বাঙালির দেনা-পাওনা
ফকির ইলিয়াস
একটি আনন্দের সংবাদ। বিশ্ব মানবতার কল্যাণে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অক্টোবর ’০৭ মাসেই বাংলাদেশের অন্যতম এনজিও সংস্খা ব্র্যাক যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কার্যক্রম চালু করছে। ‘ব্র্যাক ইউএসএ’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের কাছে নিবন্ধনকৃত এই সংস্খা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের সেবামূলক কার্যক্রম ক্রমেই প্রসারিত করবে। ব্র্যাক ইউএসএর সিইও হিসেবে আছেন সুজান ডেভিস। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এনজিও ব্যক্তিত্ব এবং ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ফজলে হোসেন আবেদ গেল ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সোমবার সন্ধ্যায় এই তথ্য জানান।
নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা রেস্টুরেন্টে তার সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্টানে তিনি সুধীবৃন্দ ও মিডিয়ার সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন।
জনাব আবেদ ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ বর্ণনা তুলে ধরে বলেন, কর্মস্পৃহা আমাদের এতদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে। তিনি জানান, ‘ব্র্যাক ইউকে’ এর যাত্রাও শুরু হচ্ছে শিগগিরই। ব্র্যাক ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সাউদার্ন সুদান, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া এবং উগান্ডায় যে কর্মকাণ্ড পরিচালিত করছে তা বিশ্বে ব্যাপকভাবে নন্দিত হয়েছে। তিনি বলেন, কোন অপতৎপরতাই মানুষের উন্নয়ন এবং অগ্রসরমাণতাকে আটকে দিতে পারে না।
বিশ্বের সব দেশের গরিবই একই শ্রেণীর। সুষ্ঠু গাইডলাইন পেলে, তাই তারা সমান উদ্যম নিয়েই এগুতে চায়।
ব্র্যাক ইউএসএ’এর কর্মকাণ্ডে অভিবাসী বাঙালিদের সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, মাত্র চল্লিশ ডলারের সমপরিমাণ অর্থের বিনিময়ে একজন ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ তার পুরো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারেন। একজন দুস্খ মানুষের চক্ষু অপারেশনে মানবিক কারণে যে কোন প্রবাসী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। ‘ব্র্যাক ইউএসএ’ প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চায়।
তিনি জানান, তাদের ম্যানহাটান অফিসটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পুরোদমে কাজ শুরু করবে। এ লক্ষ্যে সিটির মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। আগ্রহী প্রবাসীদের ম্যানহাটান অফিসে যোগাযোগের অনুরোধ জানন তিনি।
এই উদ্বোধনী মতবিনিময় সভায় চমৎকার বক্তব্য রাখেন মিস সুজান ডেভিস। তিনি বাংলাদেশে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ডাইরেক্টর ছিলেন।
দীর্ঘ ২০ বছর তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। মিস ডেভিস বলেন, বাঙালিরা খুব আত্মপ্রত্যয়ী জাতি, তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ় সাহস রাখেন। যদি তারা ঠিকমতো পথ প্রদর্শিত হন, তবে কোন প্রতিকূলতাই তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না।
তার কথা শুনে আমার বারবার মনে হলো, এই চেতনা নিয়েই তো বাঙালিরা মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু আজ কোথায় সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন।
এ বছর ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক সম্মাননা পদক পেয়েছেন ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদ। একটি জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার হাতে পদকটি তুলে দেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এই যে পাওয়া, তা শুধু সম্ভব হয়েছে কর্মের নান্দনিকতার মাধ্যমে। যদি এখানে ভোগের প্রচেষ্টা থাকত তবে হয়তো তা সম্ভব হতো না।
দুই
বাংলাদেশে এই যে ভোগবাদের উল্লাস এবং বর্তমানে যেসব ভোগবাদী অনেকের জেলবাস, এর যবনিকাপট কীভাবে ঘটবে? এই প্রশ্নটি করেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে।
তিনি কানাডা সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশনের ইফতার মাহফিলে এসেছিলেন তিনি। শ্রী সেনগুপ্ত বললেন, বাংলাদেশের মানুষের পাওনা মেটাতে পটপরিবর্তনের কোন বিকল্প ছিল না। যে রাজনীতি মানুষের কল্যাণে আসে না তেমন রাজনীতির দরকার কি? তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার অত্যন্ত অপরিহার্য। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তবে কি খালেদা-হাসিনাকে বাইরে রেখেই নির্বাচন হবে? তিনি মুচকি হাসলেন।
