আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালির আত্মপ্রতিকৃতি : কীর্তিহীন এক জাতিসত্ত্বা (খন্ড-১)

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙলি করে, মানুষ করনি। এক. বাঙালি এবং বাংলাদেশী পরিচয় দিতে কি আপনি গর্ব বোধ করেন ? আমি করি না। আমি বাঙালি এবং বাংলাদেশী পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। আমার বিকাশমান সত্ত্বায় বাঙালি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, মানসিক উন্মেষ ও চিন্তাধারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দেখা দেয়, দ্বিধান্বিত করে; আরও ভয়াবহ যে, এই প্রক্রিয়াকে ক্ষেত্রবিশেষে সংকুচিতও করে। দুই. আমার আত্মস্বীকৃত এই বিবৃতি আপনাকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করছে, ব্যথিত ও হতাশ করছে -- আমি জানি।

প্রচন্ড ঘৃণায় আপনি এই অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন -- আমি উপলব্ধি করতে পারি। আপনার এবং আপনাদের এই সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয় -- কারণ, আপনি বাঙালি, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমিও। ঋণাত্মক আবেগের আতিশয্য বাঙালির প্রবল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আর তাই আপনি সংক্ষুব্ধ হবেন, যৌক্তিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তিন. আপনার ক্ষুব্ধতা কিছুটা লাঘবের চেষ্টা করি। নিচের নাতিদীর্ঘ তালিকাটির দিকে তাকালে বেদনার কিছুটা প্রশমন হতে পারে।

একান্ত নিজস্ব বিচারে আমি এই তালিকার ক্রম নির্ধারণ করেছি। বর্তমান বিশ্ব সভ্যতায় কোন জাতি/জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক মূল্যায়নের একটি মোটা দাগের ক্রমবিন্যাস এই তালিকা। ০১. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ০২. পূর্ব ইউরোপ ০৩. দক্ষিণ আমেরিকা (এবং রাশিয়া) ০৪. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দূরপ্রাচ্য ০৫. দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশ (পাকিস্তান ব্যতীত) ০৬. মধ্যপ্রাচ্য (ইসরাইল ব্যতীত) এবং পাকিস্তান ০৭. আফ্রিকা (দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যতীত) এবং বিশেষত পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা চার. এই নাতিদীর্ঘ তালিকায় আপনার জন্য আত্মপ্রসাদ হচ্ছে -- বাঙালি জাতি হিসেবে প্রায় সমগ্র আফ্রিকার জাতিগোষ্ঠী থেকে উন্নততর (সামগ্রিক বিবেচনায়) এবং মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় সুনির্দিষ্টভাবে উন্নত চিন্তাশীল এবং দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের তুলনায় মননে এবং মানসিকতায় প্রগতিশীল। পাকিস্তানের জাতিগোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যের জাতিসমূহের তুলনায় কিয়দংশে যৌক্তিক ভাবধারাসম্পন্ন। পাঁচ. অনুরূপভাবে, বাঙালি জাতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের জাতিসমূহের তুলনায় প্রগতিশীলতায় দীন।

