উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি
ভূমিকা
অন্ধ বালক স্নিগ্ধ সলকের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়
সবুজ ঘণ্টির শব্দে মাঝে মাঝে থামে
আকাশের সীমানা খোঁজে; পথের নিশানা ধরে
হেঁটে যায়, আলুক-ফালুক এদিক-ওদিক তাকায়
কিসের এক নেশার করতলে দাঁড়ায়,
মনে মনে কথা বলে, যুগের ভাঁড়ার থেকে নিজেকে
ছিন্ন করে রূপকল্পের আকাশে উড়ায়।
১.
কুয়াশার ভিতর নীল-ট্রেনের হুইসেলে উড়ে আসা
মানুষেরা এবং অন্যপ্রাণীকুলও যখন গা-ঝাড়া
দিয়ে ওঠে।
আমি ঠাহরবিদ্যায় তাদের চাজ্ঞ্চল্যে সামিল হই,
জেগেওঠা শব্দের তরীতে ভাসিয়ে দিই
পাল ছড়ানো আলোর নাও। কফিনের পেরেকে
রূপের ছটায় মুগ্ধতার বৃদ্ধ-হর্ষের-হরিণেরা জাল
পেতে রাখা ফাঁদে আটকিয়ে আছে, ধাঁধাঁশীল ওই ফাঁদে
তাদের কিম্ভূত-গোঙানির শব্দ শুনি, ওরা জামগাছের
ছায়া মাড়াতে ভয় পায়, নদীঘাটের স্নানদৃশ্যে,
বাঁশবাগানের সৌন্দর্যের কোন মানে খুঁজে পায়না।
এদেরকে আমি বুড়োভাম বলি।
এরা আসলে ধুরন্ধর,
শেয়ালের ছা।
২.
বংশীবাদকের পাশে ঘাসের সবুজ পাতার নিচে
ক্ষণিকা তোমার চুলের অরণ্যে মেঘধ্বনির
আহ্ববান - টুকরো হয়ে যাওয়া দেহঘড়ি মাটিতে
পড়ে আছে,
কাঁটার সাথে আটকে আছে যেসব ভেলকিবাজ ও
ধড়িবাজ,
আমি তাদের পাশকাটাচ্ছি।
৩.
অনুভবের মিহিন স্বপ্ন-জালে আটকে পড়া জগৎপৃষ্ঠার হলুদ,
জংধরা সিংহদের পায়ের নখের দাগ-চিহ্নের বাইরে,
মাংশপচাগন্ধের ভিড় ঠেলে, এখনো যেসব জ্যান্ত-কুমিরেরা
রোদ-পোহাই,
আড়ামোড়া ছেড়ে আবারও ময়লা ঘেটে-ঘুটে ঘুমিয়ে থাকে
বৃদ্ধবাঘেদের ছালে, তাদেরসীমানা টপকিয়ে,
কেউ যেন চুলভেজা-
ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু না বলেই বসিয়ে রেখেছে,
কিছু তো দেখি না, শব্দের পুকুরে নেমে দেখছি,
ওখানে মাছের
চোখের ভিতর যাদের ছবি ফুটে ওঠে।
এখন তারা শুধুই ছবি, জ্যান্ত ও জ্বলন্ত আভার আঁচে পুড়তে
চেয়ে আমি একা একা বসে থাকি ঠাঠা রোদে।
দৈন্যতার গহ্বরে লুকিয়ে রাখা
এই দেহ, নক্ষত্রপুঞ্জের আলোয় ঝলসে ওঠে, স্মরণে
আসে লতানো ঘাস, ঘাসেরোপর পানির ফোটা
সবুজপাগলাঘন্টি।
৪.
