আমার যখন তিন বছর বয়স, আমি আমার নানা নানুর সাথে থাকতাম খুলনায়। আমার নানা ছিলেন জেলা জাজ। একাটা বিশাল ব্রিটিশ আমলের বাড়িতে থাকতাম আমরা। ছোট বেলায় সামনের ঐ বাগানটাকে মনে হতো অনেক বিশাল। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা যেত না ( আমার কাছে)।
বড় হয়ে একবার গেলাম সেখানে দেখলাম আসলে বাগান টা ততো বাড় নয়। ছোট বেলা নিজের সাইজের কারনে ওটাকে অনেক বড় মনে হতো। বাড়িটও অত বড় নয়, হা হা হা! দোতালা লাল ইটের বাড়ি।
পিছনে ছিল রুপসা নদী। তার পাশে আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল একাটা শেফালি ফুলের গাছ।
আমি যখন ফুল কুড়াতে যেতাম তখন দেখতাম নদী দিয়ে লম্বা লম্বা ট্রেন যায় আর ওগুলো পানির ভেতর ঢুকে যায় আস্তে আস্তে। ওখান থেকে চলে আসবার পর অনেক বড় হয়েও ব্যপারটা নিয়ে ভাবতাম। এটা কি করে হয়। পরে উদ্ধার করলাম। আসলে ষ্টিমার গুলো আমার ছোট সাইজে অনেক বড় মনে হতো ট্রেনের মতো।
আমাদের বাড়ির দারওয়ান বা মালীর ছেলের সাথে আমি রান্না বাড়ি খেলতাম। ফেলে দেয়া বড়ই এর বিচি দিয়ে মাংস বানিয়ে রান্না করতাম আর সেই ছেলেকে জোর করে খাওয়াতাম আর বকা দিতাম না খেলে যেমন করে আমার নানু আমাকে বাকা দিত না খেলে। ও বেচারা জাজের নাতির ভয়ে কষ্ট হলেও ওগুল সত্যি খয়ে ফেলত। কখনও দেখা হলে মাফ চাইতাম। তার বাবা আমার নানুকে কমপ্লেন করেনত উনার ছেলে বড়ই এর বিচি হাগু করে জন্য।
আমার নানু আমাকে পিট্টি দিত। আজো অনুতাপে ভুগি ওকে কষ্ট দেবার জন্য।
আমার নানু এক পাগলিকে আমাদের নীচের ড্রয়িং রুমে কেন যে থাকতে দিতেন আজো আমার মনে এই প্রশ্ন। রোজ তাকে দেখতাম লাল ভেলভেটের পর্দার ফাক দিয়ে গুমাচ্ছে লাল কর্পেটের উপর উপুর হয়ে চুল এলোমেলো করে। কখনও তার মুখ দেখতে পাইনি।
সব সময় সে ঘুমাতো। সবাই বলতো সে পাগল। খুব ভয় পেতাম তাকে আমি। আমার পাগল ভিতি ওখান থেকেই এসেছে। খারাপ লাগে এখন ভেবে কেন ওকে ভয়পেয়ে কোনদিন কথা বলিনি।
আর ভয় পেতাম এক বোবা ফকিরকে, আমার নানুর বাধা ফকির ছিলেন উনি। ফকির যে বাধা হতে পারে তার আগে জানতাম না। আমি সেই ফকিরকে ভিষন ভয় পেতাম কারন সে কথা বলতে পারত না, অদ্ভুৎ শব্দ করতো মুখে । দোতালার বারান্দায় যদি আমি খেলছি আর ওকে আধা মাইল (আমার ছোট সাইজের দর্ৃষ্টিতে) দুরে গেটের ভেতর ঢুকতে দেখতাম আমি বারান্দার মেঝেতে শুয়ে পরতাম যাতে সে আমায় দেখতে পর্যন্ত না পারে, যেন চোখ দিয়ে ও আমাকে খেয়ে ফেলবে।
একাবার আমি নীচের বারান্দায় পোর্চে বসে খেলি।
দেখতে পারি নাই যে সে আসছে। যখন সে ২০ হাত দুরে আমার চোখ পড়ল তার উপর। আমার মনে হলো আমি মারা যাচ্ছি এত ভয় পেলাম। আমি আমার নানুর শাড়ি পেচিয়ে পরে রান্না বাড়ি খেলছিলাম মালির ছেলের সাথে। বোবা ফকির কে দেখা মাত্র দৌড় দিলাম সিড়ির দিয়ে উপরে, সিড়ি টা সেই পুরান আমলের লাল কার্পেটে মোড়া বাড়ীর মাঝখানে ছিল।
প্রথম ল্যন্ডিং এ যেই পৌছেছি অমনি পরে গেলাম পেচান শাড়ির কারনে।
গরিয়ে গরিয়ে ১০/১২ টা সিড়ি পরে নীচে এসে পড়লাম আর আমাকে কুড়িয়ে নিল সেই বোবা ফকির। গরিয়ে পাড়ার পর চোখ মেলে যেই দেখি আমি ওর কোলে সাথে সাথে সেন্স হারালাম ভয়ে। আজও পাপ বোধে ভুগি ওকে ভয় পাবার জন্য তবু এখনো বোবা ভিতি আমার রয়ে গেছে কিছুটা তার জন্য সত্যি লজ্জা পাই। এখনও ইচ্ছে করে খুলনা গিয়ে ক্ষমা চাই ঐ বোবা ফকিরের কাছে।
বড় হয়ে একবার গেলাম ওখানে। বাড়িটা কোন কারনে খালি ছিল। মালি আর দাড়োয়ানের সাথে দেখা হলো যারা আমাকে কাধে করে পুজো দেখতে নিয়ে যেত। আমাদের একটা হরিণ ছিল ওরা আমাকে হরিণটার পিঠে করে ঘোরাত। আমাকে দেখে চিনতে পারেনি।
যখন পরিচয় দিলাম কেদে ফেলল, আমকে খুকি খুকি করে জড়িয়ে ধরল। ওদের কাছে আমি এখনও ছোট্ট খুকিই আছি, কিযে ভাল লাগায় মন ভরে গেল!!!! ইচ্ছে করল ঐসব দিনে আবার ফিরে যাই, নানুর শাড়ির আচল ধরে বাগেনে টমেটো তোলা আর টমেটো গাছের ভেতর হারিয়ে গিয়ে ভয় পাওয়া (নিজের উচ্চতার কারনে)!!! হরিণের পঠে চরে ঘোড়া ঘোড়া খেলা!!! পুজো দেখতে যাওয়া আর আফসোস করা এই ভেবে আহারে ওরা কেন আমাকে ঐ বড় বড় পতুল গুলো না দিয়ে পানিতে ফেলে দিচ্ছে, কত বড় অপচয়!!! আমি ওদের কত যত্ন করে রাখতাম!!
ছোট বেলায় আমার যে কত রকমের ভয় ছিল! কত রকমের বোকামি ছিল। আজ তার অনেক গুলোকে কটিয়ে উঠেছি তবু কিছু কিছু রয়ে গেছে আজো!!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।