আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইমরানের মৃত্যু

এখানে প্রকাশিত লেখার সত্ত্ব সংরক্ষিত। 'ধর্ষণকে যে আপনি নিকৃষ্টতম কইরা তুলেতেছেন সেইটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গিরই কারনে। যৌনতার উপর এতটা বাধা নিষেধ কিংবা গুরুত্বারোপ করা থেকেই ব্যাপারটা বিশেষ হইয়া উঠছে। তা না হইলে যে কোন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের মতই কি এইটা না?' রাস্তার পাশেই পার্কের প্রান্তে নজরুলের মাজারের ঠিক উল্টা দিকে বইসা সরদার ফারুক আজ সার্ত্রের ভাব পাইয়া গেলেন মনে হইলো। চারুকলার সড়ক ও তার আশেপাশে , পার্কের ভেতরে, মজিদের চায়ের দোকানের ঘুপচি, গোলচক্করট, সর্বত্রই অজস্র মানুষ কথা বলতেছে।

তাদের মিলিত শব্দসমষ্টি একটি সমন্বিত অর্থহীনতা তৈরি কইরা চলছে সারাক্ষনই। ফলে, বিষয়টা এইরকম যে, আপনি শুনতেছেন আবার শুনতেছেন না। যাকে বলে, এর মধ্যেই কিন্তু আপনার কণ্ঠস্বর আছে। সরদার সাহেব আপনার কথা শুনতেছেন আর আপনি সরদার সাহেবের। অর্থাৎ বইয়ের ভাষায় বললে, 'পারষ্পরিক বাক্যালাপ'।

তিনি বুঝমান লোক। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি পণ্ডিত জাঁক রনে তার 'ঈশ্বরের সূত্র’ বইয়ে বলতেছেন, ‘সৎকার কিছুই নয়, মারা গেলে লাশ পচে যাতে গন্ধ না হয় এজন্যই লোকে সেটা নানা ফন্দিফিকির করে হাপিশ করে দেয়। ’ বিষয়টা মর্মান্তিক, তবু এর যে একটা ব্যবহারিক গুরুত্ব আছে সেইটা উপলব্ধির পরও সরদার সাহেব খানিকটা আবেগি হইয়া ওঠেন। যেন তিনি নিজেই তার লাশের পরিনতি দেখতে পাচ্ছেন। তাকে অতিক্রম করবার কালে ভ্রাম্যমান বাদামওয়ালার ঝুড়ি থেকে দুইটা বাদাম তুলে নেন সরদার সাহেব।

বিষয়টা পাশের এক উঠতি মডেলের চোখে পড়লে সে দশটাকার বাদাম কিনে ছেলেটার ব্যবসায় সহায্য করার আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। সরদার জানেন তার নেয়া বাদামদুইটা ওই তরুনির হইতে পারে আবার নাও হইতে পারে, তবে কিছুতেই বাদামওয়ালা ছেলেটার নয়। কেননা সে বাণিজ্য করে। বানিজ্য প্রসঙ্গ আসলে আপনার মনে পড়ে সিন্দাবাদের কথা। সিন্দাবাদের কীসের বাণিজ্য ছিল এইটা ভাবতে গিয়া আপনি সরদার সাহেবের কথার কিছু অংশ মিস করে যান।

উপরন্তু তার এক্সপ্রেশন ভালো না। সব কথা একই ভঙ্গিতে বলেন। গলার স্বরেরও তেমন ওঠানামা নেই। এতে কইরা আপনি যে তার মুখমণ্ডল দর্শন করে আগের কথাটার ব্যাপারে কিছু একটা অনুমান করবেন, সেইটা আর ঘটে না। অবশ্য এ ব্যপার নিয়া আমরা চিন্তিত নই।

জগতের অধিকাংশ গুরু ও গম্ভীর কথা না শুনতে পাওয়ার কারনে আপনার বাইচা থাকার সবিশেষ লাভ ক্ষতি হয় নাই। এই পার্কে আপনার চারপাশে শুধু সৃষ্টিশীল ছেলেমেয়ে। সরদার সাহেবের ভাষায়, ‘ভং, সবগুলা ভং ধইরা থাকে। ওরা ভাবে ছোটলোকে রবীন্দ্রসংগীত শুনলে ওগোর জাত যাইবো। ডাক দ্যান তো দেখি যেকোন একটারে, হুমায়ুন আহমেদ ক্যান খারাপ লেখক এইটা বলতে পারে কিনা শুনি।