দূর থেকে শব্দ শুনি, মায়াফলে জড়ানো মনের রঙে প্রজাপ্রতি
ওড়ে, সহুঙ্কারে জগৎ-এর তাবৎ নীলফুল ঝরে পড়ে,
আর মাটিতে গন্ধের সেতুপার হয়ে আমি
কাঁটাঝোপে ঢুকি।
কাঁটার গায়ে লেগে রোদে তোমার ওই দেহ ভেদ করে
ঢুকে পড়ে সর্প-আহ্লাদ,
মসৃণ তাপের আড়ৎ-এ বিক্রি করি গভীরমগ্নতার শ্বাস।
যাকে দেখি উন্মাদগ্রস্ত মেঘদলে, নেশার আপেল ও ছুরির
বৈভব কেটে কেটে যেনদীর পাড় উঠে আসে
যেসবুজ রাস্তার ইশারা জেগে ওঠে দৃষ্টির দিগন্তে,
তার কোলঘেষে একলা পিয়ানো জলশব্দতরী, থেমে আছে।
৫.
যৎসামান্য নীলেই বেড়ে ওঠে যাদের গোপন পরিখা,
সুড়ঙ্গের মাঝখানে গিয়ে গড়ে তোলে যারা কাঁপনের বেড়াঘর;
তারা অন্ধ-বালকের সামনে হাটু গেড়ে বসে অশ্রু মুছিয়ে হাতে
তুলে দেয় রোদেলা রুমাল, অন্ধচাকুর নৃত্য।
বাহানার খিড়কিতে লেগে থাকা পালকের ঘ্রাণ আর মধু..
চুয়ে পড়লে পথের মোড় দু'ভাগ হয়ে যায়, একভাগে সাঁতার
অন্যভাগে ঘুঙুরের শব্দ ওড়ে।
৬.
বধির গণঠুলির ভিতর তোমার দেহের লবণ
জ্বর-স্রোতে ভেসে যায় পক্ষীবাসা, মিথ্যুকের দলে ভিড়ে
সন্ধ্যার বাহুর মধ্যে যাকে কাছে টানি,
তার মুখের স্কুলে, গির্জার ঘন্টিতে বেজে ওঠে শহরতলি।
আমার ঘোর কাটিয়ে যে আজ বসন্ত উৎসবের-
চাকায় পিষ্ট হয়ে আছে, ধূলোর মধ্যে পড়ে আছে,
তার বিরহে আমিও ধীরে ধীরে ধূলোপৃষ্ঠে
একটু একটু করে উঠে
দাঁড়াবার চেষ্টা করি, ভাঙা-ডানা নিজেই সারাই।
৭.
ঘোলাটে কাচের মণিতে ফুটে উঠছে শিকারিদের কোন্দল,
পাঁজর গুড়িয়ে চলে যাবো
বৃষ্টিভেজা রুমালে জড়ানো যাদুকরেরা মৌমাছি
আর কালো ফুলে ঝুলে রবে। কোনদিনও যার ঘরের ভিতর
ঢুকিনি, তার পুরনো আয়নায় বৃষ্টির শব্দে ফিরে দেখবো
বিজলির চমক, বাহু-ডোরে স্পর্শধ্বনি।
মেঘ-ব্যঞ্জনার থেকে দূরে, পলকের-
উঠোন থেকে উঠে আসছে আবছা-ঝাপসা কারো কারো
মুখের দুধের ঘ্রাণ, কারো কারো মন-উতলানো ঢেউ;
ভাঙা বুকের হাহাকার, উড়ে যাওয়া ঘুড়ি।
কেউ কেউ দেখে নিচ্ছে পালকের থেকে ঝরেপড়া মেঘরঙ।
৮.
