.
আমার যাত্রাগুলো খুব ছোট ছোট। খুব দূরে নয়। একটু পায়েহাঁটা দূরত্ব। বাসা থেকে ফার্মেসি। মাঝে একটা পুকুরঘাট।
একটা দোকান। দোকানের ছোট্ট একটা ছেলে। তারপর আবার ফার্মেসি থেকে বাসা।
পুকুর ঘাটটা রাস্তার পাশ দিয়েই। পুকুরটা বিশাল।
আমাদের দোতালা বাসার বারান্দা থেকে পুরোটা দেখা যায়। আমি বলি 'পন্ডভিউ' বাসা আমাদের। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে শ্যাম্পুর গন্ধ লাগল নাকে। শ্যাম্পুটাও চেনা। অল ক্লিয়ার ফর ম্যান।
শ্যাম্পুটার গন্ধটা খুব এট্রাকটিভ। মিনিপ্যাকের গায়ে এমন কি লেখা আছে, নারীদের থেকে সাবধান! অর্থাৎ এই শ্যাম্পু তাদের কাছে টানতে পারে! ঘাটে যে গোসল করে গেছে, আমি জানি সে কাজীবাজারে মাছ বিক্রি করে কিংবা রিক্সা চালায়। ওর ওই কথা ইংরেজিতে পড়তে পারার কথা না।
দোকানটার সামনে দিয়ে যেতেই ছোট ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, দাদা বালা নি? আমি 'অয় বালা' বলে হাঁটতে শুরু করলাম। আবার মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমার নাম জানি কিতা? প্রশ্নটা খুব বিব্রতকর ছিল।
অনেকদিন ধরেই ছেলেটা প্রতিবার ওর দোকানের সামনে দিয়ে গেলেই আমাকে 'দাদা বালানি' প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে একই সাথে সম্মান জানানো এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজটা সেরে নেয়। আমিও প্রতিবার জবাব দিয়ে এসেছি। প্রথম দিকে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে। কিন্তু আজ এতদিন পর ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম! আরও পরে করলে ব্যাপারটা আরও বিব্রতকর হবে ভেবে আজই হয়ে গেলাম এক আধটু।
কিন্তু ছেলেটাকে একদম বিব্রত মনে হলো না। একগাল হাসি দিয়ে বলল, কামরান।
গলিটা পার করে বড় রাস্তায় উঠতেই একটা ফার্মেসি। অনেক আলো। সাদা আলো।
ফ্লুরোসেন্টের। ফ্লুরোসেন্টের আলোয় একটা স্নিগ্ধতা আছে। মনটা ভালো হয়ে যায়।
মেট আসে নি?
না মেট নাই।
এইচটিজেড?
না।
আলট্রাফেন?
না।
এইচটিজেড আসে নি?
আচ্চা মেট সাড়ে আটশ অইবো নি?
ঘুরছি ঘুরছি। কেবল না শুনছি।
বাইয়া, আলট্রাফেন আসে নি?
না আলট্রাফেন নাই।
মেট?
না ইতা অইতো না।
প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো। 'ইতা অইতো না' মানে! আমি কি নিষিদ্ধ কোন কিছু খুঁজলাম নাকি? মেট কি খুব নগণ্য কিছু? যেটা তোমার দোকানে থাকতেই পারে না? ভাবনাটা কেবল মাথার ভেতর। চোখের উপর মাইনাস পয়েন্ট টু ফাইভ। হাত দুটো শর্টস এর পকেটে। আর নিত্যউপহারের টিশার্টের পিঠে চড়ে বুকের উপর রবীন্দ্রনাথ।
ফার্মেসিতে যারা বসে ওদের প্রতিভায় মুগ্ধ হই। কীভাবে এতগুলো ওষুধ এর কথা মনে রাখে? নামটা উচ্চারণ করলেই বলে দেয় "না"। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, শালারা নিশ্চয় ভণ্ডামি করছে। নিশ্চয় মানুষের চেহারা দেখে ওষুধ দেয়। চেহারা দেখে কাস্টমার পছন্দ হলেই কেবল বলে, "উমম, আসে"।
আমার তো মনে হয় আমি একটা ওষুধের নাম বলব, তারপর ওরা বলবে আলট্রাফেন ক্যাপিটাল এ-দি না স্মল এ-দি? আমি বলব ক্যাপিটাল এ। তারপর ওরা খুঁজতে থাকবে। একটু পর বলবে বানানটা আবার খউক্কা সাইন। আমি বলব। ওরা বলবে, আলট্রাজেন তো ফাইসি।
এর খান্দাত-উ (কাছেই) তো অওয়ার খতা। ...এ...ওউত্তো ফাইসি। আলট্রাফেন, আলট্রাজেনর খান্দাত। আমি ফয়লাউ বুচ্চিলাম, জি'র আগে এফ আইবো।
কিন্তু ওরা কেমন করে জানি সব মনে রাখে! অথবা চেহারা দেখে কাস্টমার পছন্দ হলে হ্যাঁ না বলে।
এই ব্যাপারে কোন ধারণা নেই তো, তাই ক্ষোভ জন্মায়। একই সাথে মুগ্ধও হই। মানে, দুটোর মধ্যে যে কোন একটা।
কোনোমতে মেট সাড়ে আটশ কিনলাম। আরেক দোকানে এইচটিজেডও পেলাম।
এইচটিজেড পুরো এক পাতা পেলাম না। ছয়টা ছিল মাত্র। ফার্মেসিতে একটা মাত্র ছেলে ছিল। চেহারা দেখে আমি বুঝেছি নতুন। এখনও অভিজ্ঞ নয়।
দোকানের সামনে দাঁড়াতেই টিভিটা অফ করে দিয়েছিল। কিছু একটা শোনা যাচ্ছিল। থেমে গিয়েছিল। ছয়টার দাম কত জিজ্ঞেস করাতে অনেকক্ষণ প্যাকেটটার উপর থিসিস করল। আমি বুঝলাম।
মাকে ফোন দিতে দিতে শুনলাম 'বিশ টেখা দেউক্কা। ' মা বলল আট টাকা। কোন কোন ফার্মেসি ছয় টাকাও রাখে। ছেলেটা খুব লজ্জা পেল। কারণ আমি ওর উপর রেগে যাই নি।
খুব লজ্জা পেয়ে বোঝাতে চেয়েছি, হয়ত ওর ভুল হচ্ছে, দামটা খুব সম্ভবত আট টাকা। 'আমি বুল খইসি। আফনারটাউ ঠিক আসে। ' আমি দশ টাকার নোট একটা বের করলাম। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, দুইটিকি অইবো নি? আমি বের করলাম।
'অইসে নানি। আমি দিলাম বারো টেখা, তুমি দিলাই ফাস টেখা। তুমার সাত টেখা রাখা অইলো। ' ছেলেটা বুঝল না। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম।
এখন কী করে বোঝাই ওকে! ছেলেটা বলল, দাড়াউক্কা, এখটেখা লইয়া যাউক্কা। সে ড্রয়ারে সার্চ দিল। না পেয়ে একটা কাঁচি বের করল। রুমের পেছনের দিকে গিয়ে একটা ওষুধের প্যাকেট বের করল। এক পাতা বের করল।
ডেস্কের সামনে এসে একটা ট্যাবলেট কাঁচি দিয়ে কাটতে কাটতে বলল, সিভিট খাউক্কা। আমি একটা আদর মাখানো হাসি দিয়ে ডেস্কের উপর থেকে সিভিট টা তুলে নিলাম। আমাদের হিসেব মিলে গেল!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।