অনিকেত
পার্টির বিরুদ্ধে আক্রমণের কৌশল
অনিকেত চক্রবর্তী
আমাদের পার্টির বিরুদ্ধে যে এইভাবে আক্রমণ হবে, তা আমরা জানতাম ২০০৬ সালেই। আজকে, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরেই যেভাবে আমাদের পার্টিকে আক্রমণ করছে শ্রেণীশত্রুরা, সেই কৌশলের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল তো ২০০৬ সালেই।
মনে করুন সেই সময়কার কথা। বিধানসভা নির্বাচনের ফল বের হলো। বিপুল জয় বামফ্রন্টের।
খুশি মানুষ। যারা চেয়েছিলেন সপ্তমবার বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। তখনই আমরা দেখেছিলাম, খুশি এমন কিছু মহলও, যারা শ্রেণীগত অবস্থানে আদৌ বামফ্রন্টকে চান না।
সেই মহলগুলিই খুশি খুশি হয়ে বাজারে সেই সময় বামফ্রন্টের জয়ের কারণ হিসাবে একটা তত্ত্ব ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
আমরা যখন বামফ্রন্টের সেই জয়ের কাণ্ডারী হিসাবে সাধারণ মানুষকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলাম, যখন বলেছিলাম বামপন্থীদের নীতি-আদর্শ, সাধারণ মানুষের প্রতি বামফ্রন্ট সরকারের দায়বদ্ধতার নীতিই বামফ্রন্টের এমন জয়কে সম্ভব করেছে, তখন শ্রেণীগত অবস্থানে আমাদের পার্টির বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ওরা বলতে শুরু করেছিল জয়ের জন্য ব্রান্ডের কথা।
বামপন্থী ব্র্যান্ড নয়। ব্যক্তিগতভাবে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ব্র্যান্ড আখ্যা দিয়ে ওরা ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছিল বামফ্রন্টের এমন বিপুল জয়ের কারণ এই ব্র্যান্ড!
তখনই আমরা টের পেয়েছিলাম, বামফ্রন্টের এমন বিপুল অগ্রগতি আসলে সত্যিই ওদের পছন্দ নয়। বরং ঘোর বিপদ দেখছে ওরা। ফলে, এই অগ্রগতিকে ঠেকাবার জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসাবেই ওরা ব্র্যান্ড তত্ত্বের আমদানি করেছে। ধরেছে বন্ধু-ছদ্মবেশ।
এই কৌশলের মূল কথা কী?
যখন দেখছো, তোমার শত্রুর সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছো না তুমি, কেন না, প্রচুর মানুষ তোমার শত্রুর নীতি-আদর্শের সঙ্গে আছে, তখন আগে নীতি-আদর্শের প্রশ্নকে একদম আড়ালে ঠেলে তোমার শত্রুর একটা ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করো। বিপুল প্রশংসাবাণী দিয়ে সেই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এমনভাবে তৈরি করো, যাতে মানুষ যেন নীতি আদর্শ কাজ এসব নয় — সেই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতেই অভ্যস্ত হয়। সেই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে ঘিরেই যেন সমস্ত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন যাবতীয় কিছু আবর্তিত হয়, তৈরি হয়, জমাট বাধে। যেন মানুষ মনে করতে শুরু করেন, বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, কোনও লড়াই আন্দোলনের ময়দান নয়, কোনও আদর্শবোধ নয়, একজন মানুষই শুধু পারেন, শুধু তিনিই পারেন মানুষের যা কিছু আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন তা মিটিয়ে দিতে, তা রূপায়ণ করতে।
এই কৌশলের দুটো দিক আছে।