বিশেষত পশ্চিমের জাতিগোষ্ঠীর কীর্তি, অবদান, প্রায়োগিক যুক্তিবোধ এবং মানসিকতার বিপরীতে বেদনাদায়কভাবে নিকৃষ্টতর। ছয়. এই ক্ষুদ্রতার ক্ষেত্র এতটাই সুবিশাল যে তা নির্দেশ করে প্রায় সর্বব্যাপী হীনতা। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরের প্রতিটি শাখায় এবং প্রশাখায়, এমনকি এর প্রতিটি গলি ঘুঁপচিতে দীনতার জাজ্বল্যমান উপস্থিতি। বাণিজ্য-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-দর্শন-সংস্কৃতি-সাহিত্য-ক্রীড়া-রাজনীতি-মূল্যবোধ, সভ্য জীবের যাপিত জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের মর্মন্তুদ ব্যর্থতা। সাত. সহজাত প্রশ্নের উদ্রেক যৌক্তিকভাবেই সম্ভাব্য -- বর্ণিত বিশ্লেষণ বিচার্যের ভিত্তি কি ? উপাত্ত ও তথ্যের উৎস কি ? দৈন্যতা পরিমাপের মাপকাঠির স্বরূপ কি প্রকারের ? জাতীয় বৈশিষ্ট্য কি অর্থনৈতিক সাফল্যে পরিগণিত, না-কি জ্ঞান-বিজ্ঞান পরিচর্যার ক্ষেত্রসমূহের আলোকপাতে বিশ্লেষিত ? অথবা, দর্শন-সাহিত্য-ক্রীড়া এর বিষয়বস্তু ? মূল্যবোধ এবং রাজনীতি কি এর পরিমাপক উপাদান ? আত্মবিশ্লেষণে নির্মোহভাবে বর্ণিত ক্ষেত্রে স্বজাতির মূল্যায়নই আমার সিদ্ধান্তে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

আট. এক কোটি বিশ লক্ষ বছর আগের অস্ট্রালোপিথেকাস, বিশ লক্ষ বছর আগের হোমো বর্গের মানুষ, তার অগ্রসরমান অংশ হোমো ইরেক্টাস, প্রাগ্রসর প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েনস্‌, যারা দুই লক্ষ বছরের প্রাচীন, পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বের নিয়ান্ডারথাল কিংবা পশু শিকারী আদি মানব ক্রো-ম্যানিয়ঁ, নতুবা ধর্ম মতে আদি মানব আদম বা অ্যাডাম, যা-ই হোক, আমাদের মনুষ্য প্রজাতির একটি সাধারণ সূচনা রেখা ছিল। তৎপরবর্তী বিস্তৃত অতীত নিশ্চয়ই বিস্মৃত নয়। মনুষ্য প্রজাতি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীব্যাপী। খ্রীস্টপূর্ব ২৮০০০ সালেই বেরিং প্রণালী পার হয়ে মানুষ গেল আমেরিকায়। খ্রীস্টপূর্ব ১০০০০ সালেই মানুষ পৌঁছে যায় দক্ষিণ আমেরিকার প্রান্তে।

যা-ই হোক, এই গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষ টিকে থাকার দুর্বার তাগিদেই প্রকৃতির সঙ্গে শুরু করে যুদ্ধ এবং যুগপৎভাবে বাড়তে থাকে তার অভিযোজ্যতা। এই নিরন্তর সংগ্রামে ব্যাপৃত মানুষ পার করেছে সুবিশাল সময়। সভ্যতা এগিয়েছে মানুষের জীবনের সাথে তাল রেখে, প্রায়শঃই একই মাত্রায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির আশীর্বাদ পাওয়া সম্প্রদায় অগ্রগামী হবে, সেটাই তো প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু, তা-ই হয়েছে কি ? যে সম্প্রদায় প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল, কিভাবে তারাই আজ প্রাগ্রসরমান জাতি হিসেবে আবির্ভূত ? আমাদের এই নাতিশীতোষ্ঞ রোদ্রময় উর্বর আবাসভূমির অধিবাসীদের তুলনায় তীব্র শীতপ্রধান বৈরী জলবায়ুর অধিবাসীদের সাফল্যের উৎস কি ? তারা কি এই ক্ষেত্রে অধিকতর যোগ্যতার প্রমাণ দেয়নি ? নয়. শুধুমাত্র আশ্চর্যজনকভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে নয়, তাদের সাফল্যগাঁথা বিস্তৃত প্রাচীন বিশ্ব, মধ্যযুগ, নৃপতিদের শাসনকাল ও তার পূর্ববর্তী রেনেসাঁ এবং পরবর্তী শিল্প ও রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রাক ও উত্তরসময়ে, ইউরোপীয় উপনিবেশকাল, অতঃপর আধুনিক বিশ্বে।

খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ সালে বৃটেনের পাহাড়ে তৈরী হয় উইন্ডমিল, খ্রীস্টপূর্ব ৭৭৬ সালে গ্রীসে বসে প্রথম অলিম্পিক ক্রীড়ার আসর। ইতিহাসের সেইক্ষণে আমার জাতিসত্ত্বার হতাশ অনুপস্থিতি আমাকে সক্ষমতার বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমি নির্মোহভাবে উত্তর খুঁজি, আমাদের ব্যর্থতার কলঙ্ক-চিহ্ন আবিষ্কার করি। দশ. ভারতে সর্বথম বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রীস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে। দক্ষিণ বিহারের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ চন্দ্রগুপ্ত নন্দ বংশের বশ্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্যর্থ হন এবং আলেকজান্ডারের আশ্রয়লাভে চলে যান উত্তর-পশ্চিম ভারতে।

পরবর্তীতে, অনেকের বিশ্বাস গ্রীক সমর্থনেই তিনি নন্দ রাজাকে পরাজিত ও নিহত করেন। দক্ষিণ বিহার বা মগধের সিংহসন লাভের পর চন্দ্রগুপ্ত উত্তর ভারতকে তাঁর শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করে বাংলা থেকে আফগানিস্তানের সীমান্ত হিন্দুকুশ পর্যন্ত। খ্রীস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে তিনি আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসক সেলুকাস নাইকেটরের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেন। মৌর্য সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোক।

তিনি খ্রীস্টপূর্ব ২৪৭ অব্দ থেকে ২৩৬ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তা প্রচারের জন্য ধর্ম প্রচারকদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছিলেন। এই স্থানীয় পরিমন্ডলেও কোথায় আমি এবং আমরা ? এগার. তবে আমি সুদূর অতীতকে আমার বিচার্যের পরিমাপক বলে দাবী করছি না। বিশ্ব ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের অবদান, আরও খোলাখুলিভাবে বললে উপস্থিতি নগণ্য, প্রায় অস্তিত্বহীন। ছাপাখানার উদ্ভব আমরা করিনি, আমরা আবিষ্কার করিনি বিদ্যুৎ, বিজলী বাতি, বাষ্পীয় ইন্ঞ্জিন, মাধ্যাকর্ষণ সূত্র, জ্যামিতি, লগারিদম, ব্যারোমিটার, টেলিগ্রাম কিংবা টেলিফোন।

বঙ্গভূমি বন্ধ্যা ছিল জন্ম দিতে কোন পীথাগোরাস, আর্কিমিডিস, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, দেকার্তে, এডিসন বা গ্রাহাম বেলের। নতুন ভূ-খন্ড আবিষ্কার, ভিন্ন মহাদেশ শাসন বা দুঃসাহসিক অভিযানের যোগ্যতর জাতির মর্যাদা ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতায় কাদের অনুকূলে ? অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার, অজেয়কে জয় করবার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা কেন শুধু পশ্চিমের অধিবাসীরাই প্রদর্শন করতে পারল ? মহাসমুদ্রের বিশালতা আর বিপদ তাদেরকে সন্ত্রস্ত করেনি, করেছে রোমাঞ্চিত ! দিগ্বিজয়ের দুর্দমনীয় নেশা আমাদের মাতাল করতে পারেনি, সাগর-বধূর দুর্নিবার আকর্ষণ আর জ্ঞানের পিপাসা আমাদের তৃষ্ঞার্ত করেনি এতটুকু ! কোন কলম্বাস, ভাস্কো-ডা-গামা বা জেমস কুকের জন্ম হয়নি এদেশে, কারণ তার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি কেউ, তাই ছিল না কোন পৃষ্ঠপোষকতা, সেই সাথে মেধার জগতেও ছিল দারুণ ক্ষরা। বিপদসংকুল অরণ্য, ঊষর মরুভূমি বা তুষারাবৃত প্রান্তর -- আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এমনকি অ্যান্টার্কটিকা -- এই গ্রহের আনাচে-কানাচে সর্বত্র চষে বেড়িয়েছে স্প্যানিশ, ওলন্দাজ, পুর্তগীজ, ইংরেজ কিংবা ফরাসীদের জাতি, নিশ্চিয়ই ঐ পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কষ্টসাধ্য এবং বন্ধুর। তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং যুগপৎভাবে প্রতিকূল ভিন্নভাষী ভূ-খন্ড অধিকার এবং শাসন করেছে। শক্তিমত্তার সে-ই সময়ে সুনিশ্চিতভাবেই তারা যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে।

