"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
সীমারেখা ব্যতিত কোনো অগ্রগতি হয় না
কার্ল মার্কসের ১২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেল নীরবে, নীরবেই। এ উপলক্ষে কোনো পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। কোনো টিভি চ্যানেলে আলোচনা অনুষ্ঠান বা টক-শো হয়নি। তবু মার্কস অত্যন্ত জীবন্ত, অত্যন্ত শক্তিশালী, তাদের কাছে যারা শুধু পৃথিবীটাকে দেখা নয়, শুধু বাগবিস্তার করা বা ব্যাখ্যা করা নয়, পরিবর্তনের সাধনা করছেন তাদের কাছে।
মার্কস জন্মেছিলেন ১৮১৮ সালের ৫ মে, জার্মানির প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চলের ত্রিয়ার/ট্রিয়ার শহরে। তাঁর জীবনাবসান ঘটে ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ, জার্মানি থেকে নির্বসিত অবস্থায় লন্ডনে। তাঁর জীবন-সংগ্রাম সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে লিখতে গেলেও হয়ত কয়েক দিস্তা লিখতে হবে।
আমাদের দেশে যখন মার্কস সংবাদমাধ্যমে অনুচ্চারিত, তখন ইউরোপে ক্যাপিটাল-রচয়িতা কার্ল মার্কস-কে নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা চলছে। আর ভাবনাটা ভাবছেন তারাই যাদের উচ্ছেদ করার কথা মার্কস বলে গেছেন।
ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির একদা অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট এলান মিঙ্ক (Alain Minc)। তার ওই মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে Le Magazine Littéraire পত্রিকায়।
একজন ইংরেজ ইতিহাসবিদ বলেছেন, 'আমি এখন মার্কস পড়ছি, তাঁর বক্তব্যে কতগুলো আগ্রহ জাগানিয়া ব্যাপার আছে'। এরিক হবসবাউন (Eric Hobsbawn) আরো বলছেন, 'বুদ্ধিমান পুঁজিপতিরা বিশেষত আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির কারবারিরা যখন মার্কস পড়ছেন তা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির তারা অংশীদার, ওই অর্থনীতির অনিশ্চয়তা-অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে তারা নিজরাও অত্যন্ত সচেতন।
' এরা অবশ্য সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কস পড়ছেন না, মার্কস পড়ছেন তাদের ব্যর্থ-ভেঙে পড়া-অচল পুঁজিবাদী অর্থনীতির 'গলদ'গুলো খুঁজে বের করে তা সারাই করার উদ্দেশ্যে, পুঁজিবাদী শোষণটাকে নতুনভাবে সচল করার, ঢেলে সাজাবার উদ্দেশ্যে।
লিংক এখানে :
"Karl Marx and the Lessons of "Capital" Are Back" : [http://www.humaniteinenglish.com/spip.php?article1121]
আর তাই ক্যাপিটাল বইটারও কদর বেড়ে গেছে। হাজার হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে ইউরোপে। সেই সাথে আরো একজনের বই বিক্রি বেড়ে গেছে। তিনি স্ট্যালিন।
যখন গোটা ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল তখন এই ভদ্রলোক (ওনারা অবশ্য স্ট্যালিনকে 'দানব' বলতেই পছন্দ করেন) কি করে সোভিয়েত ইউনিয়নে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটিয়েছিল এটা তাদের কাছে একটা রহস্য। আর তাই ওই 'দানব' কর্তৃক রচিত অর্থনীতি সংক্রান্ত বইপত্রও বিক্রি বেড়ে গেছে।
এঙ্গেলস, যিনি ছিলেন তাঁর আজীবন কর্ম ও সংগ্রামের অকৃত্রিম বন্ধু, সাথী, সহযোদ্ধা, অনুসারী, মার্কসের মৃত্যুর পর তাঁর বহু অসমাপ্ত কাজ যিনি সমাপ্ত করেছেন, মার্কসের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি যে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন, মার্কসের স্মরণে তা আজো অতুল্য এবং অমূল্য।
মার্কসের সমাধি পাশে এঙ্গেলস
"১৪ মার্চ, বেলা পৌনে তিনটায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন। মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্য তাঁকে একা রেখে যাওয়া হয়েছিল।
আমরা ফিরে এসে দেখলাম যে তিনি তাঁর আরামকেদারায় শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন _ কিন্তু ঘুমিয়েছেন চিরকালের জন্য।
এই মানুষটির মৃত্যুতে ইউরোপ ও আমেরিকার জঙ্গী প্রলেতারিয়েত এবং ইতিহাস-বিজ্ঞান উভয়েরই অপূরণীয় ক্ষতি হল। এই মহান প্রাণের তিরোভাবে যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা অচিরেই অনুভূত হবে।
ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম, মতাদর্শের অতি নিচে এতদিন লুকিয়ে রাখা এই সহজ সত্য যে, রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রথম চাই খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, পরিচ্ছদ, সুতরাং প্রাণধারণের আশু বাস্তব উপকরণের উৎপাদন এবং সেইহেতু কোনো নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হল সেই ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই এগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে, এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টো দিক থেকে নয়।
কিন্তু শুধু এই নয়।
বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির এবং এই পদ্ধতি যে বুর্জোয়া-সমাজ সৃষ্টি করেছে তার গতির বিশেষ নিয়মটিও মার্কস আবিষ্কার করেন। যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে এতদিন পর্যন্ত সব বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রী সমালোচক উভয়েরই অনুসন্ধান অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর সহসা আলোকপাত হল উদ্বৃত্ত মূল্য আবিষ্কারের ফলে।
একজনের জীবদ্দশার পক্ষে এরকম দুটো আবিষ্কারই যথেষ্ট। এমনকি এরকম একটা আবিষ্কার করতে পারার সৌভাগ্য যাঁর হয়েছে তিনিও ধন্য। কিন্তু মার্কসের চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে _ এবং তিনি চর্চা করেছিলেন বহু বিষয় নিয়ে এবং কোনোটাই ওপর ওপর নয় _ তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই, এমনকি গণিতশাস্ত্রেও তিনি স্বাধীন আবিষ্কার করে গেছেন।
এই হল বিজ্ঞানী মানুষটির রূপরেখা। কিন্তু এটি তাঁর ব্যক্তিত্বের অর্ধেকও নয়। মার্কসের কাছে বিজ্ঞান ছিল এক ঐতিহাসিকভাবে গতিষ্ণু বিপ্লবী শক্তি। কোনো একটা তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের যে আবিষ্কার কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের কল্পনা করাও হয়তো তখন পর্যন্ত অসম্ভব, তেমন আবিষ্কারকে মার্কস যত আনন্দেই স্বাগত জানান না কেন, তিনি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের আনন্দ পেতেন যখন কোনো আবিষ্কার শিল্পে এবং সাধারণভাবে ঐতিহাসিক বিকাশে একটা আশু বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎশক্তির ক্ষেত্রে যেসব আবিষ্কার হয়েছে তার বিকাশ এবং সম্প্রতি মার্সেল দেপ্রে'র আবিষ্কারগুলি তিনি খুব মন দিয়ে লক্ষ করতেন।
কারণ মার্কস সবার আগে ছিলেন বিপ্লববাদী। তাঁর জীবনের আসল ব্রত ছিল পুঁজিবাদী সমাজ এবং এই সমাজ যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে তার উচ্ছেদে কোনো না কোনো উপায়ে অংশ নেওয়া, আধুনিক প্রলেতারিয়েতের মুক্তিসাধনের কাজে অংশ নেওয়া, একে তিনিই প্রথম তার নিজের অবস্থা ও প্রয়োজন সম্বন্ধে, তার মুক্তির শর্তাবলী সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাঁর ধাতটাই ছিল সংগ্রামের। এবং যে আবেগ, যে অধ্যবসায় ও যতখানি সাফল্যের সঙ্গে তিনি সংগ্রাম করতেন তার তুলনা মেলা ভার। প্রথম Rheinische Zeitung (১৮৪২), প্যারিসের Vorwarts [আগুয়ান] (১৮৪৪), Deutsche Brusseler Zeitung (১৮৪৭), Neue Rheinische Zeitung (১৮৪৮-'৪৯), New York Tribune (১৮৫২-'৬১) পত্রিকা এবং এছাড়া একরাশ সংগ্রামী পুস্তিকা, প্যারিস, ব্রাসেলস্ এবং লন্ডনের সংগঠনে তাঁর কাজ এবং শেষে, সর্বোপরি মহান শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি গঠন _ এটা এমন এক কীর্তি যে আর কোনো কিছু না করলেও শুধু এইটুকুর জন্যই এর প্রতিষ্ঠাতা খুবই গর্ববোধ করতে পারতেন।
এবং তাই, তাঁর কালের লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ও কুৎসার পাত্র হয়েছেন মার্কস। স্বেচ্ছাতন্ত্রী এবং প্রজাতন্ত্রী _ দু'ধরনের সরকারই নিজ নিজ এলাকা থেকে তাঁকে নির্বাসিত করেছে। রক্ষণশীল বা উগ্র-গণতান্ত্রিক সব বুর্জোয়ারাই পাল্লা দিয়ে তাঁর দুর্নাম রটনা করেছে। এ-সবকিছুই তিনি ঠিক মাকড়শার ঝুলের মতোই ঝেঁটিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন, উপেক্ষা করেছেন এবং যখন একান্ত প্রয়োজনবশে বাধ্য হয়েছেন একমাত্র তখনই এর জবাব দিয়েছেন। আর আজ সাইবেরিয়ার খনি থেকে কালিফোর্নিয়া পর্যন্ত, ইউরোপ ও আমেরিকার সব অংশে লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী সহকর্মীদের প্রীতির মধ্যে, শ্রদ্ধার মধ্যে, শোকের মধ্যে তাঁর মৃত্যু।
আমি সাহস করে বলতে পারি যে মার্কসের বহু বিরোধী থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রু তাঁর মেলা ভার।
যুগে যুগে অক্ষয় হয়ে থাকবে তাঁর নাম, অক্ষয় থাকবে তাঁর কাজ। "
[১৮৮৩ সালের ১৭ মার্চ লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ইংরেজিতে প্রদত্ত বক্তৃতা]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।