আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অশনি সন্ধ্যা

www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
নাম নাই। রাস্তা একটা। গলি বলাই ভালো। খুব্‌লে খুব্‌লে খাওয়া তার পৃষ্ঠভাগ। উপর দিয়েই পরিশ্রান্ত কিন্তু অবিশ্রান্ত ভাবে চলে লোহা-লক্কর সদৃশ বাহন।

টেনে নেয় আর টেনে নিয়ে যায় মনুষ্য সদৃশ জীব। ক্রিং-ক্রিং, ঠন্‌-ঠন্‌, ঠাস্‌-ঠাস্‌। চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যাওয়া শাব্দিক বিশৃঙ্খলা। থিতু হয় সহ্যের পরিসীমায়। নাকি উল্টোটা? ঘষা খেতে খেতে পথের উপর-নিচে পঙ্গপালের মতন ছুটে চলে পথচারী।

কিন্তু হায় পতঙ্গ সদৃশ শৃঙ্খলা! দুইপাশে দুই কাঁচা-বাজার। সন্ধ্যায় ক্লান্ত মানুষ খুঁজে ফিরে রাত্রির আহার্য। পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে। চেখে দেখে পানি ছিটিয়ে মাছি তাড়ানো মাছের গন্ধ। আর শাক-পাতা-সবজী? হ্যাঁ, ওগুলো কিন্তু চাই টাটকা, তরতাজা, সদ্য আর ঝরঝরে।

হিমায়িত চাই না গোস্ত। ওগুলো চাই কাঁচা আর সতেজ। রক্ত ঝরুক। কিন্তু হতেই হবে কচি। পেলবতার অনুভূতি চাই মুখে দেয়া মাত্র।

রাত্রির আহার্য। খুঁজে পেতেই হবে। সময় যায়। শাব্দিক বিশৃঙ্খলা চারপাশে। ক্রিং-ক্রিং, ঠন্‌-ঠন্‌, ঠাস্‌-ঠাস্‌।

কিন্তু নিস্তার নেই। চোখে মুখে বিরক্তি আর প্রত্যাশার কি এক অপূর্ব সংমিশ্রণ! জৈবিক আকাঙ্ক্ষার কি ব্যাপ্তি! মনুষ্য মহাসমুদ্র ছাড়িয়ে, এত এত হট্টগোল এড়িয়ে, বাজারের ব্যতিব্যস্ত আলো হতে একটু দূরে, কুপি আর হারিকেনের আলোয় আলোকিত দুইজন বালক-বালিকা। ভ্রাতাটি অতি ব্যস্ত বোঝা গেল কেরোসিনের বোতলটি হাতে। ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে ত্রি-চক্র যানগুলোর চারপাশে। ‘ওই ক্যারাসিন... ক্যারাসিন লাগবো...’।

‘হ...আয়...কত কইরা রে’। যতই হোক। বালকের পোড় খাওয়া কঠিন মুখটায় হঠাৎ বালখিল্যতা। স্বস্তির ঝিলিক। কেরোসিন ঢুকে যাচ্ছে।

আস্তে আস্তে। ‘অই...ঠিক মত দিস কইলাম...ট্যাকা কিন্তুক তোর বাপের লয়’। হ্যাঁ, ঠিক মতই দিচ্ছে সে। তাই আস্তে আস্তে। মনোযোগ দরকার।

দরকার রাত্রির আহার্য। সে চেখে দেখেছে পানি ছিটিয়ে মাছি তাড়ানো মাছের গন্ধ। ওইটুকুই। উচ্ছিষ্টান্ন হলেই চলবে। আর শাক-পাতা-সবজী? দরকার নাই টাটকা, তরতাজা, সদ্য আর ঝরঝরে।

নিষ্প্রাণ ডাঁটাগুলো যা মজার না! আর গোস্ত? আরে সেটা তো গতরাতেই...। হোক না স্বপ্ন। ভরে গেছে হারিকেন? না আরেকটু। মনোযোগ দরকার। খুব মনোযোগ।

‘ও বাই...বাই। ও বাইয়া...দ্যাখ্‌...আমি কি সুন্দর দড়ি খ্যালতে পারি’। না তাকানো যাবে না। নষ্ট হবে কেরোসিন। ফুটফুটে ছেঁড়া ফ্রক পড়া এক বালিকা ছোট্ট একটা দড়ি হাতে যতই বৃথা দৌড়ে বেড়াক না কেন, তাকানো যাবে না।

বড় করতে হবে ওকে আগে। ওকে নিয়েই তো সব চিন্তা। হ্যাঁ, বিয়ে দেবে সে তাকে। এইটাই বড় চিন্তা। তার আগে তাকে বাঁচাতে হবে চারপাশের খুপড়িগুলোতে ওঁৎ পেতে থাকা বিষাক্ত আর লোলুপ দৃষ্টিগুলো থেকে।

বড় হচ্ছে তো ও। ভ্রাতাটি সব জানে। চিন্তাশীল সে। বুঝে গেছে সব। অচপল হয়ে গেছে তাই।

এটাও জানে কি ভয়ানক সময় আসছে সামনে। তাই তাকানো যাবে না। কেরোসিন ফেলা যাবে না। প্রতিটা ফোটার মানে আছে ওর কাছে। প্রতিটা ফোটার।

কেরোসিন ঢুকে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে। আর শাব্দিক বিশৃঙ্খলা চারপাশে। ক্রিং-ক্রিং, ঠন্‌-ঠন্‌, ঠাস্‌-ঠাস্‌। আর মনুষ্য মহাসমুদ্রে জৈবিক আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।