লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। সামান্য ভুল - ২
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আমি আর্থার উডস, থাকি কাঠের তৈরি এই ছোট্ট বাড়িটিতে। আমি, আমার স্ত্রী জেন, আর আমার পাঁচ বছরের মেয়ে লিসা।
তিনজনের ছিমছাম সংসার।
একটা মাঝারী গোছের কোম্পানির মালপত্র জায়গামত পৌঁছে দেয়ার কাজ করি আমি। সারা সপ্তাহ খাটুনির পর দুদিন বিশ্রাম পাওয়া যায়। প্রথম দিনটা ঘুমিয়ে কাটাই, প্ল্যান করি কী করা যায়, তারপর পরদিনের পুরোটাই পরিবারকে সময় দিই, কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে যাই। আমার বন্ধুরা প্রায় সব উইকএন্ডেই কোন একটা ভোজনের আয়োজন করে, সবাই ছেলেপুলে নিয়ে মেতে উঠি পানাহারে, খেলাধুলায়, গল্পগুজবে।
তারপর আবার কাজ, আবার খাটুনি। দু'তিনমাস পর পর অবশ্য হপ্তাখানেকের একটা লম্বা ছুটি নিয়ে সবাই মিলে ঘুরতে যাই। আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন, দেখিয়ে আনি তাঁদের নাতনীকে; আবার কখনো জঙ্গলে ক্যাম্পিং করতে চলে যাই, কখনো খরচাপাতি করে কোন টুরিস্ট স্পটে ছুটি কাটিয়ে আসি।
আমার স্বাস্থ্য ভাল, কাজ করতে ভয় পাই না মোটেই, কাজেই কাজের পরিমাণের তুলনায় বেতনটা কিছু ছোট অংকের হওয়া সত্ত্বেও আমি সুখী। আমার স্ত্রী-সন্তান-পরিবার-কাজ, এর বাইরে কিছু নিয়েই চিন্তা করার আমার দরকার ছিল না।
কখনো ভাবিনি, এই নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে কোন ছেদ পড়বে।
আজ উইকএন্ডের প্রথম দিন। আমি বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছি, খবরের কাগজ পড়েছি, লিসার সাথে বাগানে খেলা করেছি, শখের গাছগুলোর পরিচর্যা করেছি, পোষা কুকুরটাকে নিজের হাতে খাইয়েছি। সন্ধ্যা হতেই খবর পেয়েছি যে আমার বন্ধু শন রাইস একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করেছে, কাল সারাদিন আমরাসহ অন্য বন্ধুবান্ধবরা ওদের বাড়িতে কাটাবো। শন আমাকে ফোন করে নেমন্তন্নও করে ফেলেছে।
কাজেই আমি যখন লিসা আর জেনকে জানিয়ে দিলাম, তখন ওরাও খুব খুশি।
আমি পপকর্ণ খেতে খেতে টিভি দেখছি, গা এলিয়ে পড়ে আছি সোফায়, চ্যানেল পাল্টাচ্ছি ঘন ঘন। বেশি রাত করবো না, শুয়ে পড়বো, রাতের খাবার তৈরি শুরু করেছে জেন, একটু পর উঠে গিয়ে ওর সাথে টেবিল লাগাতে সাহায্য করবো। খুটখাট শব্দ আসছিল ওখান থেকে। লিসা আছে ওর ঘরেই, ছবি আঁকছে অথবা গল্পের বই পড়ছে।
দরজা খোলা ছিল, আমি এখান থেকে ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাচ্ছিলাম লিসাকে।
সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। একটু পর পর হাই তুলছিলাম আমি। যখন আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াতে যাবো, তখনই রান্নাঘরে জেন যেসব শব্দ করছিলো, তা হঠাৎ করে থেমে গেল।
আমার একটু খটকা লাগলো।
ডেকে উঠলাম, জেন, কী হয়েছে?