আপনি বললেন, ‘বস, উনি তো ভালো লেখক’। সরদার সাহেব মাছি তাড়ানো ভঙ্গিতে বলেন, ‘প্রসঙ্গে থাকেন মিয়া, ভালো নিয়া তো আমরা আলাপ তুলি নাই। ’ কথা সত্য। আপনি চেপে যান। এরপর তিনি আপনাকে চা খাবার প্রস্তাব দেন।

তখন আপনার মধ্যে চায়ের তৃষ্ণা তৈরি হয় অথবা আগে থেকে থাকা তৃষ্ণাটা চাগা দিয়া ওঠে। গুড়ের চা খাইতে হাটা দেন মজিদের দোকানের দিকে। জাপানি দার্শনিক কিম জং একবার বলছিলেন, ‘খাদ্যের কথায় মানুষের মুখের ভেতরটা যে ভিজে ওঠে এটা তার প্রানিসত্ত্বার এক অমূল্য বৈশিষ্ট্য। আর এরকম কিছু বৈশিষ্ট্যের কারনেই মানুষ পৃথিবীতে টিকে আছে। ’ ফলে, চায়ের তৃষ্ণাকে যথেষ্ট প্রানীজ এবং প্রসঙ্গিক মনে ইহতে থাকে আপনার।

মজিদের দোকানেই, নাটকে অভিনয় করে এইরকম অগুরুত্বপূর্ণ, অলস সময় কাটাইতে পারে এমন কিছু তরুন তরুনির সঙ্গে দেখা হয় আপনাদের। সরদার সাহেবকে তারা ঘিরে ধরে কলকাকলি করতে থাকে। এর মাধ্যমে সরদার সাহেবকে কেন্দ্র করে যে বৃত্ত তৈরি হয়, আপনি তার বাইরে পইড়া যান। সরদার সাহেব ওইসব উচ্ছলতার মোকাবিলা কইরা আপনার পাশে আইসা বসেন। সম্ভবত তার কথা বলতে ভালও লাগতেছে না।

এর মধ্যেই হঠাৎ ইমরান চইলা আসলে আপনার যতটা চমকাবার কথা আপনি ততটা চমকে ওঠেন না। বরং একধরনের নির্লিপ্তি আপনাকে পেয়ে বসে। কিছুকাল আগে ওকে হত্যা করা হয়েছিল। বাঞ্ছারামপুর বাজারের পাশে ছিল ইমরানদের বাড়ি। পড়াশুনাসূত্রে ঢাকায় থাকতো।

ঢাকায় যারা লেখাপড়া করে মাঝে মাঝে ছুটি পাইলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু না। কিন্তু কে জানতো ওই যাওয়াটাই তার কাল হবে! সে বাঞ্ছারামপুর গেছিল। ওইখানে গিয়া এক দাবা খেলায় জড়াইয়া পড়ে ইমরান। দাবা খেলা ব্যাপারটা আপনি অপছন্দ করতে পারেন বা বিষয়টা নিয়া আপনার আপত্তি ও থাকতে পারে। কিন্তু এমন তো দেখাই যায় অবসরে কেউ দাবা নিয়ে বসছে।

তারপরও আপনি যদি বলেন দুনিয়ায় এত খেলা থাকতে সে কেন দাবা নিয়া বসলো, সেইটার কোনো সঠিক উত্তর আমি দিতে পারবো না। তবু, অনুমানে বলা যায়, খেলাটা হয়তো তার ভালো লাগতো। কিংবা ওই অঞ্চলে দাবাটা খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠছিল অথবা নিছকই কাউরে খেলতে দেইখা ওর ভেতরে খেলার আগ্রহটা আসছিল। কিন্তু সেগুলা এখন কোনো অর্থ বহন করে না। কেননা ওইদিন সে দাবা-ই খেলছিল এবং খেলার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ি সে হইছিল সৈন্য।

