প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে আমার প্রাতিষ্ঠানিক বা অ-প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই। এই বিষয়ে আমি কোন অবস্থাতেই বিশেষজ্ঞ নই । তবুও বিষয়টা নিয়ে লিখছি- শ্রেফ কমন সেন্স ও অভিজ্ঞতা ভিত্তি করে। আর বলে রাখা ভালো, ভূগোল সম্পর্কে আমার জ্ঞান এতোটুকুই যে, পৃথিবী গোল কিন্তু কমলালেবুর মতো এর দুইদিকটা চাপা। কাজেই আমার এই লেখা কারও মতের সাথে মিললে ভালো, না মিললেও কোন ক্ষতির আশংকা দেখি না।
কখনো ফারাক্কা, কখনো টিপাইমুখ কিংবা নির্বাচনের আগে ভারত যেকোনভাবে হোক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। বর্তমানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যে সংকট, এতেও ভারত এখন আ/সমালোচনার শীর্ষে।
আমি গোটা ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে চাই কয়েকটি দৃষ্টিকোন থেকে .. ..
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের তুমুল সহযোগিতা সত্ত্বেও অধিকাংশ বাঙালিই ভারত বিদ্বেষী। আশ্চর্য হলেও এটাই সত্য। এর কারণ কী ? ভারতবিদ্বেষী হওয়ার সবচেয়ে বড়ো কারণটা খুবই মজার।
বড়লোকের অনেক বন্ধু থাকে, থাকে আশ্রিত ও করুণাপ্রার্থী আত্মীয়, স্তাবক, কর্মচারী । কিন্তু এরা কেউই বড়লোককে পছন্দ করেনা। এর মূলে আছে ঈর্ষা। বড়লোক হতে না পারার ঈর্ষা, বড়লোকের মতো সফল হতে না পারার ক্ষোভ এবং বড়লোকের কাছে কিছু চেয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্য না পাওয়ার জ্বালা- ঘৃণাটা সব মিলিয়েই।
ভারত সম্পর্কে আমাদের দ্বিতীয় অস্তস্তির কারণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার জন্য যে কেবল জামায়াত ইসলাম অস্বস্তিতে ভোগে তা নয়, অনেক প্রগতিশীলেরও এই বিষয় নিয়ে শির:পীড়া আছে। মুক্তিযুদ্ধের এই গৌরবময় কৃতিত্ব নিতে গেলে ভারতের নামটি চলে আসে। আত্মতৃপ্তির জায়গাটি আর একান্তই একক হয়ে উঠতে পারে না। এটি খুবই যন্ত্রণাকর একটি ব্যাপার। আর বাঙালি জাতির জন্য কৃতজ্ঞতার চেয়ে বড়ো বোঝা আর নেই।
বাংলাদেশের ম্যাপটার দিকে তাকালে দেখা যায়- এটি আক্ষরিক অর্থেই ভারতবেষ্টিত। কিন্তু ভারতের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য আকাশ পাতাল। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা কিংবা নিছক চলচ্চিত্র- যাই বলুন না কেন। চোখের সামনে বাংলাদেশের গতি নিম্মমুখী, ঠিক একই চোখজোড়ার সামনে ভারত ধাই ধাই করে উপরে উঠে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা কোন বাঙালির পছন্দ হবার কথা নয়।
পর পর দুইবার সোনিয়ার নেতৃত্বে বিজয় এলেও সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হোন না, ওদের ১৯ জনের মন্ত্রিসভায় সোনিয়াপুত্র রাহুলের নাম থাকেনা। আমাদের গণতন্ত্রে এটি ব্যাঙের সর্দিরই মতোই অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার।
বাঙালি যে দুটি রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে- সেই দুটি রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত এবং আমেরিকা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার অধিকাংশের ড্রয়িংরুমেই হিন্দি চ্যানেল চলে এবং অধিকাংশ বাঙালিই আমেরিকার ভিসাকে স্বর্গের চাইতে বেশি লোভনীয় মনে করে। আমি নিশ্চিত আমেরিকার বর্ডার বাংলাদেশের জন্য ২৪ ঘন্টার তরে খুলে দিলে পরদিন অফিস আওয়ারে মতিঝিলের রাস্তায় ক্রিকেট খেলা যাবে।
ভারত এবং আমেরিকা ছাড়া আমাদের চলে না, চলবেও না।
আমেরিকার কথা এইখানে বাদ দিই, এটা বর্তমান লেখার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। ভারতের ব্যাপারটাতেই থাকি।
ভারতের সাথে আমাদের যাবতীয় সমস্যার মূলে আছে , আমাদের এই মনোভাব। আমাদের জন্য ভারত কোনো সমস্যা নয়, আমরাই আমাদের সমস্যা।
টিপাই বাঁধ নিয়ে জোরেশোরে কোলাহল শুরু হয়েছে। টিপাই একটি ভয়াবহ সমস্যা সন্দেহ নেই। এর কূটনৈতিক সমাধান আছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোন কূটনৈতিক সমাধানে এক্ষেত্রে আসতে পারবে না। অতীতে যেমন পারেনি, ভবিষ্যতেও না।
যোগ্যতার ভিত্তিতে দক্ষ কোন ব্যক্তিকে আমাদের দেশে নিয়োগ দেয়া হয় না। ফরেন পোস্টিংয়ের মতো লোভনীয় পদে দলীয় বংশবদ এবং প্রিয় মানুষরাই স্থান পায়। কাজেই অতীতেও দেখেছি যেকোন দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ভারত যান, দক্ষতার অভাবে যৌথ আলোচনায় যুক্তি ও সঠিক তথ্য এবং কূটনৈতিক প্যাঁচ দিয়ে কোন কথা বলতে পারেন কিনা সন্দেহ, কিন্তু আসার সময় মায়ের জন্য কাশ্মীরী শাল আর বউয়ের জন্য গড়িয়াহাটার শাড়ি নিয়ে দেশে ফেরেন।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমরা রাতারাতি বেশ পরিবেশ সচেতন হয়ে গেছি। চোখের সামনে বুড়িগঙ্গাটাকে শেষ করলাম আমরা।
নদী দখল করে আবাসন প্রকল্প হচ্ছে, কারখানার বর্জ্য ফেলছি নদীতে , আমাদের নিজেদের তৈরী পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আমাদের জাতীয়তাবাদী আবেগ ফুলে ফেঁপে ওঠে না। গোটা দেশটা যে পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে মরুভূমিক হয়ে উঠছে- এতে ভারতের দোষ কতটুকু আর আমাদের দোষ কতটুকু?
কাজেই টিপাই নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার মূল কারণ কোনটি? পরিবেশ বিপর্যয় না ভারত বিরোধিতা ?
এই দুইটি কারণেই আমার মনে হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বঙ্গীয় কোলাহল তেমন কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে না।
এটি আন্তজার্তিক রাজনীতি নয়, বরং বঙ্গীয় রাজনীতির প্যাঁচেই খেলতে থাকবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।