বললেন, সে প্রশ্ন আসছে কেন? বললাম, অবস্খা তো সেদিকেই গড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আইনি প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই আমাদের নেত্রীকে মুক্ত করব। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সংস্কারের স্বরূপ কি? বললেন, পরিবর্তন প্রয়োজন। যে চেয়ার মানুষের চেয়ে বড় হয়ে যায় সে চেয়ারের মূল্যায়ন মানুষকেই করতে হবে।
চেয়ারের চেয়ে মানুষ যদি বেশি অহমিকাপূর্ণ হয়ে যায় তবে পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাকে বললাম, এসব কথা দেড় বছর আগে বলেননি কেন? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বলার সুযোগই তো পাইনি।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাস্কফোর্সের নতুন লিস্টে মান্নান ভূঁইয়া বা আরও বেশকিছুর নাম নেই কেন? তিনি বলেন, তা আমি বলতে পারব না। তিনি বলেন, যে যা করবেন সবকিছুর জন্যই এক সময় জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সবশেষে তিনি বলেন, একটি জাতীয় সংলাপ এবং জাতীয় সরকারই এই জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে নিয়ে যেতে পারবে বলে আমি মনে করি।
কার সঙ্গে সংলাপ, কীভাবে সংলাপ এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকটা এড়িয়ে গেলেন তিনি।
তিন
বর্তমান আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বক্তব্য মাঝে মধ্যে আমাদের বেশ হতাশ করে। তিনি বলেছিলেন, দেশের অবস্খা খুবই নাজুক। অনেক অশুভ শক্তি দেশে সঙ্কট সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এটি জানা কথা, বর্তমান সরকার যেভাবে সাহসী কাজগুলো করছে তাতে তাদের শক্রসংখ্যা বাড়বে বৈ কমার কথা নয়।
বিএনপি নেতা আলী আসগার লবীর আরও সাজা হয়েছে একটি মামলায়। এজলাসে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, সময় আবার তাদের আসবে। এই আশাবাদ দেশের অনেক দাগি ব্যক্তিদের। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা কামাই করে দেশে এমন অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন যেন তাদের নিজস্ব তালুক ছিল গোটা দেশটাই।
সংস্কার বলি আর পরিবর্তন বলি, যে স্বপ্নটি বাঙালি জাতি দেখে আসছে তা বাস্তবায়িত হবে তো? প্রশ্নটি নানাভাবে কঠিন সাজে আসছে আমাদের কাছে।
অনেকে বলে বেড়াচ্ছেন সংস্কারে ধস নেমেছে। আবার জোটমুখী রাজনীতিই জোরালো হবে বাংলাদেশে। হঠাৎ করে বিএনপির একাংশের নেতা মান্নান ভূঁইয়ার খালেদাপ্রীতি নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কারণ আপাতত হিসাব মতো মান্নান ভূঁইয়ার গ্রুপই বিএনপির ছাতা ধরে এগিয়ে যাওয়ার কথা। খন্দকার দেলোয়ার গ্রুপ যেহেতু খালেদাপন্থি তাই তাদের সুবিধাবঞ্চিত থাকারই কথা।
কিন্তু হঠাৎ করে মান্নান ভূঁইয়া সুর পাল্টানোর চেষ্টা করছেন কেন? তবে কি অংকে কোথাও গোলমাল হচ্ছে?
বড় দুই দলের দু’জন নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং তোফায়েল আহমদ সংস্কারপন্থি বলে এতদিন পরিচিত ছিলেন। টাস্কফোর্সের সর্বশেষ তালিকায় তাদের নাম থাকায় অনেকেই নতুন করে অংক কষছেন। আমি বলি, এমনও তো হতে পারে তারা সম্পত্তির হিসাব দেয়ার পর সৎ বলে প্রতীয়মান হয়ে যেতেও পারেন। সবই এখন কুয়াশাচ্ছন্ন। বলা যাবে না কার স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করা হবে।
কেন রক্ষা করা হবে।
এখন আবার শোনা যাচ্ছে , দুই প্রধান নেত্রীকে চিকিৎসার নামে বিদেশে পাঠানো হতে পারে।
তবে কি যে লাউ , সেই কদুই লটকে আছে বাঙালির ভাগ্যে ???
ব্র্যাক ইউএসএ চালুর সংবাদ দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। ‘গ্রামীণ ইউএসএ’ও চালু হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে। সেদিন ফজলে হাসান আবেদ খুব উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছেন, বাঙালি জাতি শুধু নিতে পারে, দিতে পারে না এই ধারণা ভেঙে দিতে চাই।
এবার আমরা বিশ্বকে দেব। আফগানিস্তানে ব্র্যাকের উদ্যমী কর্মসূচি স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
হ্যাঁ, বাঙালিরা অবশ্যই দিতে পারত। যদি শুধু একটি সৎ রাজনীতির আবহ গড়ে উঠত বাংলাদেশে। এই প্রজন্ম এখনও সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করেই এগুচ্ছে।
যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের সুযোগ অবারিত করে দেবেন, এটাই প্রত্যাশা কেবল। প্রতিটি দিন হোক আনন্দের।
============================================
দৈনিক সংবাদ। ৪ জানুয়ারী ২০০৮।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।