বিশেষ করে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারে। একটা দিক হলো, সরকার চালাক বা না চালাক, বামপন্থীরা যেহেতু সব সময় সাধারণ মানুষকে নিয়ে লড়াই আন্দোলন সংগ্রামের ময়দানেই অবতীর্ণ হয়, তাই সাধারণ মানুষকে আন্দোলন সংগ্রামের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা। যাতে শাসকশ্রেণীর জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মানুষ যূথবদ্ধ হতে না পারেন। জোট বাধার ইচ্ছা যাতে না জাগে। অন্যদিকটি হলো, নীতি-আদর্শ-লড়াই সব কিছু বাদ দিয়ে কোনও বিশেষ ব্যক্তি, তিনি যদি বামপন্থী নেতাও হন, তাকে ঘিরেই জনমানসের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গড়ে তুলতে পারলে, ভবিষ্যতে সুযোগ বুঝে কোনও এক প্রতিকূল সময়ে সেই ব্যক্তিকেই এমনভাবে আঘাত করা যাতে মানুষের মনে হয় বিপর্যয়ের জন্য এই ব্যক্তিই দায়ী, এরজন্যই এমন প্রতিকূল সময়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে মানুষকে।
এতে সফল হতে পারলে এতদিন যে মানুষগুলির বিশ্বাস তৈরি করা হয়েছিল ব্যক্তিটাকেই ঘিরে, সেই মানুষগুলিকে এক-ঝটকায় আশাহত করে দেওয়া যাবে। তারা এমনকি নিজেদের উপরও বিশ্বাস হারাবেন। অন্যদিকে ব্যক্তিটিকেও শেষ করে দেওয়া যাবে। সেই সঙ্গে তাঁর দলের নীতি আদর্শ সব কিছু ঘিরেই এরপর প্রশ্ন তুলে দলটাকেও আঘাত হানা যাবে।
কমিউনিস্টদের প্রতি আক্রমণ হানতে, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বুর্জোয়া শিবির ঠিক এই কৌশলেরই নতুন করে সূচনা করেছিল ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর।
বামফ্রন্টের জয়ের পর কিছু বুর্জোয়া মিডিয়া খুশির অভিনয় করে ব্যক্তি হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেই ‘ব্র্যান্ড’ হিসাবে হাজির করেছিল ‘বামফ্রন্টের জয়ের কাণ্ডারী’ হিসাবে। অস্বীকার করেছিল মানুষের ভূমিকা, আন্দোলন সংগ্রামকে।
২০০৯ সালে আজ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বার হওয়ার পর সেই মিডিয়া মনে করছে সুযোগ বুঝে কোনও প্রতিকূল সময়ে ব্র্যান্ডকেই আক্রমণ করার মাহেন্দ্রক্ষণ এবার উপস্থিত। অতএব, অতীতে কোনও সময়ে কোনও সাংবাদিক বৈঠক বা অনুষ্ঠানে হাওয়ায় উড়ে যাওয়া মাথার চুল ঠিক করতে মাথায় হাত দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর তুলে রাখা ছবি এখন কাগজে ছেপে কিংবা চ্যানেলের পর্দায় দেখিয়ে ‘ব্র্যান্ড’কে কাঠগোড়ায় তুলছে সেই মিডিয়া। নির্বাচনী ফল বের হওয়ার পরবর্তী দিনগুলিতে এপর্যন্ত সংবাদপত্রের খবরগুওলি খেয়াল করুন।
এইসব মিডিয়ার একসুরে একযোগে একটাই রা। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আক্রমণ। এরা হয়তো মনে করছে ‘ম্যানু্ফ্যাকচারিং কনসেপ্ট’ অনু্যায়ী যে কৌশল নিয়েছিল ওরা, ২০০৬ সালে, এই তিনবছরে হয়তো তা সফল হয়েছে। ওরা ভাবছে, হয়তো একজন ব্যক্তিকেই ঘিরে সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলা গেছে। ভাবছে, অতএব এখন এই ব্যক্তিকে আক্রমণ করে জনমানসকে আশাহত করে দেওয়া যাবে।
তাই ওদের নিশানা এখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সঙ্গে নিশানা আমাদের পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতও।
ওদের হিসাব যে ভুল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কেউ ব্র্যান্ড হননি। আমাদের কর্মীরাও আন্দোলন সংগ্রাম নীতি আদর্শ বাদ দিয়ে কোন ব্র্যান্ড মুখাপেক্ষী হননি।
