যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
আমি অর্থনীতি ভালো বুঝিনা, ব্যবসা বানিজ্যও ভালো বুঝিনা, কৃষিকাজ তো বোঝার প্রশ্নই আসেনা, এমনকি রাষ্ট্রনীতিও তেমন একটা বুঝিনা। শুধু গাণিতিক হিসাব-নিকাশটা খানিকটা বুঝি। এরই ভিত্তিতে একটা বিশ্লেষণে যেতে চাই, মানে সোজা বাংলায় বললে হিসেব করে বের করতে চেষ্টা করবো এই পোস্টে যে "চালের দাম কত হওয়া উচিত। " একেবারে সবচেয়ে কমদামী গরীবের মোটাচাল নিয়ে বিশ্লেষণ করবো, কারণ চালের দাম বাড়লে গরীব লোকজনই বিপদে পড়ে। এই ব্লগ পড়বেন যে শ্রেনীর লোক, চালের দাম বাড়লে তাদের হয়তো দু'চারটা বিলাসদ্রব্যঘটিত আমোদ-প্রমোদের খানিক ব্যাঘাত ঘটে।
যেমন হয়তো চায়ের চিনিটা খানিকটা কমে যায়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইদানিংকার "সংসদে প্রথম সারিতে বসতে চাওয়ার দাবীতে আন্দোলন" শুরু করার আগ পর্যন্ত বিএনপি নেতারা মূলতঃ চালের দাম দশ টাকা হচ্ছেনা কেন, সেটা নিয়ে সরকারকে আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে সরকারী দল হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ার মতো ভাব নিয়ে বললেন, "কই এমন কিছু তো বলা হয়নি। " সে যাই হোক, দশ টাকায় যে এখন চাল খাওয়া সম্ভব না সেটা আমিও বুঝি, পাঠক, আপনিও বোঝেন। কাজেই সেটা নিয়ে "খেতে চাই, খেতে চাই" বলে লাফানো, বা "এমন কথা বলিনাই, বলবোনা" বলে গা বাণনচানো -- কোনটাতেই আপনার আমার কোন উপকার হবেনা, এটাও নতুন করে বোঝানোর দরকার নেই।
বরং আমরা একটা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি চালের দাম কত হওয়া উচিত। সেখান থেকে হয়তো সরকারের কাছে "এত টাকায় চাল খেতে চাই" টাইপের একটা দাবীনাম তুলে দেখা যেতে পারে। ভূমিকা আমার চিরকালই লম্বা হয়, আর না টেনে সোজা হিসেবে চলে যাই।
প্রথমে কিছু ফ্যাক্টসের দিকে নজর দিই:
১. আওয়ামী লীগ যখন ২০০১ এ ক্ষমতা ছাড়ে তখন মোটাচাল ছিলো ১০ টাকা কে.জি।
২. বিএনপি যখন ২০০৬ এ ক্ষমতা ছাড়ে তখন মোটাচাল ছিলো ২০ টাকা কেজি।
৩. উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ একটা মুদ্রাস্ফীতি থাকে, যেটা আওয়ামী লীগ আমলে মোটামুটি গড়ে ৫% এর আশেপাশে ছিলো। ধরে নেয়া যায় যে , এই মুদ্রাস্ফীতির পেছনে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটিংয়ের হাত নেই, এটাকে নাম দিলাম "প্রাকৃতিক মুদ্রাস্ফীতি"।
৪. বি এনপি'র আমলে শেষ তিন বছরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিলো অনেক বেশী। সেজন্য প্রাকৃতিক মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা বাড়বে স্বাভাবিক, ড্যাটা বলছে ২% থেকে ৩% বেড়ে গিয়েছিলো -- আমরা বেশীটাই হিসেবে নিলাম, মানে বিএনপির শেষ তিন বছর শুধু প্রাকৃতিক মুদ্রাস্ফীতি ধরলাম ৮%।
৫. বিএনপির শাসনের প্রথম ২ বছর ৫% হারে, এবং শেষ ৩ বছর ৮% হারে যদি বাড়ে -- তাহলে ১০ টাকার চালের দাম বেড়ে গিয়ে হয় ১৩ টাকা ৮৮ পয়সা, আমরা এটাকে হিসেবের সুবিধার জন্য ১৪ টাকা ধরলাম।
এখন আসুন কিছু হিসেব মিলাই:
১. বিএনপি'র আমলের শেষে চালের দাম ২০ টাকা কেজি ছিলো, অথচ এটা হবার কথা ছিলো ১৪ টাকা; তাহলে বলা যায়, বাড়তি যে ৬ টাকা, সেটা হয়েছে সিন্ডিকেটিংয়ের কারণে।
২. তারমানে, তত্বাবধায়ক সরকার এসে যদি সাথে সাথে চালের সিন্ডিকেট এবং এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বাকী দুই সিন্ডিকেটের (সার আর তেলের সিন্ডিকেট) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো, তাহলে ২০০৭ এর জানুয়ারীতে চালের দাম করা যেত ১৪ টাকা কেজি। কিন্তু সেটা তারা পারেননি -- আমরা জানি।
