আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন আল্পস এ... (কথা কম ছবি বেশি টাইপ ব্লগ)



গতবছর জার্মানির যে স্হানে একটা ট্রেনিং করছিলাম আমরা সেখানে ধুধু মাঠের ওপাশে দুরে দেখা যেত বরফাচ্ছন্য আল্পস পর্বতমালা। এই আল্পস কে বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন আলপাইন, আলপি, আলপে ইত্যাদি। এক রবিবার ঠিক করলাম আমরা পাহাড় দেখতে যাব, সঙ্গি হিসাবে আরো কয়েকজন কলিগ কে পটায়ে ফেললাম খুব অল্প সময়ের মধ্যে। ওখানকার একজন ট্রেইনার জানাল যে ট্রেনে করে গারমিস-পার্টেনকিচেন জেতে হবে, নামও লিখে দিল কারন অনেক চেষ্টার পরেও আমাদের উচ্চারনটা নাকি সঠিক হচ্ছে না, যাই হোক নাম সম্বল করে সাত সকালে হাজির হলাম ট্রেন স্টেশনে আমরা কয়েকজন। স্টেশনে এসে কাউন্টারে নামটা দেখিয়ে বললাম আমাদের রিটার্ন টিকেট লাগবে, ভদ্রলোকের ইংরেজির দৌড় খুব বেশি দুর না, কথাবার্তা আমরাও বুঝি না, সেও বুঝে না, আকারে ইঙ্গিতে বোঝালাম আমরা সবাই কাগজে লেখা জায়গায় যেতে চাই।

লোকটা একটা কাগজে ভাড়া লিখে আমাদের দেখিয়ে টিকেট না দিয়ে অভদ্রের মত প্লাটফরম দেখিয়ে দিল কি যেন বলতে বলতে। মহা ঝামেলা, আমরা টাকা বের করে আবার বুঝালাম টিকেট দাও, সে হাসি মুখে আবার দেখিয়ে দিল প্ল্যাটফরম, আমাদের তো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। আমাদের একেকজন একেক ভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল, আমিতো বলেই বসলাম ট্রেন আসলে টিকেট দিবে বোধহয়। যাইহোক অনেক চেষ্টা করেও আমাদের বোঝাতে না পেরে এইবার উনি অফিস থেকে বের হয়ে আসলেন, আমরা তার সাথে প্লাটফরম এর দিকে হাঁটা দিলাম, উনি যেয়ে থামলেন একটা কিয়স্ক এর সামনে, এইবার বুঝলাম যে আমাদের আসলে মেশিন থেকে টিকেট কাটতে হবে। উনি বিভিন্ন অপশন টিপেটুপে আমাদের টাকাটা মেশিন এ ঢুকিয়ে দিলেন, বের হয়ে আসলো একটা গ্রুপ টিকেট, দেখি দাম প্রায় অর্ধেক কাউন্টারে যে দাম তার থেকে।

সবাই আমরা এইবার বলা বলি করলাম আহারে কি দেশ, মেশিনে টিকেট কাটলে যে আমাদের টাকা কম লাগবে এইটা বেচারা কত কষ্ট করেই না আমাদের বোঝাতে চাচ্ছিল (জার্মানি তে অনেক ভাল ব্যাবহার পেয়েছি মানুষের কাছ থেকে, ইটালিতে ঠিক উল্টা চিত্র, পরে হবে সে কাহিনী )। যাইহোক চলতে লাগলো ট্রেন, আমরা যাচ্ছি ফাঁকা প্রান্তর এর মাঝ দিয়ে, মাঝে মাঝে চোখে পড়ে ছোট্ট কোন শহরতলি। দুরে দেখা যায় ঘোড়ার পাল চরে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ দেখি আমাদের ইরাকি বন্ধু খুবি উত্তেজিত ভাবে জানালা দিয়ে ছবি তুলছে, চেয়ে দেখি গরুর পাল। ব্যাপার কিছুই না, ওর বাচ্চাকে ছবি দেখাবে, কারন ওখানে সবাই বিফ খায় কিন্তু গরু দেখেনি সে কখনো । গারমিস পৌঁছে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামনে দেখি বিশাল সাইনবোর্ড লাগান এক বিল্ডিং, একপাশে জুগসপিট পাহাড়ের ম্যাপ আঁকা, এখান থেকে ট্রামের মত এক ট্রেনে করে পাহাড়ে উঠা শুরু হবে, আমরা টিকেট করে প্লাটফরমে এসে দাড়ালাম।

