১. সামনে অন্ধকার। উদ্বিগ্ন মানুষ। শেষ পর্যন্ত সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনে যাচ্ছে সরকার। বিরোধী দল বলেছে এ নির্বাচনে যাবে না। সরকার আলোচনার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তারা এবার কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছে। আন্দোলনেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়। সংসদ বহাল রেখে বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত তারা মানবেই না। ফয়সালাটা তাহলে রাজপথেই ঘটতে যাচ্ছে। রাজপথে ঘটতে যাওয়া মানেই সংঘাত অনিবার্য। সংঘাত মানেই সহিংসতা। রক্তপাত। মায়ের বুক খালি হওয়া। পিতাহারা সন্তানের সামনে বা সন্তানহারা ছেলের কফিনের পাশে মা-বাপের বিলাপ। এই রাজনীতি যারা চাননি তারা বলেই চলেছেন- সংলাপ, সংলাপ এবং সংলাপ। সমঝোতা, সমঝোতা এবং সমঝোতা। সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় এসে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব মহলই নয়, পশ্চিমা দুনিয়াই নয়, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক শক্তিই নয়, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন পর্যন্ত দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সংলাপের মাধ্যমে সমাধান ও সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের কথা বলেছেন। সেই সংলাপ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনের পথে যেতে বলেছেন। জানুয়ারিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করে তিনি এখন নৌকায় ভোট চাইতে সারা দেশ সফর করছেন। বিরোধী দল নির্বাচনী প্রচারণা থেকে মুখ ঘুরিয়ে একতরফা নির্বাচন রুখে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আদায়ের আন্দোলনে নামছে। রাজনীতি ফের অশান্ত, অস্থির হওয়ার আলামত দেখা দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে যা ঘটেছিল তার দায় বিএনপি সরকারের ছিল। ২০০৭ সালে যা ঘটেছিল তার দায়ও বিএনপি-জামায়াত জোটের কাঁধেই পড়েছিল। এবার একগুঁয়ে নীতির কারণে যা ঘটবে তার দায় মহাজোট সরকারের। কী ঘটতে যাচ্ছে এবার?
২. সেনাশাসক এরশাদের পতন ঘটিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পঞ্চম সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জাতির জীবনে গণতন্ত্রের বসন্ত এনেছিল। মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপি সরকারের ভোট ডাকাতির নজিরবিহীন ঘটনার প্রতিবাদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী সংসদের ভেতরে-বাইরে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। জনগণের সমর্থন আদায় করেছিলেন সারা দেশ সফর করে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামের তখনকার মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলনের আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ঢাকার তখনকার মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ 'জনতার মঞ্চ' করে গণআন্দোলনের জোয়ার ঘটিয়েছিলেন। সংসদ থেকে আগেই পদত্যাগ করেছিলেন তারা। হরতাল আর অবরোধের রাজনীতিতে উত্তাল বাংলাদেশে সেদিনের জনতার মঞ্চে সচিবালয়ের অফিস থেকে আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আমলাদের বড় অংশ যোগ দিয়েছিলেন সেই সংগ্রামে। সেই ইতিহাস ও পরের ঘটনাবলি সবার জানা। সেদিন বিএনপি সংবিধানের দোহাই দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে গিয়ে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি '৯৬ সাল বিরোধী দলের দাবি উপেক্ষা করে খালেদা জিয়ার সরকার একতরফা নির্বাচন করে ১৩ দিন থাকতে পারেনি ক্ষমতায়। গণআন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। '৯৬ সালের জুনের সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ২০০১ সালে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়ায় বিচারপতি কে এম হাসানের হওয়ার কথা ছিল পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। কিন্তু সেদিনের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল পরে মহাজোট আপত্তি দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রস্তাব জাতির সামনে উত্থাপন করে আন্দোলনে নেমেছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়া সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগের আন্দোলনে জ্বলে উঠেছিল বাংলাদেশ। লগি-বৈঠার অবরোধে রক্তাক্ত হয়েছিল রাজপথ। বিএনপি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরার পথে হেঁটেছিল। অবরুদ্ধ, অচল দেশে সহিংস রাজনীতির পথে ব্যাপক গণসমর্থন নিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে এসেছিল ওয়ান-ইলেভেন। নির্বাচন হয়েছিল বন্ধ। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই নেত্রীকেই নয়, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ অনেককেই হয় জেলে নিয়েছিল, না হয় দেশান্তরী করেছিল। পরিণতি কারও জন্য সুখের হয়নি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসে। রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি বিরোধী দলের ওপর অতীতের দমন-নির্যাতনের ধারাই অব্যাহত রাখেনি, আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধান থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মুছে ফেলে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের নেত্রী বলেছেন, তাদের জায়গায় তারা অনড়। আওয়ামী লীগ বলেছে, সংবিধান থেকে একচুল নড়বে না। রাজনীতিতে এখন সংঘাতের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গণ্ডগোলটা বাধিয়েছে মহাজোট সরকার। সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সমঝোতা, আস্থা ও বিশ্বাস যেখানে