এখন আবার কিছু ফ্যাক্টসের দিকে নজর দিই:
১. তত্বাবধায়কের আমলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম অতিরিক্তরকম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিলো।
২. এর ফলে সেসময় প্রাকৃতিক মুদ্রাস্ফীতিও বেড়ে গিয়ে সব জিনিসের দাম এমনিতেই বাড়ার কথা।
পরিসংখ্যান বলে সেটা ছিলো ১০% এর মতো।
৩. কাজেই ১০% হারে বেড়ে তত্বাবধায়কের দুবছরে চালের দাম হবার কথা ২৪ টাকা ২০ পয়সা।
৪. কিন্তু ২০০৭ এর শেষদিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট প্রকট হয়ে ওঠে, বিশেষ করে চালের চাহিদার তুলনায় যোগান অনেক কমে যায়।
৫. তদুপরি বাংলাদেশে সিডর নামক এক ভয়াবহ ঝড় হয়।
৬. শোনা যায় তত্বাবধায়ক সরকারকে ঝামেলায় ফেলার জন্য ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করে সিন্ডিকেটিংকে আরো জোরদার করে তোলে।
আসুন আবার একটু হিসেব মিলাই:
উপরের ১,৪,৫, ৬ -- এই চার প্রভাবকের কল্যাণে মোটা চালের দাম ২০০৮ এর শুরুর দিকে বেড়ে গিয়ে ৩৩ টাকা পর্যন্ত হয়!! যে চালের দাম ২৪ টাকা হবার কথা তার দাম ৩৩ টাকা মানে, ৯ টাকা বাড়ার পেছনে যে চারটি কারণ সেগুলো হলো, সিন্ডিকেট, সিডর, তেলের দামবৃদ্ধি, খাদ্যমন্দা।
এখন আবার কিছু ফ্যাক্টস:
১. আনন্দের বিষয় হলো তত্বাবধায়ক সরকার থাকতে থাকতেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের ঝামেলা দূর হয়ে যায়। তাছাড়া সিডর টাইপের দুর্যোগ তো যে বছর আসে শুধু সে বছরই প্রভাব ফেলে।
কাজেই বর্তমান চালের দরে এ দুটোর কোন প্রভাব থাকার কথা না।
২. ২০০৮ এর শেষ দিকে হঠাৎ করে তেলের দামও একই বেগে উল্টোপথে কমা শুরু করে।
কমতে কমতে অপরিশোধিত তেলের দাম আগের দামের প্রায় ৩০% এ নেমে এসেছে। তেলের দাম কমার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য জিনিস, বিশেষ করে চালের বেলা প্রযোজ্য সারের দামও চরম গতিতে কমে এসেছে।
কাজেই বর্তমান চালের দরে এটার বাড়তি প্রভাব তো পড়ার কথাইনা, বরং একারণে চালের দাম কিছুটা কমা উচিত।
৩. বলা যায় যে উপরের ১ আর ২ এর কারণেই তত্বাবধায়কের শেষদিকে চালের বাজারদর ২৭ টাকায় নেমে এসেছিলো, মানে উপরের তিন ফ্যাক্টরের প্রভাব ছিলো কেজিপ্রতি ৬ টাকা।
এখন আবার একটু হিসেব মিলাই:
বিএনপি আর তত্বাবধায়ক সিন্ডিকেট দমায়নি।
একদল তৈরী করেছে, আরেকদল ভিকটিম হয়েছে। আমরা এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা করি তারা সিন্ডিকেট দমাবেন।
তাহলে প্রশ্ন থাকে, বর্তমান সরকার তত্বাবধায়কের আমলের ২৭ টাকা কেজির চাল সিন্ডিকেট দমিয়ে কততে নামাতে পারবে?
আবার কিছু ফ্যাক্টস:
১. সিন্ডিকেটিংয়ের প্রভাব -- চালের সিন্ডিকেটিং, তেলের সিন্ডিকেটিং আর সারের সিন্ডিকেটিং। এ তিনটির প্রভাবে তত্বাবধায়কের আমলে চালের দামে প্রভাব পড়েছিলো ৩ টাকা, উপরের ৯ -৬ = ৩।
২. অর্থাৎ সিন্ডিকেটিংয়ের এর প্রভাবে চালের বাড়তি দাম দিতে হয়েছিলো বি এনপি আমলে কেজিপ্রতি ৬ টাকা, আর গত আমলে ৩ টাকা -- মোট ৯ টাকা।
বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশাই সিন্ডিকেটিংয়ের প্রভাব দূর করে গরীব লোককে যাতে আর এই বাড়তি ৯ টাকা দিতে না হয়।
ফাইনাল হিসাব:
২৭ থেকে ৯ বাদ দিলে চালের দাম হওয়া উচিত, ১৮ টাকা। ধরলাম এতদিন পর্যন্ত গেঁড়ে থাকা সিন্ডিকেটের প্রভাব পুরোপুরি দূর করা সম্ভব না। ওকে আরো ২ টাকা ছাড় দিলাম।
হিসেব করে দেখলাম, চালের দাম হওয়া উচিত প্রতি কেজি ২০ টাকা।
(ভোটের পরদিন এক সিএনজিওলা আমাকে বলেছিলো, ২০ টাকা হইলেই খুশী)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।