জুগসপিটবান নামের এই ট্রেনের কারিগরি নাম কগ হুইল ট্রেন, আমাদের ট্রেনের মতই দুইপাশে চাকা- কিন্তু মাঝখানে আবার আরেকটা দাঁতওয়ালা গিয়ারের মত চাকা আছে, দুই লাইনের মাঝখানে খাঁজ কাটা কাটা আরেকটা লাইন ঐ চাকার জন্য। জুগসপিটবান ও আমি: আমরা উঠছি জুগসপিট পাহাড়ে, এটা জার্মানির সবচেয়ে উচু পিক, প্রায় ১০,০০০ ফিট (২৯৬২ মিটার) উচ্চতা। আস্তে আস্তে সবাই ব্যাগ থেকে গরম কাপড় বের করা শুরু করেছি আমরা। একটু পরে বাইরে দেখি সাদা সাদা বরফ জমে আছে এখানে সেখানে (তখনও সমতলে বরফ পড়া শুরু হয়নাই)। মাঝে মাঝে ট্রেন উপরে উঠছে শামুকের গতিতে মাটি কামড়ে কামড়ে, কখনো বা পাহাড় কেটে বানানো টানেলের ভেতর দিয়ে।

মাঝে অনেক গুলি স্টেশন পড়লো, মানুষজন স্কি এর সরন্জাম অথবা ব্যাকপ্যাক নিয়ে নেমে যাচ্ছে, বুঝলাম ট্রেকিং ও স্কিয়িং এর জন্য উনারা এসেছেন। ২৬০০ মিটার উচ্চতায় এক সময় পৌছালাম শেষ স্টেশনে, চারপাশ দেখে এরি মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে, এ আমি কোথায় আসলাম, এটাকি স্বপ্ন! চারিদিকে মেঘের ভাজে ভাজে পাহাড়ের চুড়া, উপরে গাড় নীল আকাশ..... বেশ কিছুক্ষন গ্লেসিয়ার এর মধ্যে বরফ নিয়ে দাপাদাপি করলাম। সবাইমিলে চেষ্টা করলাম একটা তুষারমানব বানানোর, কিন্তু খালি হাতে সম্ভবনা বুঝলাম কিছুক্ক্ষন পরেই যখন দেখি হাতে কোন অনুভুতি নাই, সবাই তখন আমাকে বরফের ঢিপি তে বসিয়ে মাথায় একটু বরফ দিয়ে বরফ মানব (বরফ সহ মানব) বানানোর কাজটা সর্টকাটে শেষ করলো। দুরে দেখি আরেকদল সুন্দর একটা তুষারমানব বানাচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে এরা কাঠমিস্ত্রি ছিলো। বরফমানব: এরি মধ্যে পেট মোচড় দেয়াতে সবাই "সোন আলপেন ২৬০০মিটার" রেষ্টুরেন্টের খাবারের লাইনে যেয়ে দাড়ালাম, ভেতরে ও বাইরে খোলা যায়গায় খাওয়ার ব্যাবস্হা আছে।

বাইরে বেশ ঝলমলে রোদ থাকাতে আমরা খাবার নিয়ে বাইরে চলে আসলাম। ঠান্ডার মধ্যে রোদে বসে চারিদিকের অপার সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে খেতে থাকলাম। ক্লিনিং করার মহিলা দেখি পর্যটকদের অভুক্ত আলু ভাজা কাকদেরকে খেতে দিচ্ছে, বেশ মজা লাগলো ভদ্র টাইপের চকচকা বিলাতি কাক গুলাকে দেখে। সোন আলপাইন ২৬০০মি ক্যাফে: কাকের লাঞ্চ: বিলাতি কাক: এখান থেকে আমাদের বাকিটা উঠতে হবে কেবলকারে। এই কেবলকার মালয়শিয়া বা নেপালের টার মতো ছোট্ট না, বিশাল কাচের ক্যাপসুল লিফটের মতো ঘর ভেতরে বাসের মত আবার কিছু সিট আছে, একসাথে প্রায় ২০ জন মত উঠে পড়লাম।