বাঞ্ছারামপুরে দাবার নিয়ম হইলো আপনি খেলতে পারবেন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সৈন্য, হাতি, ঘোড়া, নৌকা, মন্ত্রী এগুলার মধ্যে যেকোন একটি আপনাকে হইতে হবে। অর্থাৎ একই সঙ্গে আপনি খেলায়াড় এবং ঘুটি। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় প্রথমে তার রক্ষন সামলায়, তারপর আচমকা এক আক্রমনে একটা সৈন্য মাইরা ফেলে, বোর্ডে তখন অন্যান্য সকলে উপস্থিত থাকলেও তাদের কিছুই করার ছিল না। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো সেই সৈন্যটাই ছিল ইমরান, অর্থাৎ খেলার নিয়ম অনুযায়ি যে ঘুটিটা তাকে সাজতে হয়েছিল। জগৎ যে স্রেফ একটা গোলমেলে ব্যাপার এই ঘটনায় তা আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

যদি সে কোনার দিকের সৈন্য না হইয়া মাঝামাঝি অবস্থিত কোনো সৈন্য হইতো তাহলে নিশ্চয়ই সে মারা পড়তো না, অথবা তখন মারা পড়তো না, অথবা অনেকক্ষন খেলাটা চালাইয়া যাইতে পারতো, অথবা সে বোর্ডে থাকা অবস্থায় খেলাটার একটা মীমাংসাও অসম্ভব ছিল না। তবু, ওই সৈন্যটাই ছিল ইমরান এবং সে মারা পড়ছিল। সরদার সাহেব অবশ্য এই ঘটনার সঙ্গে রিফাতের সম্পর্ক দেখেন। তারা ছিল পরষ্পর বন্ধু। দাবা খেলতে আসার পথে রিফাতের সঙ্গে ইমরানের দেখা হইলে ইমরান তারে সিগ্রেট অফার করে।

রিফাতের হয়তো তখন অন্য কোনো কাজ ছিল, অথবা সেও হয়তো কোনো খেলার উদ্দেশে বাসা থেইকা বের হইছিল, অথবা বাজারের পাশের তিনতলা বাড়িটার জানলা খোলার সময় হইছে তখন, অথবা নিতান্তই ‘ভাল্লাগতেছেনা’ বইলা সে তার অফারটা ফিরাইয়া দেয় আর তখন ইমরান দাবা খেলার ক্লাবের দিকে চইলা যায়। সরদার সাহেব বলেন, যদি তারা দেকানের পাশে দাঁড়াইয়া একটা সিগ্রেট টানতো, অথবা দুইজনে দুইটা, তাইলে ইমরান হয়তো বোর্ডের উত্তর দিকের সৈন্য না হইয়া দক্ষিন দিকের সৈন্য হইতো, অথবা সে কালা না নিয়া সাদা ঘুটি নিয়া খেলায় নামতো, অথবা এসব কিছু ঠিক থাকলেও সে হয়তো ‘এখন খেলুম না’ বইলা বোর্ড উল্টাইয়া দিয়া চইলা আসতো। মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে(একটা বা দুইটা সিগ্রেট টানার সময়টা) ইমরানের সঙ্গে সম্পর্কিত এই দাবা বিষয়ক সকল ঘটনা কি একই রকম হইতো? একটু থাইমা সরদার আবার বলেন, নিশ্চিতভাবেই না। কেননা তখন থাকতো পাঁচ মিনিট পরের সময়ের পৃথিবী ও তার বাস্তবতা। এসবের কিছুই না হওয়ায় সরদার সাহেব বিষয়টার জন্য রিফাতরে দায়ি করলে আপনার অবশ্য তার যুক্তি না মাইনা উপায় থাকে না।

যদিও সরদার এবং আপনি উভয়ই জানেন সৈন্য মারা যাবার বিষয়টি রিফাতের কোনোভাবেই আগে থেইকা অনুমান করা সম্ভব ছিল না। আর এইটাও তো সবাই জানে বাঞ্ছারামপুরের দাবা খেলায় কোনো হিসেব নিকেশ চলে না। যে কেউ যে কোনো সময়ে মারা পড়তে পারে। অনেক নামকরা খেলোয়াড় উপজেলা, জেলা, শহর উপশহর, উনশহর, অধিশহর, মহাশহর, লোহাশহর, হাড্ডিগঞ্জ, গাছনগর, হাসপুর ইত্যাদি জায়গা থেইকা আইসা বাঞ্ছারামপুরের দাবা খেলা দেইখা প্রশংসার সার্টিফিকেট দিছে। বিশ্বাস না হইলে আপনে বাজারের ক্লাব ঘরটায় গিয়া দেখতে পারেন।