কোন জবাব নেই। সহসা চুপ হয়ে গেছে জেন।
মানুষের সহজাত কিছু আত্মরক্ষার পদ্ধতি থাকে নিশ্চয়ই, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সতর্ক করলো, বলে দিলো, এখন রান্নাঘরে যেয়ো না, আগে তোমার মেয়েকে, তোমার সন্তানকে রক্ষা কর।
আমি তাই সন্তর্পণে হাতে তুলে নিলাম ঘর পরিষ্কার করার একটা ঝাড়ু। এমন কোন অস্ত্র নয়, কিন্তু খালিহাতে থাকতে ভয় হচ্ছে, সহসা বাড়িটা নীরব হয়ে গেছে বলে আমার স্নায়ু খুব সতর্ক হয়ে উঠেছে।
আজকাল প্রথমেই মনে হয় বিপদের কথা, অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই বুকটা ধক করে ওঠে। খবরের কাগজ ভর্তি খারাপ খবরে, দিনেদুপুরে খুন হয়ে যায় মানুষ, ঘরে ঢুকে পড়ে ডাকাতের দল, সাধারণ মানুষের ভোগান্তির সীমা নেই। তাই হয়তো আমার এই অহেতুক ভীতি।
ঢোক গিললাম আমি, এখান থেকে লিসাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আমি বিড়বিড় করে বললাম, কোথায় গেলে লিসা, মামণি আমার! ঈশ্বর! খারাপ কিছু যেন না ঘটে!
পা টিপে টিপে লিসার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই যে জিনিসটা দেখে আমার বুকটা হিম হয়ে গেল, তা হল ওর ঘরের জানালাটা ভাঙা।
কেউ কি ঢুকেছে ঘরে?
চোখ বোলাতে লাগলাম ঘরে। লিসার রংপেন্সিলগুলো ছড়িয়ে আছে মাটিতে, ড্রইং খাতাটাতে আঁকিবুঁকি আছে অল্পই, তাছাড়া বইয়ের তাকটা কাত হয়ে আছে। মৃদু হলেও একটা ধস্তাধস্তি হয়েছে এখানে, বোঝাই যাচ্ছে।
বাপী! লিসার ডাক শুনতে পেলাম, ধাঁ করে ঘুরে গেলাম যেদিক থেকে ডাকটা এসেছে সেদিকে।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে লিসা।
ওকে দেখে ভয় পাই নি আমি, ভয় পেয়েছি ওকে জাপটে ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে।
আপাদমস্তক কালো ইউনিফর্মে আচ্ছাদিত, মাথায় হেলমেট পরা সশস্ত্র এক ব্যক্তি লিসাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি এগিয়ে যেতে চাইলেই সেই লোকটি খসখসে স্বরে আমাকে ধমকে উঠলো, যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এগোবে না, খবরদার।
কিন্তু, কেন, কী হয়েছে? বলতে গেলাম আমি।
প্রশ্ন পুরো শেষ হবার আগেই দুদিক থেকে আমাকে এসে ধরল ঐ লোকটির মতোই আরও দুজন লোক। আগের লোকটি কানের পাশ থেকে বেরুনো ছোট মাইক্রোফোনে কাউকে কিছু একটা বলল, অথবা নির্দেশ দিলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না, বোধহয় সৈন্যরা যেভাবে কথা বলে, তেমন শব্দ ব্যবহার করছে।
আমার মনে হল না এরা ডাকাত। আবার সাধারণ পুলিশের মতোও নয়।
সিনেমায় এদের মতো লোক দেখা যায় বটে, বিভিন্ন বিপজ্জনক অপারেশনে যায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপরাধীর পেছনে ছোটে। পুলিশের স্পেশাল ফোর্স? কিন্তু আমি তো কোন বিপজ্জনক অপরাধী নই, আমার পেছনে লেগেছে কেন?
হাত পিছমোড়া করে ধরে আমাকে আবার বসার ঘরেই ফিরিয়ে আনল ওরা, এমন ভাবে আমাকে ধরে রেখেছে যাতে পালিয়ে যেতে না পারি। সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, খুবই উন্নতমানের সন্দেহ নেই। একজন আমার পাঁজরে বন্দুক ধরে রেখেছে। কিন্তু এসবের কী দরকার ছিল? এভাবে জানালা ভেঙে ঢুকে একজন সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানো তো ঠিক নয়।
কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস হচ্ছে না, যদি গুলি করে দেয়? তাই ওরা আমাকে ধাক্কা মেরে যেদিক নিয়ে যাচ্ছে, সেদিকেই যাচ্ছি, অসহায়ের মতো তাকাচ্ছি লিসার দিকে। ওকে লোকটা এখনো ছাড়েনি। বেচারি ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে। আমার মেয়েটি অল্পতেই ভয় পায়। ওর বয়স আর কতই বা, আমি নিজেই যখন ভয় পাচ্ছি তখন সে তো পাবেই।
রান্নাঘরের খুটখাট শব্দ কেন থেমে গেছিল বুঝতে পারলাম। আরও একটা দশাসই ছ'ফুট লম্বা লোক জেনকে আমার মতোই পিছমোড়া করে বেঁধে হাজির করলো।
জেন আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলো, আর্থার! ভয়ে ওর চোখ দিয়েও পানি পড়ছে দেখতে পেলাম।
আমি এত বিপদের মধ্যেও জেনকে বললাম, শান্ত থাকো, জেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথাও ভুল হচ্ছে।
আমাকে ধরে রাখা লোকটাকে চিৎকার করে বললাম, এসবের মানে কী? হচ্ছে কী এসব? দয়া করে বলবে তোমাদের মতলব কী? একজন মানুষকে এভাবে হেনস্থা করার কোন অধিকার ... ...
