বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
সুইস মনস্তাত্ত্বিক কার্ল গুস্তাফ য়ুং। য়ুং -এর মনের গড়ন ছিল মরমী। সে জন্যই আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সঙ্গে ভাববাদী প্রাচ্যের দার্শনিক নীতির যেমন সমন্বয় করেছেন য়ুং-তেমনি প্রাচীন গ্রিসের পিথাগোরাসের মরমী চিন্তাধারাও তাঁর জীবনদর্শনে লক্ষ্য করা গেছে।
মরমী বলেই য়ুং জীবনভর স্বোচ্চার ছিলেন অতিমাত্রার বস্তুবাদী যুক্তিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অত্যধিক যুক্তিবাদের চর্চা যে ইউরোপের মানুষের মনকে ক্লান্ত করে ফেলবে য়ুং তা তাঁর জীবদ্দশায় বুঝেছিলেন। তাই হয়েছে কিন্তু। তবে মনের গড়নে মরমী ধাঁচের বলেই জীবদ্দশায় কোণঠাসা ছিলেন য়ুং। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে মনস্তত্ত্বের নামে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রচারের।
অধিকন্তু, য়ুং-এর পদ্ধতিটি বিষয়ী বা সাবজেটিভ বলেই পদ্ধতিটির ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না। যদিও বাস্তবিকভাবে কার্যকর, তথাপি মনোবিদ্যা আজও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো নৈব্যার্ক্তিক হয়ে উঠল না। সে যাই হোক না কেন-যে ক’জন চিন্তাবিদ মনোবিদ্যাকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন- য়ুং তাদের মধ্যে অন্যতম। য়ুংবাদী মনোবিদ্যা চর্চার ফলে মানবচরিত্র উপলব্দির ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্লেষনধর্মী মনোবিদ্যার ক্ষেত্রে একজন মহৎ পথিকৃৎ য়ুং ।
প্রচুর লিখেছেন। ‘ম্যান অ্যান্ড হিজ সিম্বল’; ‘মেমোরিজ ড্রিমস রিফ্লেকশন’ ইত্যাদি তাঁর বহুল পঠিত গ্রন্থ। ১৯১২ সালে প্রকাশ করেন ‘সাইকোলজি অভ দ্য আনকনশাস’ নামে বিখ্যাত বইটি।
কার্ল গুস্তাফ য়ুং-এর জন্ম ১৮৭৫ সালের ২৬ জুলাই। সুইজারল্যান্ডের কেসউইল-এ ।
বাবা ছিলেন ধর্ম যাজক। নিঃসঙ্গ বালকবয়েসে স্বপ্ন নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন য়ুং। যে অভ্যেসটি তাঁর বড় বয়েসের কাজকে প্রভাবিত করেছিল। জুরিখের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় পাস করেন ১৯০২ সালে। জীববিদ্যা প্রাণিবিদ্যা ফসিলবিদ্যা প্রতœতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন য়ুং।
মানবচরিত্র সম্বন্ধে উৎসুক ছিলেন-কাজেই সে জ্ঞান পুঁজি করে মানসিক রোগীদের রোগ নিরাময়ে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। মানসিক রোগীদের মধ্যে শব্দের অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ শুরু করেন-কেন বিশেষ বিশেষ শব্দে বিশেষ বিশেষ রোগী তাড়িত হয়ে ওঠে।
মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করার সময়েই ফ্রয়েডের সঙ্গে পরিচিত হন য়ুং; কিছুদিন ফ্রয়েডের ছাত্রও ছিলেন। তবে মতের মিল হয়নি ফ্রয়েডের সঙ্গে। দু’জনের কেবল বচসা হত।
একবার য়ুং এত জোরে চিৎকার করেছিলেন-ফ্রয়েড মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন!
ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতিতে অবদমিত যৌনতার ভূমিকাকে অত্যন্ত সংর্কীন মনে করতেন য়ুং- যে কারণে পরে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষনের বিরোধী তত্ত্ব উপস্থাপন করেন য়ুং । তিনি মনে করতেন: মনের বিচিত্র গঠনের সঙ্গে লোকসমাজের প্রাচীন উপকথা ও মানুষের নিজেকে প্রকাশ (শিল্পচর্চা কিংবা নির্বাচনে দাঁড়ানো) করার তাগিদ ঘনিষ্ট ভাবে সংশ্লিস্ট ।
বিশ্বজুড়ে শিল্পীসাহিত্যিকদের মধ্যে য়ুং-এর তুমুল জনপ্রিয়তার এইই মূল কারণ। মনস্তত্ত্বকে তিনি ফ্রয়েডের চেয়েও শিল্পীসাহিত্যিকদের কাছে আগ্রহের বিষয় করে তুলেছেন। আজ আমরা যে এত ‘প্রতীক’ শব্দটি শুনি-কার জন্য?