আর যারা নিজেদের নিয়া গর্ববোধ কইরা স্থানীয়দের চ্যালেঞ্জ জানাইছে তাদের হাইরা যাওয়া ছবি, তর্জনী এবং বৃদ্ধ আঙুলের কংকাল ক্লাবের আলমারির তিন নম্বর তাকের বয়ামগুলায় রাখা আছে। অর্থাৎ আপনি যেখান থেকেই আসেন না কেন অংশগ্রহন করতে চাইলে একই সঙ্গে খেলোয়াড় এবং খেলার ঘুটি আপনাকে হইতেই হবে। ফলে, ইমরানের মৃত্যু একটা ধারাবাহিক ঘটনার অংশ হিসেবে দেখাই শ্রেয়। আপনি বা অনেকেই জানেন, যখন সে মারা যায়, তার সামনে তখন কুয়াশার একটা গোলাকার খণ্ড আইসা পড়ে। সেইটা ক্রমান্বয়ে তাকে ঢাইকা ফেলে।

অন্যেরা না জানলেও ওই কুয়াশার মধ্যে অনেকগুলা মুখ দেখে সে। যদিও আপনি এটাকে স্বপ্নদৃশ্য মনে করতে পারেন, যখন আপনি জানেন যে, যাচাই করবার মতো কোনকিছুই আর আপনার হাতে নাই। সেই দৃশ্যের ভেতরে মা, প্রেমিকা, দুই একজন বন্ধু, বহুদিন আগে একবার মাত্র দেখা এক গ্রাম্য বাউল সবাই তাদের মুখে আশ্চর্য নির্লিপ্তি নিয়া তার দিকে তাকায়া থাকে। কিছুটা ছাড়া ছাড়া আর টেলিভিশনের চ্যানেল বদলানোর মত করে দৃশ্যগুলা বদলায়। অন্যেরা কেবল দেখে কুয়াশা অর্ধস্বচ্ছ বলের আকৃতিতে ইমরানকে আবদ্ধ করে।

তো, সেই ইমরান যখন আপনার সামনে আইসা পড়ে তখন সেইটারে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে উড়ায় দেয়া যায় না। মৃত লোক আমাদের সামনে আবির্ভূত হইলে আমরা অতঙ্কগ্রস্ত হই, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। পার্কের দুই নাম্বার গেট দিয়া তখন একদল তরুন লাঠি, চাপাতি আর লোহার রড নিয়া কারে যেন খোঁজে। তারা আপনার দিকে আগায়। ইমরানের খোঁজ জানতে চায় আপনার কাছে।

আপনি তাদের বলেন, ইমরান তো মারা গেছে। বিশ্বাস না হইলে যেন তারা বাঞ্ছারামপুরের দাবা ক্লাবে গিয়া দেয়ালে ঝোলানো গাদা ফুলের মালা পরানো ইমরানের হাসিমুখের ছবিটা দেইখা আসে। তারা বিরক্ত হইয়া আপনারে বলে, ইমরান কোনোদির বাঞ্ছারামপুর যায় নাই, এমনকি বাঞ্ছারামপুর নামে কোনো জায়গারই অস্তিত্ব নাই পুরা পৃথিবীতে। আপনার পাশে বসা সরদার সাহেবের মনে হয় আসলেই হয়তো নাই, হয়তো তিনশ বছর আগের ঐতিহাসিক সেই তের সালের ভূমিকম্পে ওই এলাকাটা স্রেফ ‘নাই’ হইয়া গেছে। ছেলেগুলার বয়স কোনমতেই তিনশ বছর হবে না, ফলে ওদের তরফ থেকে কথাটায় কোনো মিথ্যা নাই।

ছেলেগুলা শিকার খোঁজার মত সন্তর্পনে চলে যায়। সরদার সাহেব তখন আপনার দিকে তাকাইয়া বুঝতে পারে, আপনিই ইমরান। যে কয়টা গুড়ের চায়ের অর্ডার দিছিলো তার থেকে একটা কমাইয়া সে তখন আবার অর্ডার দেয় দোকানদার মজিদ ভাইরে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.