আজ যেইখানে মাটির ঘ্রাণলুপ্ত, পারফিউম আর ত্বকফর্সা
ক্রিমের ভিড়; সেইখানে দাঁড়িয়ে ভাবছি - কদমতলার ছায়া
যাদের হৃদয়ে আলো
কেটে কেটে গড়ে তোলে জেব্রাক্রসিং, বিষণ্ণ নদীর শ্বাস-
সেইখানে অদ্ভূত আলোর ডোরা দাগের-
তীক্ষ্ণ ফণায় তাদের কালো কালো বিয়োগ-ব্যথা জ্বলে ওঠে।
হারানো ভোরের নথে কতশত কাছের পুষ্পপ্রাণের
গন্ধ লাগা ঝিরঝির হাওয়ায় মুখ চাওয়াচাওয়ি
এখনো যেখানে মুছে যায়নি, অস্পষ্ট সেই না-মুছে যাওয়া
রেখা ধরে হাঁটি,
কখনো-সখনো স্থির হয়ে দেখি, নিজের ভিতর
সারি সারি লাল পিঁপড়ে কালো পিঁপড়ে।
৯.
সন্ধ্যার কাছাকাছি যারা পৌঁছে গেছে, যারা সংরাগে
আর ফেরেনি ঘরে; তাদের প্রতীক্ষায়,
তাদেরকে দেখবো বলে ডালিম হাতে বসে থাকি।
কারা যেন আমাকে ঘুমের ভিতর
লালঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে ধূধূবালুময় মাঠের দিকে
নিয়ে যায়।
তাদেরকে চিনিনা, তারা আমার কোমরের নিকট
ছুরি ধরে থাকে, নদীর বসন খুলে দেখতে বলে পাতাল
কুমারের হাড়।
আমি মাথার ভেতর হাটু ঢুকিয়ে আরো একটু
নিচু হয়ে থাকি,
ডুমুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কানাকানি করে
যেসব গভীর-শেয়ানা শেয়াল তাদের ভিতর ঢুকে পড়ি।
১০.
কারা আমাকে সবুজ বৃক্ষের পাতায় উড়িয়ে নিতে চায়?
তাদের কাছে কখন যে আমি মাথা নুয়ে ফেলি,
কখন যে আমি তাদের ছকহীন বাজুবন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছি
খেয়াল করিনি।
আপেলের ত্বকে জেগে ওঠা মানুষেরা আমাকে দেখে
ডেকে তুলে চিনিয়ে দিয়েছে নদী পথের ঠিকানা।
সেই থেকে নদী-পথে তাকিয়ে থাকি আর দেখার চোখ
খুলে রেখে বসে থাকি।
দেখিনা কিছুই নিকটের কেউ কাছে এলে বুঝি
হরিণ না বাঘিনী, বাঘ না ভালুক!
১১.
স্পর্শের গহীনে ঢুকে দেখেছি কলাপাতার ছায়া
ওৎ পেতে থাকা সম্পর্কের ভিতর; না-বোঝা অনুভবের
কপাট খুলে
কেউ যেন বাড়ির বাইরে, পুকুর-ঘাটে, কুলতলার
ফ্যাকাশে কাঁটার ওষ্ঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে,
তার উপস্থিতি
টের পাই, মিহিন সুতোর গায়ে তার উড়ে যাওয়া
চোখের দেখা
দিগন্তে লুটায় আর সবুজ শরীরে যেই ঘ্রাণ-
তড়িৎ প্রণয়ী সন্ধ্যার জানালায় জাগিয়ে রাখে
মৃন্মময়ী যেই জগৎ,
তার গোপন-সুড়ঙ্গে, আমি খণ্ড-খণ্ড পাথরের কণা,
জলশব্দের হারানো নূপুর।
১২.
দেহের ভিতর চুপ করে বসে থাকা কাঠের গায়ে
লেপটানো
সুগন্ধী প্রহর, মৃদু হাওয়ার আকাশে পাখনা মেলা
চুল থেকে
যেসমস্ত মেঘেরা ঝরে গেছে,
তাদের গানের বিরহ পাখিদের সাথে আমিও উড়ি,
দীপান্তরে ভাসিয়ে নেওয়া আত্মীয়দের মুখের ন্যায়
পাহাড়ের দেশে, সবুজের-কুমারী গাছের তলে
ডানা খুলে বসি,
ঋদ্ধ কাঠের দোতারায় বেজে ওঠে আমারি খুলি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।