মুখের কথা শেষ হবার আগেই আমার মাথায় ভারী কিছু একটা দিয়ে আঘাত করলো লোকটা, আমি সবকিছু অন্ধকার দেখলাম। তীব্র ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম আমি।
জেন চিৎকার করে উঠলো, আর্থার! সে ছুটে চলে আসতে চাইলো আমার দিকে, কিন্তু ওকে যে ধরে রেখেছে, তার বজ্রমুষ্ঠির কাছে সে নেহায়েৎ দুর্বল। কাজেই সে নিষ্ফল আক্রোশে হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। লিসা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে-ও।
আমার মাথার পেছনের চামড়া কেটে গেছে, রক্তের ছোঁয়া টের পাচ্ছি। লোকটা খুব নিষ্ঠুর, আমার কলার চেপে ধরে চোয়ালে একটা ঘুষি মেরে বলল, কোন চিৎকার-চেঁচামেচি চলবে না, কোন নড়াচড়া চলবে না। যা বলবো তাই না করলে ব্যাপার আরও খারাপ হবে। বোঝা গেছে?
চোয়ালে বিষম ব্যথা। একটা দাঁত বোধহয় ভেঙে গেছে।
নোনা রক্তের স্বাদ পাচ্ছি জিভে। লিসা একবার বলে উঠলো, আমার বাবাকে তোমরা কেন মারছ?
জবাবে লোকটা চোখ পাকিয়ে তেড়ে যাচ্ছিলো লিসার দিকে, লিসা আবার চিৎকার করে উঠলো, চোখ বন্ধ করে মুখ ঢেকে ফেললো। আমি লোকটাকে অনুরোধ করলাম, প্লীজ, আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না। তোমরা যা করতে বলবে, তাই করবো।
লোকটা তবুও থামছিল না, আরেকজন চোখের ইশারা করাতে নিরস্ত হল।
আমাকে নিয়ে যখন বাইরে বেরুলো লোকগুলো, আমার বুক আবার কেঁপে উঠলো সামনে দাঁড়ানো সার বাঁধা অনেকগুলো আলো দেখে। লনের অন্ধকারে গা মিশিয়ে আরও অনেকগুলো বন্দুকের নল আমার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। দরজার ঠিক সামনেই সতর্ক অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আরও দুজন, ভেতরে ঢোকেনি। বোধহয় দরজা দিয়ে কারো বাসায় ঢুকতে তারা জানে না, তারা শুধু জানে জানালা ভেঙে কিংবা দেয়াল টপকে ঢুকতে। দরজা তারা ব্যবহার করে শুধু বেরুবার জন্য।
এই লোকগুলোর হাবভাব খুব বেপরোয়া, যেন খুব দুর্ধর্ষ একটা মিশনে এসেছে, আমাকে কব্জা করে ধরে নিয়ে যাবার জন্য।
লোকটা আমার পিঠে সজোরে ধাক্কা দিলো। চল, যেতে হবে। সময় কম।
কোথায় যেতে হবে, কেন যেতে হবে, তা জিজ্ঞাসা করার দুঃসাহস আমি দেখালাম না।
ধাক্কাতে ধাক্কাতে আমাকে তারা একটা জীপে তুলে নিলো। আগে পিছে আরও অনেকগুলো গাড়ি, তাতে বসে আছে অনেক সশস্ত্র লোক, বোধহয় আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি পালাতে যাবো কেন, সেটাই ভাবছি।
কপাল ভাল, জেন আর লিসাকে ওরা ছেড়ে দিয়েছে, কোন ক্ষতি করে নি। ওরা এখন চিৎকার করে কাঁদছে, বলছে, ওকে কেন নিয়ে যাচ্ছ, ও কিছু করে নি।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বল, বলতেই হবে।
লোকগুলো ওদের কথার জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। বোধহয় নির্দেশ আছে আমাকে অজানা কোন জায়গায় নিয়ে যাবার, যে স্থানের ঠিকানা কাউকেই বলা যাবে না।
পেছনে ঝাপসা হয়ে আসছে লিসা আর জেনের অবয়ব। লিসা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে সজল চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
এতক্ষণ ধরে "বাপী", "বাপী" বলে ডাকাডাকি করছিলো। জেন বোধহয় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে, নীরবে কেঁদে চলেছে। ওরা নিশ্চয়ই কারো না কারো সাথে যোগাযোগ করবে, আমাকে কেন এবং কোথায় ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করবে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে চোখের নীরব ভাষায় অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম, নিশ্চয়ই এসব একটা ভুল, একটা দুঃস্বপ্ন। আমি নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসবো।
কিন্তু বুকের মধ্যে ভরসা পেলাম না। আবার ফিরে আসতে পারবো তো? নাকি এই যাওয়াই শেষ যাওয়া?