মানবচৈতন্যকে তিনভাগে ভাগ করেছেন য়ুং।
ক) অহং বা ইগো।
খ) দি পারসোনাল আনকনশাস এবং
গ) দি কালেকটিভ আনকনশাস বা যৌথ অবচেতনা।
ধর্মদর্শন ও উপকথা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনার ফলে তাঁর মনে হয়েছে: এক লোকোত্তর বিশ্বঅবচেতনা নিজেকে প্রতীকের মাধমে প্রকাশ করতে চায় -যে ইচ্ছেটি স্বপ্ন, মরমীবাদ ও ধর্মে প্রতিফলিত হয়। এই জায়গায় য়ুং প্রাচ্যের মরমীবোধকে সযতেœ লালন করেছেন। এই জায়গায় তিনি লালনের খুব কাছে।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
লালনের অচিন পাখিটি প্রতীক- প্রতীক লোকোত্তর এক বিশ্বঅবচেতনার। য়ুং যাকে জীবনভর বোঝার চেষ্টা করেছেন। সে বোঝার পথে পাশ্চাত্যের মহৎ অর্জন যুক্তিবোধ বাধা হয়ে দাঁড়লে তিনি অবলীলায় সেই যুক্তিবোধকে বিসর্জন দিয়েছেন।
য়ুং-এর যৌথঅবচেতনার ধারনাটি বিস্ময়কর।
এই ধারনা ব্যতীত লোকসমাজের তাৎপর্য অনুধাবন সম্ভব নয়। আমরা যে বলি, ‘আবহমান বাংলা’-সেও এক ধরনের য়ুংবাদী যৌথঅবচেতনা।
আর্কিটাইপের ধারনাটিও য়ুংবাদী মনোবিদ্যায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। য়ুং-এর যৌথঅবচেতনার ধারনাটি তাঁর আর্কিটাইপ ধারনার সঙ্গে সংশ্লিস্ট। যৌথঅবচেতনা নির্ধারন করে দেয় যে মানবীয় অভিজ্ঞতা বিশেষ সাংগঠনিক নীতি দ্বারা নির্ধারিত।
এই বিশেষ সাংগঠনিক নীতিই হল আর্কিটাইপ। য়ুং-এর মতে অনেক ধরনের আর্কিটাইপ হতে পারে। জীবন ও আচরণকে প্রভাবিত করে এমন কতগুলি আর্কিটাইপ নির্ধারণ করেছেন য়ুং। যেমন, মাদার আর্কিটাইপ। মানুষের জীবনে মায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
য়ুং-এর মাদার আর্কিটাইপের ধারনাটি অবশ্য তার চেয়েও বেশি কিছু। মাদার আর্কিটাইপ আসলে একটি মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা। য়ুং বলেছেন, আমরা আমাদের জীবনের দুর্যোগের সময়ে মমতা ও পরিষেবা আশা করি এবং আমাদের এ আকাঙ্খাটির পিছনে রয়েছে বিবর্তন । আমাদের জীবনের দুর্যোগের সময়ে আমরা প্রবল রক্ষাকর্ত্রী একজন মাকে খুঁজি। আমাদের চাহিদাগুলি মেটানোর দায়িত্ব মায়ের ওপরই প্রথমে বর্তায়।
কিন্তু, যখন (আর্কিটাইপ) মা তার ভূমিকাটি ঠিক মতো পালন করতে পারে না- তখনই মানুষ হয়ে ওঠে মনোরোগী। মনোরোগীর আচরণে সে বিকার ফুটে ওঠে । আর্কিটাইপ মা স্নেহময়ী ভূমিকা পালন না করলে মায়ের বিকল্প ধর্ম কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদে খোঁজে মানুষ! (কাজেই, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক উগ্রবাদীদের উগ্রবাদী হয়ে ওঠার একটা কারণ জানা গেল! সিরিয়াল কিলারদের সম্বন্ধেও আমার ধারনা ঐ একই কারণ বিদ্যমান। )
মনোবিদ্যায় য়ুং-এর অন্য একটি বিশেষ অবদান হল-ব্যাক্তিত্বের ধরণ বা পার্সোনালিটি টাইপ।
য়ুং মনে করতেন, মানবীয় মূল ব্যাক্তিত্বের ধরণ প্রধানত দুরকম।
ক) ইনট্রোভার্ট বা অর্ন্তমুখি। ও
খ) এক্সট্রোভার্ট বা বর্হিঃমুখি।
সাধারনত ইন্ট্রোভার্টরা লাজুক ও এক্সট্রোভার্টরা মিশুক হয়ে থাকে। তবে য়ুং-এর ব্যাখ্যা আরও নিগূঢ় ও গভীর তাৎপর্যপূর্ন। য়ুং-এর মতে: অর্ন্তমূখির অহং বা ইগো শ্বাশত নির্জ্ঞানের দিকে যায়।
অপরদিকে বর্হিমূখির সত্তা বাহ্যিক বাস্তবতা নিয়ে বেশি উৎসাহী ও বাইরের কাজকর্মের দিকে বেশি উৎসুক। ব্যাক্তিত্বের এই পার্থক্য মানবসত্তায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আসলে সত্ত্বাই হল প্রধান আর্কিটাইপ। যে নীতি দ্বারা আমরা আমাদের জীবনকে পরিচালনা করি। সত্তা অনবরত উন্নতির প্রক্রিয়ায় থাকে।
আমাদের ব্যাক্তিত্বের সব দিক প্রকাশিত হলেই তবে সত্তাকে বোঝা যায়। কাজেই চরম অর্ন্তমূখিনতা ও চরম বহিঃমূর্খিনতা হচ্ছে সত্তার বিকাশের প্রাথমিক ধাপমাত্র। স্বাভাবিক বিকাশ হলেই তবে দুটো পরস্পরবিরোধী ধারার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা পায়। অবশ্য, য়ুং-এর মতে, মৃত্যু ব্যতীত সত্তার পূর্ন উদ্বোধন সম্ভব নয়! কথাটি ঠিক যুক্তিযুক্ত নয়। তখন বলছিলাম, লোকোত্তর এক বিশ্বঅবচেতনার সাধক য়ুং ... যাকে জীবনভর বোঝার চেষ্টা করেছেন।
সে বোঝার পথে পাশ্চাত্যের যুক্তিবোধ বাধা হয়ে দাঁড়লে অবলীলায় সেই যুক্তিবোধকে বিসর্জন দিয়েছেন।
সূত্র: ফিলিপ স্টোকস রচিত, 'ফিলসফি: ওয়ান হানড্রেড অ্যাসেনসিয়াল থিঙ্কারস। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।