পক্ষান্তরে, উপনিবেশ ও অভিযান তো সুদূরের স্বপ্ন, আমরা নিজেদের স্বাধীনতাকেই সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। যদিও দাবী করি, ১৭৫৭ সালে আমদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তগামী হয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে এতদ্‌অঞ্চলের অধিবাসীগণ স্ব-শাসনের অধিকার হারায় ১২০৩ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসেই, যখন ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী নামক এক ভিনদেশী মাত্র গুটিকয় সৈন্য নিয়ে এ অঞ্চল দখল করেন। বার. দর্শন, শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রটি আরও করুণ। গত দু'শো বছরে বাঙলির ও বাঙলা সাহিত্যের কোন মৌলিক সৃষ্টি নেই। পদাবলী ও মঙ্গলকাব্য উত্তরকালের মহাকাব্য, রোম্যান্টিসিজম্‌ এবং আধুনিকতা সবই পশ্চিমের অনুরণণ মাত্র।

উপন্যাসের ধারণা বাঙালি পেয়েছে পশ্চিম থেকে, একই সত্য প্রযোজ্য নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও। বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাস স্কটের অনুকরণ, বাঙলায় মহকাব্য, সনেট, ট্র্যাজেডী, প্রহসন মধুসূদনের সৃষ্টি, যার মূল বীজ ও ধারণা তিনি পেয়েছেন ইউরোপে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিসিজম্‌ জন্ম নিয়েছে যখন, ইউরোপে তখন সে-ই ধারণা একশ' বছরের পুরান, তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে নতুন সাহিত্যান্দোলনের। রবীন্দ্রনাথের পর শ্রেষ্ঠ বহুমুখী প্রতিভা বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বাংলা কবিতার 'প্রধান পুরোহিত' হতে পেরেছিলেন কারণ তিনি এবং সমসাময়িক প্রায় সকল আধুনিক কবিই ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র, তাঁদের প্রতিভা ছিল ইউরোপীয় সাহিত্যকে আত্মস্থ করার এবং এর বাংলা অবয়ব রূপায়ণের, কিন্তু আধুনিকতাবাদের ধারণা তাঁরা এনেছেন পশ্চিম থেকে ঋণ করে। তের. এই গাঙ্গেয় অববাহিকার উর্বর সমতলে অর্থনীতিতে আমাদের অবস্থান মর্মান্তিক এবং কষ্টকর।

এর বিশদব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়। ১৯১৪ - ১৯১৮ এবং ১৯৩৯ - ১৯৪৫ এ দুই দুইটি মহাযুদ্ধের ক্ষতি আত্মস্থ করে জার্মানীর পুনরায় অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে সময় লেগেছে কতদিন ? ১৯৪৫ এর আণবিক আঘাত সহ্য করে জাপান ঘুরে দাঁড়াতে কত বছর সময় নিয়েছে ? যদি আনুষ্ঠানিক উদ্ভবের সময় থেকেও হিসাব করি, সার্ক পার করেছে প্রায় সিকি শতাব্দী, সেই তুলনায় অর্জন প্রায় শূন্যের কোঠায়। অপর পক্ষে ১৯৬৭ তে জন্ম নেয়া আসিয়ানের দেশসমূহ প্রথম দশকের পর মধ্য আশির দশকেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিগত দুই দশকে তারা অভাবনীয় সাফল্যে চমকে দেয় গোটা বিশ্বকেই। তারা ভিন গ্রহের কেউ নয় -- আমাদেরই নিকট প্রতিবেশী।

