অভিলাসী মন চন্দ্রে না পাক, জোছনায় পাক সামান্য ঠাই
"জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা, সত্য কাজে কেউ নয় রাজী, সবই দেখি তানা নানা। "
লালন সাঁই যখন এই কথা বলছে তখনই জার্মানীতে কার্ল মার্ক্স বলছেন, "The history of all hitherto existing society is the history of class struggles" ( এযাবৎ পর্যন্ত সমাজের যত ইতিহাস, তার সবই শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস) " মানে ঐ একই শ্রেণী বৈষম্যের কথা।
জানি না লালন সাঁই মার্ক্সের কথা জানতেন কি না অথবা লালনের কথা মার্ক্স!
কিন্তু দুজনই নিয়োজিত ছিল একই কাজে, মানবসেবা। দুজনই নিজ নিজ সময়ের সামাজিক স্ট্রাকচারের ভেতর থেকে প্রতিষ্ঠিত বৈষম্যকে চিন্হিত করেছেন।
দুজনই চেয়েছেন মানুষকে বৈষম্যের ফাঁক থেকে উদ্ধার করে মানবজীবনের চরম আকাঙ্খা সাম্যের কথা বলতে।
ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় তৎকালীন উৎপাদনের মাধ্যম'কে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এবং বৈষম্যের মূল হিসেবে মার্ক্স চিন্হিত করেছেন, আর
তৎকালীন আধ্যাত্মিক ভাববাদী বাংলায় ধর্মকে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এবং বৈষম্যের মূল হিসেবে সঠিকভাবে চিন্হিত করেছেন।
কার্ল মার্ক্স যদিও তৎকালীন সময়ের চলমান বৈষম্যের ধরন, গঠন এবং এর ফাঁকি বর্ণনার মাধ্যমে প্র্যাক্টিক্যাল সমস্যাটাকে চিন্হিত ও ব্যাখ্যা করে এর একটা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বৈষম্যের মূলভাব বা ফিলোসফিক টেন্ডেসিকে চিন্হিত করতে পারেন নাই।
-
এ্যাকাডেমিক ভাষায় বলা যায়, মার্ক্স সামাজিক বৈষম্যের অন্টোলজি ব্যাখ্যা করেছেন আর লালন ব্যাখ্যা করেছে সামাজিক বৈষম্যের এপিস্টোমোলজি।
-
মার্ক্স চিন্হিত করেছে মানুষের কর্ম, লালন দেখেছে সেই কর্মের পেছনের প্রভাবক, সেজন্যই মার্ক্স দেখেছে শুধু 'ক্লাস কনফ্লিক্ট', আর লালন বলেছে, 'জাত গেল বলে একি আজব কারখানা, সত্য কাজে কেউ নয় রাজী, সবই দেখি তানা নানা', এখানে লালন মানবসমাজে বৈষম্যমূলক ক্লাস বিল্ডআপের প্রক্রিয়াকে 'আজব কারখানা' উল্লেখ করে বলছেন, সাম্যের সত্যটাকে দেখতে কেউই রাজী না, মার্ক্স বর্ণিত " ক্যাপিটালিস্ট ক্লাস" এর বাংলা রূপ "ব্রাক্ষন সমাজ"কে লালন "তানা নানা" মানে অজুহাত বলে চিন্হিত করেছে।
-
লালন আর মার্ক্সের মাঝের মিল ও অমিলগুলোকে মোটাদাগে দেখতে গেলে দেখা যায়,
অমিলগুলো হচ্ছে,
-মার্ক্স বৈষম্যের প্রায়োগিক দিকে মানে ইকোনমিক স্ট্রাকচারের দিকে খেয়াল করেছেন আর লালনের দৃষ্টি ছিল মোর্যাল স্ট্রাকচারে।
- মার্ক্স বৈষম্য সমাধান খুঁজেছেন, লালন শুধু বৈষম্য দেখানোতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন।
আর মার্ক্স ও লালনের মিলগুলো হচ্ছে,
-দুজনই নিজ নিজ সমাজের শ্রেণী ভিত্তিক সামাজিক বৈষম্যের মাধ্যমটিকে পার্ফেক্টলি পয়েন্ট আউট করেছে।
-দুজনই সামাজিক কৃত্তিম বৈষম্যকে খারিজ করে দিয়ে মানবজনমকেই চুড়ান্ত সাম্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহন করেছে।
-দুজনই নিপীড়িতের হয়ে কথা বলেছে।
-
তবে তাদের দুজনের উপসংহারের ব্যাপকতার ভেতর মিল আছে, সামাজিক বৈষম্যের ব্যাখ্যায় মার্ক্স ও লালন একে অপরের পরিপুরক হলেও দুজনই উপসংহারের জায়গাটিকে ব্যাপক অর্থে খোলে রেখেই শেষ করেছেন, মার্ক্স যেমন একটা কোন নির্দৃষ্ট সময় উল্লেখ না করে ভবিষ্যতে একদিন প্রলেতারিয়েতদের সংগ্রামের কথা বলে শেষে করেছে, লালনও তেমনি তার অপর একটি গানে বলে গেছেন, "বেদে নাই যার রূপরেখা, পাবে সামান্যে কি তার দেখা?"
-------
মার্ক্স এবং লালনের মাঝে এমন তুলনামূলক আলোচনা শুরুর পেছনে আমার ব্যাক্তিগত উদ্দেশ্য হলো এটাই প্রমান করা যে, বাংলাদেশীরা কোনভাবেই বিশ্বের অপরাপর অঞ্চল থেকে কোন অংশেই পিছিয়ে ছিল না।
শুধু আত্মমর্যাদাবোধ থেকে তুলে ধরার ইচ্ছাটা চলে আসলে আমাদের সবকিছুই তুলে ধরা যায়। আমার ইচ্ছাটা আসলো কারন,
আজকে ক্লাসে একটা নতুন ইরানী ছেলে আসছে ( দেখলেই মনে হয় সাইকোপ্যাথ) , ব্রেক টাইমে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি ইন্ডিয়ান নাকি, বললাম- না। সাথে সাথে বললো, পাকিস্তান? মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল, কোন কথা না বলে ডান হাতের 'বাংলাদেশ' লেখা রিস্টব্যান্ডটা ওর চোখের সামনে ধরে বানান করে বাংলাদেশ পড়ালাম। তখন সে আস্তে করে বললো, ও, রানা প্লাজা!
মনটা চাইছিল একটা থাপ্পড় দিয়ে বলি, ও তুমি মানুষদের পাথরনিক্ষেপকারী ইরানী?
কিন্তু মনে পড়লো যে, বেকুবটারই বা কি দোষ? বেকুবের তো জানার কথা না যে, আমরাই বিশ্বের সেই বিরল দার্শনিক শান্তিপূর্ণ জাতি যাদের কোনদিন অন্যের জামি দখল করার প্রয়োজন বা বাসনা হয় নাই। গাধাকে যা দেখানো হবে সে তো তাই দেখবে, বিশ্বের সামনে তো আমাদের রানা প্লাজাই উঠে আসে!
ক্লাসে মার্ক্স পড়তে পড়তে মনে হলো, আমাদের লালন তো এর চেয়েও গুরুতর বিষয় পয়েন্ট আউট করে গেছে।
সবাই মার্ক্স পড়ে, লালনকে কেন পড়ে না? দেখলাম যে, কেউ লেখেনা বলে পড়ে না, তাই ভাবলাম, আমিই লেখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।