নির্বাসনে সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে নতুন করে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। যে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একসময় বলেছিল তাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার একদিন দুনিয়ার মডেল হবে, সেই তারা যখন অনেক দেশ এই মডেল গ্রহণ করছে তখন তা বাতিল করে দিয়েছে ব্রুট মেজরিটির জোরে। সরকারের আজ্ঞাবহ একদল বুদ্ধিজীবী ছাড়া সংবিধান সংশোধন কমিটি যাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে আদালত যেসব বিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিয়েছেন সবাই বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা দরকার। বিরোধী দল সংলাপে যায়নি। তবুও সংবিধান সংশোধন কমিটির অনেকে কাটা মুরগির মতো ছটফট আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বিল পাস করেছেন। সামনে রাজনীতিতে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার শেষ আলো দেখা না গেলে পরিণতি যাই হোক তার দায় শুধু প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগকেই নয়, দলের যেসব নেতা সংস্কারের জিকির তুলেছিলেন, যাদের হাতে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাদের কেউ সেই দায় এড়াতে পারবেন না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সেদিন পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের পক্ষে থাকা আওয়ামী লীগের মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল সবাইকেই এ দায় নিতে হবে। শুধু জাতিসংঘ মহাসচিবই শান্তি চান না। গোটা বাংলাদেশের মানুষ শান্তি চায়। সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন চায়। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল চায়।
৩. লাখো লাখো শহীদের রক্তের দাগ এই মাটি থেকে এখনো শুকিয়ে যায়নি। গণতন্ত্রের সংগ্রামের শত শত শহীদের মায়ের কান্না, বিধবা স্ত্রীর বুকের আর্তনাদ এখনো থামেনি। একতরফা বা একদলীয় এমনকি শাসকের একগুঁয়ে অন্ধ পথচলার পরিণতি জাতীয় জীবনে তো নয়ই, রাজনীতিতেও শুভ ও কল্যাণ বয়ে আনে না। বহু মানুষের রক্তে কেনা গণতন্ত্র নিরবচ্ছিন্ন রাখতে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সংসদকে কার্যকর, প্রাণবন্ত ও সব আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত করতে সরকার ও বিরোধী দলের নির্বাচনকালীন গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনই শেষ কথা নয়। সংলাপের মাধ্যমে সরকার ও বিরোধী দল সবাইকে জাতির কাছে নির্বাচন-উত্তর সরকার পরিচালনা এবং বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার রূপরেখা চূড়ান্ত করে জাতির সামনে ওয়াদা করাও সময়ের দাবি। সেনাশাসক এরশাদের পতনের আগে আন্দোলনরত তিন জোট বহু শহীদের রক্তে লেখা রূপরেখা ক্ষমতায় আসার পর ভুলে গেছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে পল্টন থেকে ১৪ দল রাষ্ট্র পরিচালনার যে ২৩ দফা অঙ্গীকার করেছিল তাও ক্ষমতায় এসে অনুসরণ করেনি। বহু শহীদের রক্তে লেখা ২৩ দফার ৬ দফায় বলা হয়েছিল দুর্নীতি ও দলীয়করণ মুক্ত শাসনব্যবস্থার কথা। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে দেওয়ার কথা। কথা রাখেনি ১৪ দল। কথা রাখেনি মহাজোট। এর আগেরবার কথা রাখেনি বিএনপি-জামায়াত জোট। কথা না রাখার রাজনীতি চলছে সমানে সমান। কেউ বেশি, কেউ কম। পার্থক্য এটুকুই। তাই সরকার ও বিরোধী দল, ছোট-বড় সব দলকেই উপলব্ধি করতে হবে সময়ের দাবি। এখনই পাঠ করার চূড়ান্ত সময় জনগণের মনের ভাষা। পল্টন ময়দান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা নয়াপল্টনের সমাবেশে মিছিল নিয়ে আসা মানুষের কথাই শেষ কথা নয়। এর বাইরে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ রয়েছে যারা পূর্বসূরিদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশকে সংবিধান, আইন, বিধিবিধানবলে জনগণকেই ক্ষমতার মালিক হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বচ্ছতা চায়। সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্বশীল রাজনীতি ও ভূমিকা রাষ্ট্র পরিচালনার পরতে পরতে উপলব্ধি করতে চায়। শাসককে প্রভুর আসনে নয়, সেবকের আসনে দেখতে চায়। বিরোধী দলকে ক্ষমতার লড়াইয়ে নয়, মানুষের ভাষায় কথা বলতে দেখতে চায়। মানুষের অধিকার নিয়ে লড়ার পথে দেখতে চায়। সর্বোপরি এই সময়ে মানুষ চায় সরকার ও বিরোধী দল যার যার অবস্থান থেকে সরে এসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন দেখতে; যেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে 'আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব' নীতিতে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে আর বড় দলগুলো তেমন প্রার্থী দেবে যাদের দেখলে বা নাম শুনলে শ্রদ্ধায় ভোটারের মাথা নত হয়ে আসে। মানুষ চায় সমঝোতার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন-উত্তর হরতাল-অবরোধের বাইরে সুশাসন ও দুর্নীতি-দলীয়করণ মুক্ত শাসনব্যবস্থা এবং সংসদ কার্যকরের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ জোট না বিএনপি জোট ক্ষমতায় যাবে-থাকবে, তা দেশের প্রধান সংকট নয়। দেশের সংকট জনসংখ্যা বেশি। সম্পদ কম। কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি। সামাজিক নিরাপত্তা বড় সংকট। সরকার ও বিরোধী দলকে আজ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েই জনতার দিকে তাকিয়ে দেশের কল্যাণে গণতন্ত্রের মঙ্গলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যক্তির চেয়ে দল আর দলের চেয়ে দেশ বড় নীতিতেই আত্দসমালোচনা, আত্দসংযম আর আত্দশুদ্ধির মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।