আমি কাউকে খুন করিনি, কোম্পানির গোপন খবর কারো কাছে পাচার করিনি, ভিনদেশ থেকে এসে এখানে লুকিয়ে যে আছি তা-ও নয়। আমার একটা আইডি কার্ড আছে, সামাজিক পরিচয় এবং সম্মান আছে। তারপরও লোকগুলো আমার সাথে একটা জন্তুর মতো আচরণ করছে। কী আমার অপরাধ, মস্তিষ্ক তোলপাড় করেও বুঝতে পারলাম না।
সে রাতে, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায়, অযাচিত আক্রমণের শিকার হয়ে আমি এই অচেনা লোকগুলোর হাতে বন্দী অবস্থায়, হাতকড়া পরে এক ভয়ংকর অজানা গন্তব্যে যাত্রা করলাম। পেছনে পড়ে রইলো আমার জেন, আমার লিসা, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার সংসার, আমার বাড়ি, সবকিছু।
আমার চোখ বেঁধে দেয়া হল। নিঃসীম অন্ধকার।
*****
ও, গড ড্যাম ইট! হা ঈশ্বর!
আমি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কংক্রিটের শীতল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছি।
পেটের খাবার সব বেরিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে। মেঝে ভিজে গেছে আমার শরীরের ঘামে।
লোকটার হাত পাথরের মতো শক্ত, কাজেই তলপেটে ঘুষি খেয়ে আমি বেশ কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করলাম। যন্ত্রণায় শুধু ঈশ্বরকে ডাকা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।
যে লোকটা আমাকে কিছুক্ষণ ধরে মারছে, তার পোশাক বেশ ফিটফাট, দেখে বোঝাই যায় উচ্চপদস্থ কোন সামরিক কর্মকর্তা।
চোখ বেঁধে নিয়ে এসেছে আমাকে এরা এই অজানা জায়গায়, তারপর মারধোর শুরু করেছে। কোথায় আছি জানি না, শুধু চোখ বাঁধা অবস্থায় যেটুকু বুঝেছি, তাতে মনে হয়েছে যে কোন পাহাড়ি এলাকার এবড়োখেবড়ো পথে কিছুক্ষণ জীপটা চলেছে।
লোকটা নাম বলেনি, সে কী করে তা-ও বলেনি। হিসহিস করে জিজ্ঞেস করলো, ভাল চাও তো বল ভ্যালেরি কনর এখন কোথায় আছে। তুমি ওর কাছের মানুষ, পেয়ারের লোক।
বলে দাও, লক্ষ্মী ছেলের মতো। তোমাকে কষ্ট কম দেয়া হবে, হয়তো বাঁচতে দেয়া হবে। আমি নিজে তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারটা দেখবো। আমাদেরকে সাহায্য কর, তথ্য দাও। নইলে তোমার জন্য কী কী অপেক্ষা করছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
বন্দুক হাতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আরও একটা লোক, সে যেন কথাটায় খুব মজা পেয়েছে এমন ভাব করে হেসে উঠলো।
লোকটা আমাকে মাটি থেকে তুলে নিলো। আমার হাত বেঁধে রেখেছে বলে বাধা দিতে পারছি না, ঠেকাতে পারছি না কোন আঘাত। তাছাড়া এই লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি, আমি এর কাছে একটা শলার কাঠি ছাড়া কিছুই না, এক টিপ নস্যি। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, নাক দিয়ে পানি পড়ছে, তার সাথে এসে মিশেছে কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘাম।
