ব্যস্ত সড়কটার দুপাশে সারি সারি খাবারের দোকান। ফাস্টফুড শপ! বিশাল শপিং মলগুলো থেকে বেরিয়ে আসা মানুষেরা এখানে ঢোকে। তরুণ-তরুণী,পৌঢ়-পৌঢ়া,বাবা-মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা।
হাসতে হাসতে ঢোকে,হাসতে হাসতেই বের হয়। মাঝের সময়টুকুতে যে কি হয়,কিছুই জানে না শাহানা।
আচ্ছা,ওই বন্ধ দরজা গুলোর ওপাশে আসলে কি হয়? কি এমন খায় মানুষগুলো যে এত সুন্দর গন্ধ আসে? মনে হয়-ফুল বেচা বাদ দিয়ে সারাদিন দোকানের সামনেই দাড়িয়ে থাকে। বাবুর মত!
এই যে বাবু যে রকম সারাদিন এখান দিয়েই ঘোরাফেরা করে;হাতে থাকে ফেলে দেয়া একটা কাগজের গ্লাস। মাঝে মধ্যে কোক-পেপসিও পায়। নরম-সরম চেহারার মেয়েরা সেই সাথে দু-একটা টাকাও দেয়,হাসি মুখে নাম জানতে চায়। সারাদিনে ভালোই ইনকাম বাবুর,আট-দশ টাকা।
"প্যাট পুড়তাছে,আফা। গোন্ধে প্যাট পুড়তাছে!"
ভাইয়ের হাত ধরে কাছে টানে শাহানা,নিজের ছেড়া ফ্রকে মুখ মুছিয়ে দেয়।
"তরে না কতবার কইছি,এই খানে না আইতে?"
"কি করুম,আফা! গোন্ধটা এত ভালা লাগে!'
"গোন্ধ শুঁইকে লাভ কি?খাইতে তো আর পারবি না। "
বাবুর মুখটা আরও একটু যেন শুকিয়ে যায়,"হের লাইগাই তো গোন্ধ শুঁইকে মন ভরাই,আফা। ... .. আইচ্ছা আফা,এই গুলানই মনে হয় বেহেশতী খানা.. ..না?"
ভাইযের কথার জবাব না দিয়ে হাত ধরে একটু দূরে সরে আসে শাহানা।
একটা রিকশাওয়ালা ব্যাটা কেমন করে জানি তাকাচ্ছিল। আজকাল বস্তির অনেক ব্যাটাই কেমন কেমন করে তাকায়। সেই দিন তো ছেঁড়া জামার ফাক দিয়ে বাড়িওয়ালা নানায়.. .. ..
মাকে বলেছে। কিন্তু কি লাভ?
বারো বছর বয়স তার,এখন সবই বোঝে সে। সব সমস্যার যে সমাধান হয়না এই পৃথিবীতে,ভালো করেই জানা হয়ে গেছে তার।
মা অবশ্য বলেছে বেগম সাহেবার কাছ থেকে পুরান সালোয়ার-কামিজ চেয়ে আনবে। পাচটা বাসায় ঠিকা কাজ করে মা,তাদেও মাঝে একজন বেগম সাহেবা খুবই ভালো। মাঝে মাঝেই মুরগীর গলা-গিলা,মাছের কাটাকুটি,ফ্রিজে রাখা বাসি তরকারি বা মিষ্টি দিয়ে দেয় মাকে। ঈদের দিন গেলে ফিরনীও খেতে দেয়।
"খুবোই ভালা মানুষ!"মনে মনে তাকে দোয়া করে শাহানা।
একদম অন্তর থেকে। সালোয়ার-কামিজ পাওয়া গেলে এই মহিলার কাছ থেকেই পাওয়া যাবে।
.. ..আচ্ছা,কি রঙ হবে?.. ..হে খোদা,রঙটা জানি গোলাপী হয়!একদম ছেঁড়া হলেও সমস্যা নেই.. ..
"প্যাট পুড়তাছে,আফা!' আবার বলে বাবু।
আসলেই তাই। এত সুন্দর গন্ধ যে শাহানারও কেমন কেমন অস্থির অস্থির লাগে।
গত রাতে কয়টা ভাতের পর আর কিছু খাওয়াও হয়নি। ইনকাম খুব ভালো হলে কোনো কোনো দিন দুপুরে ভাই-বোন মিলে রুটি খাওয়া হয়। দশ টাকায় দুটো আটার রুটি,পাঁচ টাকার ডাল। এত বড় বড় যে ওই একটা রুটি পেটে গেলে সারাদিন আর কিছু খাওয়া লাগে না।
মাসের প্রথম দিকে অবশ্য সকাল বেলা গরম ভাত রান্না করে দুজনকে খাইয়ে তবেই কাজে যায় মা।
ভোর ছযটা থেকে কাজ,তাই পাঁচটার মাঝেই রানআ শেষ করে। ঘুম থেকে উঠে আলু ভর্তা দিয়ে গরম ভাত খেতে কি ভালোটা যে লাগে!
ভেবেই জিভে পানি চলে আসে শাহানার। একটু লজ্জিতও হয়। মাসের শেষ দিকে হাতে টাকা থাকে না তো কি করবে মা?তবুও বেতন পাওয়ার পর বিরানী খাওয়ায়।
বড় হোটেল বা বিয়ে বাড়ির সামনে একটু রাত করে গেলেই পাওয়া যায় খাবার।
ফেলে দেয় সব খাবার ঝুড়ির মধ্যে একত্রিত করে প্লেট কেটে কেটে বিক্রি করা হয়। দশ টাকা প্রতি প্লেট। তাতে যা ওঠে,সেটুকুই। হাড্ডি উঠলে হাড্ডি,আলু উঠলে আলু। কপাল খুব ভালো থাকলে এক আধ টুকরা মাংসও পাওয়া যায় কখনও।
ধনী লোকের উচ্ছিস্ট খাবার এসব,জানে শাহানা।
কিন্তু তাতে কি?খাবার তো খাবারই হয়.. ..
ভাইকে আদর করে কাছে টেনে নেয় সে,"আইজকে মা ব্যাতন পাইলে বিরানী খামুনে!"
"কিন্তুক যদি না পায়?"
''তাইলে বাড়ি ওয়ালা নানার থেইকা দশ ট্যাকা ধার করমু। "
এবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আট বছরের বালকের চেহারা। "সত্যি খাওয়াইবি,আফা?"
"সত্যি!"
"আমি কিন্তুক বেশী খামু। "
"আইচ্ছা!"
"মাংস পাইলেও কিন্তুক আমি নিমু।
"
"ঠিক আছে!"
"আলু পাইলেও আমার.. .."
"আইচ্ছা,সব তোর.. .."
পরিশিষ্ট --
একটা নামকরা পত্রিকার ছোট্ট এক কোনে ছাপা হয়েছিল সংবাদটি।
অবশ্য সংবাদটি মূল্যহীনই বটে!
এই শহরের কোনো এক বস্তিতে বসবাসরত কোনো এক স্বামী পরিত্যাক্তা ঠিকা ঝি-এর দুটি ছেলে-মেয়ে রহস্যময় ফুড পয়জনিংয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
গোটা সংবাদটিতে একমাত্র "রহস্যময়" শব্দটিই যা একটু আর্কষনীয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।