শবেবরাত
'ঐ সকল নতুন সৃষ্টি, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না'৷ শারঈ অর্থে-
'যে ব্যক্তি আমাদের শরী'আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত'৷১ তিনি আরও বলেন, ... 'তোমাদের উপরে
মুত্তাফাক্ব আলাইহ, আলবানী, মিশকাত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) হা/১৪০৷
পালনীয় হ'ল আমার সুন্নাত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত৷ তোমরা উহা কঠিনভাবে অাঁকড়ে ধর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর৷ ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি হ'তে সাবধান! নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ'আত ও প্রত্যেক বিদ'আতই গোমরাহী'৷ নাসাঈ শরীফের অন্য ছহীহ বর্ণনায় এসেছে 'এবং প্রত্যেক গোমরাহ ব্যক্তি জাহান্নামী'৷২ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত মূলতঃ রাসূলেরই সুন্নাত৷ কারণ তাঁরা কখনোই রাসূলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদনের বাইরে কোন কাজ করতেন না৷ যুগে যুগে বৈষয়িক প্রয়োজনে সৃষ্ট বিভিন্ন আবিষ্কার সমূহ যেমন সাইকেল, ঘড়ি, চশমা, মটরগাড়ী, উড়োজাহায ইত্যাদি বস্তুসমূহ আভিধানিক অর্থে বিদ'আত বা নতুন সৃষ্টি হ'লেও শারঈ পরিভাষায় কখনোই বিদ'আত নয়৷ তাই এগুলোকে গুনাহের বিষয় বলে গণ্য করা অন্যায়৷ অনেকে এগুলোকে অজুহাত করে ধর্মের নামে সৃষ্ট মীলাদ, কি্বয়াম, শবেবরাত, কুলখানি, চেহলাম ইত্যাদিকে শরী'আতে বৈধ কিংবা 'বিদ'আতে হাসানাহ' বলে থাকেন, যেটা আরো অন্যায়৷ বরং বিদ'আতকে দু'ভাগে ভাগ করাই আরেকটি বিদ'আত৷
প্রচলিত শবেবরাত
আরবী শা'বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে 'শবেবরাত' বা 'লায়লাতুল বারাআত' বলা হয়৷ 'শবেবরাত' শব্দটি ফারসী৷ এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি৷ দ্বিতীয় শব্দটি আরবী৷ যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি৷ এদেশে শবেবরাত 'সৌভাগ্য রজনী' হিসাবেই পালিত হয়৷ এজন্য সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়৷ লোকেরা ধারণা করেন যে, এ রাতে বান্দাহ্র গুনাহ মাফ হয়৷ আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি করা হয়, সারা বছরের হায়াত-মউতের ও ভাগ্যের রেজিষ্ট্রার লিখিত হয়৷ এই রাতে রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে৷ বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে৷ এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন৷ বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে আলোকিত করা হয়৷
২. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৬৫; নাসাঈ হা/১৫৭৯ 'ঈদায়েন-এর খুত্বা' অধ্যায়৷
অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়৷ এজন্য সরকারী পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়৷ আত্মীয়রা সব দলে দলে গোরস্থানে ছুটে যায়৷ হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়৷ ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে রাত কাটিয়ে দেয়৷ যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে 'ছালাতে আল্ফিয়াহ' বা ১০০ রাক'আত ছালাত আদায়ে রত হয়, যেখানে প্রতি রাক'আতে ১০ বার করে সূরায়ে ইখলাছ পড়া হয়৷ তারপর রাত্রির শেষ দিকে ক্লান্ত হয়ে সবাই বাড়ী ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন৷ একসময় ফজরের আযান হয়৷ কিন্তু মসজিদগুলো আশানুরূপ মুছল্লী না পেয়ে মাতম করতে থাকে৷ ১৪ কোটি মুসলমানের এই দরিদ্র দেশে এই রাতকে উপলক্ষ্য করে কত লক্ষ কোটি টাকা যে শুধু আলোকসজ্জার নামে আগরবাতি ও মোমবাতি পুড়িয়ে শেষ করা হয়, তার হিসাব কে রাখে? রকমারি বিদু্যত্বাতি, হালুয়া-রুটি, মীলাদ ও অন্যান্য মেহমানদারী খরচের হিসাব না হয় বাদই দিলাম৷ সংক্ষেপে এই হ'ল এদেশে শবেবরাতের নামে প্রচলিত ইসলামী পর্বের বাস্তব চিত্র৷
ধমর্ীয় ভিত্তি
মানুষ যে এত পয়সা ও সময় ব্যয় করে, এর অন্তর্নিহিত প্রেরণা নিশ্চয়ই কিছু আছে৷ মোটামুটি দু'টি ধমর্ীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে থাকে৷ ১- ঐ রাতে বান্দাহ্র গুনাহ মাফ হয়৷ আগামী এক বছরের জন্য ভালমন্দ তাক্বদীর নির্ধারিত হয় এবং এই রাতে কুরআন নাযিল হয়৷ ২- ঐ রাতে রূহগুলি ছাড়া পেয়ে মর্ত্যে নেমে আসে৷ মোমবাতি, আগরবাতি, পটকা ও আতশবাজি হয়তো বা আত্মাগুলিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবার জন্য করা হয়৷ হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ঐদিন আল্লাহ্র নবী (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল৷ ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়৷ অথচ ওহোদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়৷৩
৩. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২০১-২৷
আর আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু'মাস পূর্বে শা'বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে...! এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধমর্ীয় ভিত্তি কতটুকু তা খুঁজে দেখব৷ প্রথমটির সপক্ষে যে সব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয় তা নিম্নরূপঃ ১- সূরা দুখান-এর ৩ ও ৪ নং আয়াত-
অর্থঃ (৩) আমরা তো ইহা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী (৪) এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়'৷৪ হাফেয ইবনে কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, 'এখানে মুবারক রজনী অর্থ লায়লাতুল ক্বদর'৷ যেমন সূরায়ে ক্বদর ১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন,#১৬১৮;্#১৫৮৫;্#১৬১৬;- অর্থঃ 'নিশ্চয়ই আমরা ইহা নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে'৷ আর সেটি হ'ল রামাযান মাসে৷ যেমন সূরা বাক্বারাহ্র ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
অর্থঃ 'আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রামাযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে শা'বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনি৷ শেষের দিকে তিনি মাত্র কয়েকটি দিন ছিয়াম ত্যাগ করতেন'৷২৩ যারা শা'বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম পালন করেন, তাদের জন্য শেষের পনর দিন ছিয়াম পালন করা উচিত নয়৷২৪ অবশ্য যদি কেউ অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের দিকেও ছিয়াম পালন করবেন৷২৫
মোটকথা শা'বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম পালন করা সুন্নাত৷ ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা সুন্নাতের বরখেলাফ৷ অবশ্য যারা 'আইয়ামে বীয'-এর তিন দিন নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই২৬ শা'বানে উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন, শবেবরাতের নিয়তে নয়৷ নিয়তের গোলমাল হ'লে কেবল কষ্ট করাই সার হবে৷ কেননা বিদ'আতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না এবং সকল প্রকার বিদ'আতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত৷ আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজ নিজ আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন! আমীন!!
২৩. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৬৷
২৪. আবুদাঊদ, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/১৯৭৪
২৫. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৭৩, ২০৩৮৷
২৬. নাসাঈ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২০৫৭৷
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।