আস্তে আস্তে উপরে উঠতে থাকলাম, বেশ কিছুক্ষন পর পৌছালাম উপরে, একটা বিশাল রেলিং দেয়া প্ল্যাটফরমে। রাজ্যের এন্টেনা আর আবহাওয়া মাপার যন্ত্রপাতিতে ছাদ ভর্তি, জায়গায় জায়গায় দুরবিন আছে, পয়সা (১ ইউরো) ফেললে বেশ কিছুক্ষন দেখা যায় ওটা দিয়ে, কিন্তু মাথার ভেতরে সর্বক্ষন "ইউরো টু টাকা কনভার্টার" চালু থাকায় ওমুখো হলাম না আর। রেলিং এর পাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য। বেশ কিছুদুরে দেখা যাচ্ছে আরেকটা পাহাড়ের পিক, উপরে একটা সোনালি স্তম্ভ, জানলাম ওটাই জার্মানির সবচেয়ে উচু পয়েন্ট, ২৯৬২মিটার উচ্চতা, আমরা যেখানে দাড়িয়ে তা কিছুটা কম। কিছু মানুষ পাহাড় বেয়ে বেয়ে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে ওখানে যাচ্ছে, রাহাত ভাই বা সৌম্য সাথে না থাকায় আমি আর সাহস করলাম না, কাপড় চোপর ও উপযুক্ত ছিল না।

২৯৬২ মিটার: আগেই ঠিক করেছিলাম ভিন্ন পথে নামব ফেরার সময়, আরেকটা দীর্ঘ কেবলকার দেখেছি ম্যাপে সেটাতে করে। ঘুরে ঘুরে দেয়ালে সাইন দেখে খুঁজে বের করলাম কেবলকার স্টেশন। এতক্ষন সবকিছু ভালই ছিল, এইবার বাধলো ঝামেলা, টিকিট ঘসা দি কিন্তু দরজা খুলে না, সবার টিকেটেই একি অবস্হা। নানা ভাবে নানা দেশি কায়দায় ঘসা হলো, তাও খুলে না। ওদিকে আমাদের আশপাশ দিয়ে মানুষজন দিব্যি টিকিট ঘসে পার হয়ে যাচ্ছে, আমাদের সন্দেহ হলো যে আমরা যেটাকে রিটার্ন টিকিট ভাবেছি তা আসলে ওয়ানওয়ে, কিন্তু তাও তো হওয়ার কথা না, এদিক ওদিক চেয়ে দেখি কাচের ঘরের ভেতরে এক যুবক বসে মিটিমিটি হাসছে আমাদের দিকে তাকিয়ে, ভুরু কুচকে তার দিকে টিকেটটা দেখাতেই সে একটা ছোট্ট জানালা খুলে বললো "দ্যাটস এ জার্মান টিকেট মাই ফ্রেন্ড, উই আর ইন অস্ট্রিয়া"।

আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম অবস্হা, আমরা নাকি না বুঝে অস্ট্রিয়া চলে এসেছি, কি আর করা উল্টা দিকে হাটা দিলাম, ঔ কেবল কার টা নেমে গেছে অস্ট্রিয়ার টাইরল নামক অঞ্চলে। একটু পরে একটা গেট পার হয়ে ঘুরে দেখি লেখা "ওয়েলকাম টু টাইরল" বুঝলাম এইটাই বর্ডার। প্ল্যাটফরম এর দুইদিকে দুই দেশের পতাকা দেখে বুঝলাম এই ফ্যাসিলিটি দুইদেশের মাঝে যৌথ ভাবে তৈরী। আবার শুরু করলাম ফটো সেশন, অস্ট্রিয়া তে ছবি তুলা বলে কথা। অস্ট্রিয়ার বর্ডার (গেট এর ঐ পাশে অস্ট্রিয়া): এইবার পতাকা দেখে দেখে কেবলকার খুঁজে বের করলাম, এই কার টা আগেরটার মতো বিশাল না কিন্তু যখন টাওয়ার গুলা পার হয় তখন কয়েক মুহুর্ত ফ্রি-ফল হয়, প্রথম প্রথম তেমন বুঝতে পারি নাই, ঝাকির সাথে সাথে শুধু শুনি পাশের কয়েকটা চাইনিজ মেয়ের চিৎকার, গতি বাড়তে আমরাও দেখি গলা দিয়ে সামান্য চিৎকার বের হয়ে আসছে, পেটের মধ্যে প্রজাপতি উড়ার অনুভুতি।

নিচে দেখা যাচ্ছে নীলাভ ইবসি লেক। ইবসি লেক: আরো বিস্তারিত যানতে দেখুন: http://www.zugspitze.de

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.