গেরিলা কথাবার্তা
একটা লক্ষনীয় ব্যাপার হলো, ইলেভেন বেশ একটা সিম্বল হয়ে উঠেছে। দুইহাজার এক-এ-ও এই সংখ্যাটি নিছক একটি ক্যালেণ্ডারের পাতা ছিল, সেপ্টেম্বরের নয় তারিখে এসে সেটি তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস তৈরী করল। বলা ভাল, ইতিহাসের ঘন্টা দুলিয়ে দিল। সর্বগ্রাসি জাতিরাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, এবং তার অধীনে বেড়ে ওঠা ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের ধারণারে টুনকো করে দিলো। তার ভিত্তিতেই এক সুপার স্টেটের ধারণাবাহি আমেরিকা শুরু করল ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজম।
মানে, কেবল সেই ধরণের টেররিজম, যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখে। জাতিরাষ্ট্র। তবে, মজার ব্যাপার হলো, এটি কেবল একটি সাধারণ রাষ্ট্র নয়, একটি সুপার স্টেট। আমেরিকা। তাই, দুই হাজার আটেও এই ইলেভেন তার দৌড়াত্ম্য বজায় রেখে চলেছে, ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজমের কল্যানে।
এই ইলেভেনের সাথে নিজেরে মেলানোর জন্য, আমাদেরকেও এখানে এগার একের ক্যুকে ওয়ান ইলেভেন নাম দিয়ে ডাকতে হল। কৌতুহলের বিষয় হলো, ইণ্ডিয়ারও এখন একটি নিজস্ব নাইন ইলেভেন হলো, তাদের মিডিয়াগুলো তাইতো উদযাপন করছে দেখলাম, গতকালকের মুম্বাইয়ে বোমা হামলার পর থেকে। বলছে, ইণ্ডিয়ার নাইন ইলেভেন। এটিরে আমি উদযাপন বলছি, খুব সতর্ক হয়েই। কারণ, আনন্দবাজার পত্রিকার এ সংক্রান্ত ষ্টোরিগুলো পড়লে বোঝা দায়, তারা গল্প লিখছে, নাকি খবর দিচ্ছে।
তারা রসিক বটে, সেই সাথে দেশটির অবচেতন কাঙ্ক্ষা এবং উৎসব খটকা দেয়।
এক তলার জানালা দিয়ে বাইরে লাট খেয়ে পড়ল দেহটা। কালো পোশাক। মাথা নীচে। পা উপরে।
একে রাত জাগা চোখ। তার উপর অন্তত পাঁচশো মিটারের দূরত্ব। ঠিকঠাক বোঝাও যাচ্ছিল না।
কে পড়ল? জঙ্গী? কমাণ্ডো? টিভি চ্যানেলের ভিউ ফাইণ্ডারে বারবার রিওয়াইণ্ড করে দেখা গেল, প্রথমে জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা রাইফেলের নল। তার কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানেই ভিতর থেকে কেই একজন ঠেলে ফেলে দিল দেহটা।
সেই ধাক্কা মারার মধ্যে বোধ হয় একটা তীব্র বিতৃষ্ণাও ছিল।
''বোধহয় ছিল'' লিখলাম! কেন যে লিখছি! নিশ্চয়ই ছিল। ..
