সব দলের অংশগ্রহণে দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সংলাপ করার জন্য সরকারের ওপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন চাপ সৃষ্টি করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। তবে এ চাপ শুধু আগামী নির্বাচনের জন্য নয়, বরং নির্বাচন বিষয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য। কূটনীতিকরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ কম থাকায় সে সময়ে ঘোষিত অবস্থানের পরিবর্তন তারা করেননি। সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে দেশের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তারা স্বস্তিবোধ করছেন। তবে একটি আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের বলা হয়েছে, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত আছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচন ইস্যুতে অবস্থান অপরিবর্তিত রেখে সরকারের সঙ্গে সব ধরনের কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে তারা সাধারণভাবে 'বিতর্কিত' ও 'অগ্রহণযোগ্য' বলছেন। কারণ হিসেবে বিদেশিরা বলছেন, অর্ধেকের বেশি আসনে জনগণ ভোটাধিকারের সুযোগই পাননি। আর যেসব স্থানে এ সুযোগ ছিল সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের যথেষ্ট স্বল্পতা ছিল। এ জন্য নির্বাচনের পরপরই প্রতিটি দেশের ও জোটের পক্ষ থেকে তাদের অভিমত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। এখন নির্বাচনের তিন মাস পর কূটনীতিকরা বলছেন, তারা আগের অবস্থানেই আছেন। সরকারি ও কূটনৈতিক সূত্রগুলোর তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পক্ষ থেকে আসছে জুন মাসের মধ্যে পুনরায় একটি নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়। ইউরোপের দেশগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে না গেলেও তারা দ্রুততার কথা বলেন। সব মিলিয়ে আগামী বছর শুরুর আগেই একটি নির্বাচনের দাবি ছিল বিদেশি মিশনগুলোর। কিন্তু সরকারের সে ধরনের কোনো উদ্যোগ না থাকায় কার্যত অসন্তোষ প্রকাশ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মিশনের পক্ষ থেকে। সময়সীমা নিয়ে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে এক ধরনের কড়া বাক্য বিনিময়ও হয় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেনের মধ্যে। বিভিন্ন পর্যায়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোকেই বেশি জোর দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু মন্ত্রীদের পাঁচ বছরের আগে কোনো নির্বাচন নয় বলে একের পর এক দেওয়া বক্তব্যে কূটনীতিকরা বিভ্রান্ত হন। গত মাসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কাছে এ প্রসঙ্গটি উত্থাপনও করেন একাধিক কূটনীতিক। প্রতিমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যই একমাত্র ধর্তব্য এবং প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। ঢাকাস্থ একাধিক শীর্ষ ও মধ্যসারির কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিবার যে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চাওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে দ্রুত আলোচনা করে একটি পদ্ধতির বিষয়ে একমত হতে সংলাপের জন্য উভয় বড় দলের প্রতি বিভিন্নভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া জামায়াত ইস্যুতে কয়েক ধরনের মত আছে কূটনীতিকদের। সহিংসতায় জড়িয়ে থাকার ইস্যুতে জামায়াতকে ত্যাগ করতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপের বড় কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রও এক্ষেত্রে আগের অবস্থানের পরিবর্তন করেছে। বিএনপিকেও সহিংস আন্দোলন না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে নতুন সরকারের তিন মাস মেয়াদ পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বেশির ভাগ কূটনীতিক। প্রায় এক মাস ওয়াশিংটন সফর করে এসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মোজেনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থানেই আছে। নির্বাচনের পরের দিন ওয়াশিংটন থেকে দেওয়া বিবৃতি ও ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল যা বলে গেছেন সেই অবস্থানেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। তখন ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর ও নিশা দেশাই বিসওয়াল নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি উল্লেখ করে দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির নতুন মিশন পরিচালক বাংলাদেশের সব উন্নয়ন সহায়তা অব্যাহত রাখলেও সুশাসন বিষয়ক সহায়তা বন্ধ করার কথা জানান। নির্বাচনের পরপরই দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের দাবি তোলা ব্রিটেনের ঢাকাস্থ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনও তার দেশের আগের অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনের সহিংসতা ও কারচুপির অভিযোগ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে গিবসন গত সপ্তাহে বলেছেন, মানুষের ভোটের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। জোর করে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। গিবসন জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। চলতি সপ্তাহে ঢাকা সফর করা ব্রিটিশ উন্নয়নবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এলান ডানকান বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অস্বাভাবিক হলেও সরকার বৈধ। তবে ব্যালট বাঙ্রে মাধ্যমে সংসদে জনগণের প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ, ভোটে নির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত সরকারের জবাবদিহিতা এবং বৈধ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগ নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্সের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মিশেল টিংকুইয়ার স্পষ্টই জানিয়েছেন, ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ইইউ'র উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ক্যাথরিন অ্যাস্টন যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন সে অবস্থানে অটল রয়েছে জোটের সদস্য ২৮টি রাষ্ট্র। ইইউ'র প্রধান কার্যালয় থেকে সর্বশেষ বিবৃতিতে অ্যাস্টন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবৃতিতে বলেছেন, ইইউ বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সবার সামনে রেখে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতাকে জোরালো করা এবং স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সত্যিকার সংলাপে বসার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (ইপি) ঢাকা সফর করা প্রতিনিধি দলের নেতা জঁ্য ল্যামবার্ট বলেছেন, বাংলাদেশে এমন একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি দরকার, যেখানে জনগণের কথা শোনা হবে। সব বৈধ দল যদি অংশগ্রহণে ইচ্ছুক হয়, তাহলে আগাম নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনার টেবিলে আনা উচিত। তবে সর্বশেষ নির্বাচনের মতো হলে আগাম নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন নেই। দ্রুত নতুন নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার কানাডার হাইকমিশনার সম্প্রতি গত মাসে একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরেছেন সরকারের কাছে। এ জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষ মনে করে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। কানাডার হাইকমিশনার স্পষ্টই বলেন, এ কারণে তিনি এবং তার দেশ মনে করে বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
উত্তরণের চেষ্টায় সরকার : বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর এ চাপের বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য না রাখলেও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব দেওয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশেষ দায়িত্বে বার্তা দেওয়া হয়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানের দায়িত্ব নিয়েই বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নের চতুর্মুখী প্রচেষ্টা শুরু করেছেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরামর্শে আগের মেয়াদের সম্পর্কের শিথিলতা কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোকে বাইরে রেখে বাণিজ্যিক বিষয়গুলোকে সামনে রেখে চলছে এ সম্পর্কোন্নয়নের প্রক্রিয়া। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরে জোর দেওয়া হয়েছে বহুপক্ষীয় জোট ও সংস্থাগুলোর প্রক্রিয়ায়। সরকারের একটি সূত্র মতে, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা দৃঢ় করার মাধ্যমে নির্বাচন ইস্যুর বিতর্ক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।