১৯৪৭ এর আগস্টে উপমহাদেশ দ্বি-খন্ডিত হবার পর আমরা পার করেছি প্রায় ৬১ বছর, এবং এককভাবে ১৯৭১ এ স্বাধীনতার পরবর্তীতে প্রায় ৩৭ বছর। আমাদের অর্থনৈতিক অর্জন কি ? ব্যর্থতার দায়ভার আমরা কার ঘাড়ে চাপাব, নিজেদের ছাড়া ! আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর পরাক্রমশালী সোভিয়েট রাশিয়া বিশ্ব পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে এর অর্ধেক সময়কালেই। আমরা স্বাধীনতার পর ৩৭ বছর ইতোমধ্যেই পার করেছি, জাতিগত তুলনায় পরবর্তী অংশ বর্ণণা নিস্প্রয়োজন বোধ করছি। চৌদ্দ. হাজার বছরের ইতিহাসে আমার কাছে বাঙালির একমাত্র অর্জন ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা (১৯৫২ সালে রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক স্বকীয়তার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চরম পরিণতি ১৯৭১ এর পবিত্র মুক্তিযুদ্ধ -- এই বিশ্লেষণে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনকে পৃথক অর্জন হিসেবে উল্লেখ করলাম না)। এই একটি ঘটনায়, মহত্ত্বে বাঙালি তার সকল অতীতকে ছাপিয়ে উর্ধ্বে উঠে গেছে, এইখানে আমর দৃষ্টি শ্রদ্ধায় অবনত হয়, আমি বাঙালিকে অভিবাদন জানাই, আমাকে অভিবাদন জানাই।

পনের. মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক অবক্ষয়ে আমরা এখনও আফ্রিকা মহাদেশের গুটিকয় দেশের তুলনায় স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আছি। আত্মপ্রসাদের কি অপূর্ব পরিতৃপ্তি ! কয়েক দশক পর হয়ত আমাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মনুষ্য জাতি ব্যতিরেকে শক্তিমান কোন পশুর সঙ্গে আমাদের তুলনা খুঁজব, আর নয়ত কোন ভিন গ্রহের প্রজাতির সন্ধান করতে হবে। একসময় আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অস্ত্র ধরেছি, তারপর পাকিস্তানীদের পরাজিত করেছি, তখন নিজেদের তুলনা করতাম মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এইসকল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের পরিমাপে। আজ উন্নয়ন সূচকে কোথায় তাদের অবস্থান, আর কোথায় আমরা ! সময়ের আবর্তে ' ....... হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম' স্লোগানটি হাস্যকর হয়ে পড়েছে, কারণ যেকোন পরিণামেই বাঙলা এখন ভিয়েতনাম হলে আমরা সবাই আনন্দিতই হব, কারণ সেই রক্তাক্ত ভিয়েতনাম এখন অগ্রবর্তী অর্থনীতির শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরী করছে। [ ..... ... দয়া করে রাগান্বিত হবেন না, আমি নিজেও জন্মসূত্রে একজন বাঙালি।

আত্মবিশ্লেষণ ছাড়া আত্মউন্নয়ন অসম্ভব। আত্মসমালোচনা আর আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে আসতে পারে আত্মউপলব্ধি, আত্মউপলব্ধির পথ ধরে আমরা শুধরে নেব আমাদের ভুল এবং সীমাবদ্ধতা। আমরা যদি না-ও পারি আমাদের উত্তর প্রজন্ম, পুত্র-কন্যারা কলঙ্কের কালিমা মুছে ললাটে এঁকে দেবে সাফল্যের কীর্তির রাজটীকা। আমরাও দাঁড়াব গর্বিত ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতির সারিতে। আসুন, সেই সোনালী দিনের প্রত্যাশায় আমরা বুক বাঁধি।

] (ক্রমশ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.