এই সাহিত্য এবং গল্পের আবহের ভিতরেই আমরা খুব অবাক হয়ে দেখি, ইণ্ডিয়ান মিডিয়াগুলো এই জিম্মি নাটকের একটা বহিরাঙ্গই কাভার করেছে, যা কমাণ্ডোরা প্লে করেছে। তারা ঘটনাটির তাৎপর্যমূলক দিকগুলি কাভার করতে পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছে, শ্রেফ কমাণ্ডো অভিযানের প্রেক্ষিতটাই তাদের মূল বিবরণ। কিন্তু হামলাকারীরা স্রেফ আত্মঘাতি হতে তো এখানে আসে নাই, তাইলে একটা বোমা ফুটিয়ে নিজের জীবনটারে দিয়ে চলে যেতে পারত।
কিছু একটা দাবী আদায়ের লক্ষে জিম্মি সংকট তৈরী করতে চেয়েছিল তারা, তাদের সেই দাবী গুলো নিশ্চয় সরকার জেনেছে। সেইসব কী? যেইসব বোমা হামলায় মানুষজন নিহত হল, সেই বোমাগুলো কি জিম্মিদের, নাকি কমাণ্ডোদের? কারণ আমরা জেনেছি, কমাণ্ডোরা তাজ হোটেলের প্রতি ফ্লোরের জানালা দিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়েছে। এই প্রশ্নগুলি আসবেই। তারও আগে আসবে ইলেভেন সংখ্যাটি ইতিহাসে যে সিম্বল তৈরী করেছে তার তাৎপর্যটুক ধরতে পারা, দুদিক থেকেই। একদিকে ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজম এবং অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষের বৈপ্লবিক আগ্রহ এবং ইনভলভমেন্ট।
এরই প্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় সচেতন চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস, যা এই ঘটনাটিরে আরো তাৎপর্যবহ করে তোলে। তা হলো-
এক. সর্বসাম্প্রতিক ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি ও রণ-কৌশলগত সম্পর্কের উন্নতির পরে এবং সেই সাথে নতুন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে এই নতুন ইণ্ডিয়ান ইলেভেন।
দুই. এই ঘটনার পরপর দুই আমেরিকান প্রেসিডেন্টের উতলা আগ্রহ (এটি একটি ইউনিক সময়ই বটে, বর্তমান আমেরিকায় দুজন প্রেসিডেন্টই আছে, বুশ এবং ওবামা, আরো আগ্রহের ব্যাপার হলো আর এক প্রেসিডেন্ট ম্যাককেইন এই ঘটনার পরপরই বাংলাদেশে এসে হাজির হচ্ছেন) নিয়ে যুগপত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ঘোষণা।
তিন. ইহুদীদের নরিম্যান হাউস আক্রান্ত হবার ঘটনা এবং তার প্রেক্ষিতে জায়নবাদী ইসরাঈল কর্তৃক ভারতে কমাণ্ডো পাঠানোর প্রস্তাবনা, যেটি ভারত পরবর্তীতে প্রত্যাখ্যান করেছে। কৌতুহলের ব্যাপারই বটে, এই প্রথম পৃথিবীতে এই ধরণের নাশকতার ঘটনায় দুইটি মহামূল্যবান ইহুদী প্রাণ বিনষ্ট হলো, সেই ইহুদি, যাদেরকে নাইন ইলেভেনের মত ঘটিত সব ঘটনাগুলির আগেই কোন এক অলৌকিক শক্তি সরিয়ে ফেলেছিল।
মনে রাখা দরকার যে, ভারতের একটা পরাশক্তি হওনের খায়েশ আগে থেকেই জারি আছে, তার জন্য আমেরিকার সাথে পরমাণু চুক্তি ও রণ-কৌশলগত সম্পর্ক আগেই তৈরী হয়েছে ভারতের। বাংলাদেশ সীমান্তে তার এই খায়েশের ঘনঘটা আমরা মাঝে মধ্যেই দেখতে পাই, অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলির উপরও তার প্রভুত্ব ও শোষন আমরা দেখেছি। আমরা এটিও জানি যে, অন্তত আট থেকে দশটি জাতিগোষ্ঠি ভারতের অভ্যন্তরেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য লড়াই জারি রেখেছে। কিন্তু সরাসরি ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজম-এ ভারতকে সম্পৃক্ত করা যায় নি এর আগে। পাকিস্তানকে যে লড়াই লড়তে হচ্ছে আমেরিকার হয়ে, নিজের ভূখণ্ডে।
তাহলে আমরা কি ধরে নিতে পারি, এই বিশেষ মুহূর্তে ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই আমেরিকার নতুন বর বারাক ওবামাকে এবং রণ-কৌশলগত সঙ্গী ভারতকে সরাসরি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইমোশনালি ইনভলব্ড করে নেওয়ার একটা উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে হাসিল হতে পারে? আমরা ইসরাঈলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিবিধ কুখ্যাত কর্মের কথা জানি, সেই সাথে সিআইএর সাথে তাদের মৈত্রী কোন লুকোছাপা ব্যাপার নয়।
নাইন ইলেভেন, ইলেভেন ওয়ান এবং এই নতুন আটাশে ইলেভেন কোনটাই এই যোগসূত্রটির থেকে পৃথক নয়, তার চরিত্র এবং ফলাফলের দিক থেকে। তাই এই বিষয়গুলি আলোচনা করার সময় আমরা কোনভাবেই ব্যাপারটি ভুলতে পারি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।