আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেলেবেলায় শোনা পাখি-বিষয়ক একটি লোকগান

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

বাংলার লোকগান যে অর্থের দিক থেকে অতি গভীর- আমরা তা জানি। সহজ ও সাধারণ বাক্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকে অসম্ভব গভীর সব মানে। প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার লোকগানকে করে তুলেছে গভীর রহস্যময়।

লোকগানের যে ব্যাখ্যাবিশ্লেন তা বাংলার সংস্কৃতিরই অনিবার্য অঙ্গ বলে মনে হয়। মাঝেমাঝে তাই লোকগানের ব্যাখ্যাবিশ্লেষন করতেই হয়। যেমন, পাখি শব্দটি বারবারই এসেছে লোকগানে। কিন্তু, পাখির মানে কি? ছেলেবেলায় একটি গান খুব শুনতাম। হলুদিয়া পাখি সোনালি বরণ পাখিটি ছাড়িল কে গানটা শুনতাম আবদুল আলীমের কন্ঠে ।

অন্য কারও কন্ঠে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। এখনও যে গানটি শোনা যায় না, তা নয়। শোনা যায়। তবে ছেলেবেলায় খুব শুনতাম। রেডিওতে।

এবার এই লাইটির মানের বোঝার চেষ্টা করি। হলুদিয়া পাখি সোনালি বরণ পাখিটি ছাড়িল কে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে: একটা লোক খাঁচায় সোনালি বরণ ‘হলুদিয়া’ পাখি পুষত। তো সে খাঁচা কে বা কারা খুলে পাখিটিকে ছেড়ে দিয়েছে। কাজেই লোকটা আক্ষেপ: হলুদিয়া পাখি সোনালি বরণ পাখিটি ছাড়িল কে ... না। তা নয়।

তখন, মানে ছেলেবেলায় গানটির প্রকৃত মানে কদাপি বুঝিনি। এখন ঈষৎ বুঝি যে আবদুল আলীমের গাওয়া এ গানটি গভীর দার্শনিক ভাবনায় সমৃদ্ধ ‘ম্যাটাফিজিকাল’ একটি গান। গানটিতে ‘হলুদিয়া’ পাখির কথা আছে। লক্ষ করুন, হলুদ রঙের পাখি নয়। কেননা, হলুদিয়া পাখির বরণ সোনালি।

হলুদ রঙের পাখির কি সোনালি রং হতে পারে? যে কারণেই ‘হলুদিয়া পাখি’। ‘সোনার ময়না পাখি’ নয়। হলুদিয়া পাখি- যে পাখির বর্ণ সোনালি। অনেক পরে জেনেছি: লোকগানে পাখি হল জীবনের প্রতীক। কখনও বলা হয়েছে ‘অচিন পাখি’।

লালনের একটি গান এরকম- চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি। পাখি কখনও কখনও প্রেমিক বা প্রেমিকার আত্মার প্রতীক। আমার সোনার ময়না পাখি/ কোন্ দেশেতে গেলা উইড়া রে/ দিয়া মোরে ফাঁকি ... তো সে অচিন জীবন-পাখি মানুষের বশে থাকে না। যে কারণে লালনের আর্তনাদ- আগে যদি যেত জানা জংলা কভূ পোষ মানে না। তবে হায় প্রেম করতাম না লালন ফকির কেঁদে কয়।

পাখি কখন জানি উড়ে যায় একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়। পাখি জীবনের প্রতীক হলে সে পাখিকে কে ছাড়ল? পাখি = যদি জীবন হয় তো পাখির মালিক বা সৃষ্টিকর্তা তো ঈশ্বর। এখন তা হলে খানিক বোঝা যাচ্ছে। তা হলে মানে এই দাঁড়াল: মহাবিশ্বে প্রাণের বিকাশ কে ঘটাল? এই প্রশ্নটিই আমাদের পল্লির কবি করেছেন এভাবে- হলুদিয়া পাখি সোনালি বরণ পাখিটি ছাড়িল কে তার মানে, সোনা রঙের হলুদ পাখিটিকে (জীবনকে) বিশ্বজগতে কে ছাড়ল? একদা ঈশ্বরের কল্পনার খাঁচায় ছিল হলুদিয়া পাখি। একদিন পাখিটি ঈশ্বর ছেড়ে ছিলেন।

এভাবে দার্শনিক ভাবনার সূত্রপাত হল। যে দার্শনিক ভাবনা বাংলার লোকগানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গত, একটি ভাবনার উদয় হয়। আমাদের গান, বিশেষ করে লোকগান কত সমৃদ্ধ তা বিশ্বের মানুষ কোনও দিনই জানতে পারবে না। কেননা, অনুবাদে লোকগান কবিতার মতোই ম্লান হয়ে যায়।

“হলুদিয়া পাখি” -এই দুটো শব্দে আমরা যা বুঝব সেটা কখনোই অন্য ভাষাভাষীদের বলে বোঝানো যাবে না। যাক গে। আমাদের প্রাণসম্পদের প্রশংসা আমরাই করি। শ্রদ্ধা আমরাই করি। ভালো আমরাই বাসি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.