লোকসভা ভোটে হয়তো আসন কমেছে। কেমনভাবে কমেছে, কী কারণ, এজন্য কী করতে হবে, তার দিকনির্দেশ নিশ্চয়ই বামপন্থী নেতৃত্ব অচিরেই দেবেন আমাদের সামনে। কিন্তু যে বিপদ সম্পর্কে সজাগ থাকা দরকার এই সময়ে, তা হলো আমাদের পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্ব সম্পর্কে এভাবে আক্রমণ কেন শানাচ্ছে আমাদের শ্রেণীশত্রুরা।
এর কারণ হলো, দেশের বামপন্থীরা সংসদে মাথাগুনতির সংখ্যায় যতই ৬০ থেকে কমে এক-তৃতীয়াংশ হোক, যতই ভোট কমুক না কেন, বামপন্থীরা বা তাদের ভূমিকা এই দেশ থেকে এই ভোটের পরেই উধাও হয়ে গেল, এমনটি আদৌ মনে করছে না আমাদের শ্রেণীশত্রুরা। ভোটে আসন সংখ্যা কমতেই বামপন্থীদের গণ-আন্দোলনের ময়দান ছোট হয়ে যাবে, এমনটি মনে করছে না আমাদের শ্রেণীশত্রুরা।
এবারের সংসদে বামপন্থীরা তেমন সংখ্যায় নেই বলে যতই উল্লাস করুক অবামপন্থীরা, ওরা জানে যারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলো, তারা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী যে পদক্ষেপই নিক না কেন, সংসদের ভিতরে আগের তুলনায় কম সাংসদ থাকলেও বামপন্থীরা যেমন লড়াই চালিয়ে যাবেন, সংসদের বাইরে লড়াইয়ের ময়দানেও বামপন্থীরা সমবেত করবেন মানুষকে। যেখানে মানুষের জড়ো হওয়া ভোটের ফলের উপর তেমন নির্ভর করে না। আগের বার বামপন্থীরা সংসদে বাধা দিয়েছে বলে শাসকশ্রেণী যেসব পছন্দের পদক্ষেপ নিতে পারেনি, এবার সেসব নেওয়া যাবে বলে যতই মুখে বলুক, ওরাও জানে বামপন্থীরা বাধা দেবেই। অতএব, বামপন্থীদের সংগঠন ও মনোবলকে দুর্বল করার দুরাশাতেই এখন আক্রমণ করা হচ্ছে প্রকাশ কারাত থেকে শুরু করে বেছে বেছে শীর্ষ নেতৃত্বকে। কমিউনিস্ট পার্টি, তার সংগঠন, যৌথ সিদ্ধান্ত, যৌথ দায়িত্ব এসব রীতিনীতি সব গুলিয়ে দিয়ে যে আক্রমণ করা হচ্ছে, তার লক্ষ্য শুধু মানুষকেই বামপন্থীদের সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা নয়, কর্মীদেরও মধ্যে হতোদ্যম তৈরি করা।
তাতেও লাভ শ্রেণীশত্রুদের।
মনে রাখা উচিত, এমন আক্রমণ এর আগেও হয়েছে। যখন জ্যোতি বসু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এই মিডিয়া জ্যোতি বসুকেই পার্টির মধ্যে ‘একমাত্র বাস্তববাদী’ বলে প্রচার চালাতো অহরহ। পার্টির বাকি নেতৃত্ব, কর্মীদের সাংগঠনিক দক্ষতা, মানুষের ভালোবাসা এসবকে আড়াল করে শুধু জ্যোতি বসুকেই ‘একমাত্র বাস্তববাদী’ বলে প্রচারের পিছনেও ছিল একই কৌশল। পারেনি ওরা তবুও।
এই কৌশল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময় আরো বাড়ল ২০০৬-এর পর। কারণ ২০০৪ সালে দেশে বামপন্থী সাংসদ সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছিল, ২০০৬ সালে উল্লেখযোগ্য জয় পেলো এরাজ্যের বামফ্রন্ট। এতেই প্রমাদ গুনে পুরানো কৌশলকে নতুন করে আরো ভয়ঙ্করভাবে তুলে ধরলো তাই শ্রেণীশত্রুরা। এখন ওরা মনে করছে সফল!
কে বোঝাবে ওদের, ভোটে হারা জেতাই যদি সব কিছু বা শেষ কথা হতো, তা’হলে গণ-আন্দোলনে চড়াই-উতরাই বা বাঁক-মোড় বলে কোনও শব্দ থাকতো না, ১৯৬৭-৬৯ বা ১৯৭১-’৭২-এর পর ১৯৭৭ সালও আসতো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।