এতদিন আমি কেবল চোরের মতো এড়িয়ে গেছি। কিন্তু আজ আমার চোখে-মুখে দীপ্ত গর্বিত ভঙ্গি। রফিক স্যার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকালেন, আপনি..। খানিকটা অবাক হলাম।
উনি আমাকে চিনতে পারছেন না? তার মানে ওনাকে দেখে আমি যে এড়ানোর চেষ্টা করতাম সেটা না করলেও চলত। যাহোক, মুখে বললাম, আমি আপন নিপুনের বড় ভাই। ওরা আপনার এখানে পড়ত।
ও আচ্ছা আচ্ছা, রফিক স্যার বললেন, তা হঠাৎ, কী ব্যাপার?
আপনার কাছে কিছু টাকা ডিউ ছিল, ওটা দিতে এসেছি।
ও, আসেন ভিতরে আসেন।
ভিতরে ঢুকলাম। ডাইনিং স্পেসসহ তিন কামরার বাসা। ছোট ছোট রুম। রুমগুলোতে চুনকাম হয়নি। যে রুমে বসলাম সেখানে একটা সিঙ্গেল খাট, একটা পড়ার টেবিল, চেয়ার তিনটা।
আমরা খাটের উপর বসলাম। চার্জারের আলোয় ঘরটা মোটামুটি আলোকিত।
শুরুতেই রফিক স্যার আমার পরিবারের খবরাখবর জিজ্ঞেস করেন। আমার বাবা কেমন আছে? কাজটাজ করতে পারছেন কি না? ছোট দুই ভাই কোথায় কোথায় কোন বিষয়ে পড়ছে। আমি কী করছি, বিসিএস দিচ্ছি কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথায় কথায় তার সুঅবস্থার কথাও তিনি বললেন। জানালেন মোটামুটি আছেন। সামনের লেনে তার পৌনে দুই কাঠার জায়গা আছে। ভাবছেন সেখানে একটা স্কুল
খুলবেন। নিউমার্কেটে, মুসলিম বাজারে দোকান কিনেছেন।
সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন। আর কোচিং ভালই চলছে। তবে মাঝেসাঝে কেবল ইংরেজির শিক পেতে মুশকিলে পড়তে হয়। আরো বললেন, অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে তাকে এখনো বেশ কয়েকটি টিউশনি করতে হয়। যদিও টিউশনি করতে এখন তার ভাল লাগে না।
আর কত?
রফিক স্যারের আর আমাদের পারিবারিক অবস্থার পার্থক্যটা চিন্তা করে ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে হল টাকাটা ফেরত না দিলেই ভাল হত। এই ক বছরে লোকটার অবস্থা তো বেশ দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের! এখনো তেমন কিছু হল না। যাহোক, বিশ মিনিটের বেশি সময় কথাবার্তা চলল।
এর মধ্যে বিদ্যুৎ চলে আসে। আমি উঠলাম। টাকাটা রফিক স্যারকে দেয়ার জন্য পকেটে হাত ঢোকাই। দিতে দিতে বললাম, দুই হাজার টাকা বাকি ছিল কিন্তু এতদিনে তো টাকার অনেক অবমূল্যায়ন ঘটে গেছে। রফিক স্যার হাতে নিয়ে বললেন, কী জানি কত পাইতাম মনেও নাই।
বুকটা উঁচিয়ে রফিক স্যারের বাসা থেকে বের হলাম। ভেতরে খুব সুখ অনুভব করছি। এখন থেকে তার সঙ্গে দেখা হলে আমি আগ বাড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলতে পারব। আসলে মানুষকে দিতে পারার মধ্যে এক দারুণ আনন্দ আছে। যদিও এখানের দেয়াটা অন্য রকমÑ ধার শোধ।
বাসায় এসে ফুর্তি নিয়ে খেতে বসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, মিরপুর কোচিংয়ের রফিক স্যার দুই হাজার টাকা পাইত না?
না, এত টাকা না, পাঁচশ না ছয়শ জানি পাইত। তরকারি গরম করতে করতে মা বলেন।
কী বল? দুই হাজার না পাইত?
নাহ। আপন পরে একবার এক হাজার, আরেকবার পাঁচশ টাকা দিয়ে আসছিল তো।
আপন সে সময় এ ঘরে ঢোকে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করি। ও-ও বলে, পাঁচশ না ছয়শ টাকা বাকি জানি। ঠিক মনে নাই।
শুনে তো আমি থ। কেবল বলি, টাকা কবে শোধ দিলা, আমি তো জানলাম না।
মা জিজ্ঞেস করলেন, কেন কী হয়েছে?
আমি কিছু বলতে পারি না, শুধু বললাম, না, মাঝে মাঝে রফিক স্যারের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়।
ওÑ। মায়ের মুখে এক ধরণের অপরাধবোধ ফুটে ওঠে। টাকাটা দিয়ে আসা দরকার। আপন তোর যে মাসে সুবিধা হয় টাকাটা একবার দিয়ে আসিস রে বাবা।
নইলে মানুষের অভিশাপ লাগে।
আমি এ বিষয়ে আর কিছু বলি না। নিঃশব্দে খেতে থাকি।
জ্যৈষ্ঠ ১৪১৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।