মুক্তির মন্দির সোপান তলে
চৈত্রের খরতাপে প্রকৃতির রং ধূষর মলিন। শীত বসন্ত পিছনে ফেলে বৈশাখের আশায় গ্রীষ্মের মরন কামড় সয়ে নিচ্ছে ধরণী। কাল বৈশাখীর প্রলয় নাচন না হলে এ খরার তাড়না থেকে মুক্তির ঊপায় কী!
কালসাপের ফনার মত বন্দুক উঁচু করে আসছে হায়েনার দল। তাদের পূঁজো দিতে রাজাকার দাঁড়িয়ে গেছে সারি সারি। সঙ্গতি সম্পন্ন হিন্দুরা প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে।
সহায় সম্বলহীন হিন্দুরা করজোরে দাঁড়িয়ে আছে শিকারী বিড়ালের সামনে ইঁদুরের মত। ধর্ম তুমি এত নির্মম কেন! কোথায় তোমার শান্তির বাণী?
কেরামত মাওলা খুব সুযোগ সন্ধানী মানুষ। বড় ছেলে রতনকে নিয়ে, ভিড়ে গেছে রাজাকারদের কাতারে। আটা, তেল, নুন কোন কিছুর অভাব নেই শেরালীর ঘরে। এমনকি মিষ্টি লবনও আছে।
ডান্ডি কাঠ দেখিয়ে কেরামত মাওলা বেতনের টাকা আর রেশনের মাল আনছে ঘরে। চমৎকার মানিয়েছে খাকী পোশাক রতনের গায়ে। কে বলবে এ ছেলের জন্ম বাঙ্গালির ঘরে! হ্যায়, বলা রপ্ত করে নিয়েছে মাত্র কয়েক দিনে। কাঁধের রাইফেলের বেয়নেটটা উঁকি দিচ্ছে মাথার উপর সাপের জিহ্বার মত। শহরেই হানাদার হায়েনার হত্যাযজ্ঞ চরম প্রকৃতির।
তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায়, অনেক চাকুরীজিবী পালিয়ে এসেছে গ্রামে। কিন্তু ইতিমধ্যে ওরা গ্রামকেও গ্রাস করেছে। তৈরী হয়েছে শান্তি কমিটি। পালা করে রাজাকার শান্তি কমিটির সদস্য আর পাক হানাদাররা রাতের বেলায় রেল সড়কের পুল পাহারা দেয়। মুসলীম লিগ, জামাতে ইসলামী কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রেখে স্থানীয় মুসলিম লীগের মেম্বার, চ্যেয়ারম্যানদের সহযোগীতায়, সনাক্ত করছে আওয়ামী লীগ কারী, মুক্তি বাহিনীতে যোগদেয়া পরিবার গুলির তালিকা।
বোয়ালমারী বাজারে আজ হাটের দিন। রাজাকার, তাদের সাথী সংগঠন জামাতে ইসলামী, মুলিম লীগ, আর পাকিস্তানী প্রভুরা মিলে হিন্দুদের সব দোকানপাটের মাল নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। দোকানীদের হাত এবং চোঁখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেল ব্রীজের উপর। খালি দোকানে আগুন দেয়া হল। বাজারটা জ্বলছে ধাউ ধাউ করে।
সব হিন্দুদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হল। পাখির ঝাকের মত মানুষ ছুটে পালাচ্ছে প্রাণ ভয়ে, যে যেদিকে পারছে। আগুনের লেলিহান শিখা আর রাইফেলের প্রাণসংহারী হুংকারে আকাশ ফেটে চৌচির। নাপিত আবুকর সারির একদম শেষ ব্যাক্তি, রাইফেলের মেগাজিন খালি। লোকমান রাজাকার মেগাজিনে গুলি ভরছে।
খুনের নেশায় রাজাকার লোকমান এতই মত্ত যে, ইতিমধ্যে আবুকরকে খুন না করার পাক কমান্ডারের ইঙ্গিত বুঝতেই পারেনি। রাইফেল কাক করে চোখ বাঁধা আবুকরের বুকে তাক করেছে, ট্রিগারে আঙ্গুল, এমন সময় মেম্বার মতি ডাক্তারের ধমকে অতি ধীরে নামাল বন্দুক। আবুকর দ্বিতীয় জীবন পেল, এক ভয়ংকর শাস্তির।
এই বিভীসিকায় আক্রান্ত হল রমিজ রাজাকার। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল হাতের ষ্টেনগান নিয়ে অজানায়।
হয়তঃ এবার মোহমুক্তি ঘটেছে তার। ঘোর অন্ধকার। জোনাকীর আলোই একমাত্র আগুনের চিহ্ন এই তমসার গায়। পুলে পাহারায় পাকিস্তানীরা জোনাকী দেখলে মনে করে মুক্তি ফৌজ বিড়িতে টান দিচ্ছি প্রতিশোধের নেশায়। ছোড় গুলি জোনাকীর গায়।
লক্ষ্য যত অভ্রষ্টই হোকনা কেন, গুলি কি আর লাগে জোনাকীর আলোয়! লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলী বিঁধে স্তন্য পান রত অবুঝ শিশুর বুকে। এদের বর্বরতায় শিশুরাও প্রাণ হারায়। বুকে ডিনামাইট। মাথায় কচূড়ীপানার টুপি। আমনের ক্ষেতের আইল ভেসে যাওয়ার পথ।
না ডুব না সাঁতার। দূর থেকে ফাটানোর বারুদের দড়ি, নাটাই থেকে ছাড়ছে একজন। একি ওদের প্রাণপন! মাঝে মাঝে রাজাকারদের শক্তিশালী টর্চলাইটের আলো এসে কচূড়ীপানায় চমকে দিচ্ছে। কিন্তু স্থির থাকতে হবে এ যাত্রায়। ক্ষেতের ভেতর ঢুকলে বিপদ কম,কিন্তু ধানের পাতা নড়লে গর্জে উঠবে রাজাকারের রাইফেল।
পৌঁছে গেছে পুলের নীচে, পাহারারত রাজাকারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। পুলের পাঁকা পিলারে বেঁধে ফেলেছে ডিনামাইট। ডানের পিলারে একটা, তার পর বায়ে এক খুটি বাদ দিয়ে আরেকটা। এবার বারুদের রশিটা দুটো ডিনামাইটে যুক্ত করতে হবে। তার পর পলায়ন।
এবার ডুব দিয়ে, নাটাই হাতে অপেক্ষারত সহযোদ্ধার পাশে। গ্রেনেট ছুড়ে দিল, অন্যদিকে, রাজাকাররা গুলি ছোড়ুক অন্ধকারে। অগ্নি সংযোগ বারুদের দড়িতে। ভেঙ্গে যাক হানাদারদের যোগাযোগের সব মাধ্যম, এই ব্রীজটার মতন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।