লোকটা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে হাঁটু দিয়ে তলপেটে আবার মেরে বসলো, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, বমি করে দিলাম। নোংরায় মাখামাখি হয়ে গেল মেঝে।
লোকটা ঐ অবস্থাতেই আমাকে তুলে নিলো, বলল, বল, ভ্যালেরি কনর কোথায় আছে। বল, বেজন্মা বদমাশ! ওর আড্ডাটা কোথায়? বলতেই হবে। নইলে তোমার হাড় মাংস সব আলাদা করে ফেলবো, কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।
আমি ভ্যালেরি কনর নামে কাউকে চিনি না। নিশ্চয়ই এই লোকগুলো ভ্যালেরি কনরকে খুঁজছে, ঐ ব্যাটা কোন ঘাঘু আসামী। হয়তো ড্রাগ ডিলার, চোরাচালানী কিংবা ভয়ংকর কোন খুনি, যা খুশি হতে পারে। কিন্তু আমি জানবো কোত্থেকে? এখানে ধরে এনেই আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেছে ওরা, মারধোর করছে সমানে। কোন অজানায় এসে পড়েছি জানি না, নিশ্চয়ই নরকের কোন এক দরজা এটা।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, সত্যি বলছি, ঈশ্বরের কসম, আমি জানি না। ভ্যালেরি কনরের নাম আমি কখনো শুনি নি। বিশ্বাস কর, প্লীজ। আমাকে এভাবে মেরো না।
লোকটার মুখের শয়তানি হাসিটা আরও জোরালো হল।
বলল, তুমি বলবেই, খোকা! সব মনে পড়বে তোমার, আমাদের এক একটা আপ্যায়ন গায়ের ওপর পড়লে সুড়সুড় করে সব বলে দেবে। যদি তোমার পরিবারকে বাঁচাতে চাও, তাহলে অবশ্যই বলবে, হা হা হা।
আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি মিনতি করলাম, দোহাই তোমাদের, আমার পরিবারের কারো ক্ষতি কোরো না।
লোকটা আবার হেসে উঠলো।
একে নিয়ে যাও, পেদ্রো। সকালে আবার শুরু করা হবে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা আমার কাপড় মুঠো করে ধরে টেনে নিয়ে চলল। সেই সৈনিকটি আমাকে পেছন থেকে বলল, প্রাণে বাঁচতে চাইলে বলে দাও, ছেলে, নইলে কেঁদে কূল পাবে না। এখানেই পচে মরতে হবে তোমাকে।
তোমার সাঙ্গোপাঙ্গোগুলোও তোমার সাথে শীঘ্রই যোগ দেবে। তোমাদের জন্যই তৈরি এই সরাইখানা, তোমাদের আদরযত্ন করার জন্য।
পেদ্রো নামের দানবটা আমাকে মাটির সাথে হেঁচড়ে নিয়ে চলেছে একদিকে, কোথায়, কোন গর্তে আমাকে ভরে রাখবে জানি না। আমি হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, বিশ্বাস কর, সত্যিই আমি ভ্যালেরি কনর নামে কাউকে ... ...
কথা শোনার ধৈর্য লোকটির নেই, আমার পাঁজরে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ঘা মেরে বসলো, মট করে আওয়াজ হল, একটা হাড় বুঝি ভেঙে গেল। আমি আবার চিৎকার করে উঠলাম।
গলা ভেঙে গেছে আমার, শব্দ ঠিকমতো বের হচ্ছে না।
সারা শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে যখন আমি অচেতনপ্রায়, তখন আমাকে একটা অন্ধকার কুঠুরিতে ঢুকিয়ে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো লোকটা। আমি যন্ত্রণা, ক্লান্তি আর শীতে কাহিল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
*****
আজ এখানে বিশ দিন ধরে আছি। বিশটি দিনের এক একটি ছিল মূর্তিমান বিভীষিকা।
আমি আমার সবকিছু দিয়ে হলেও এই দিনগুলোকে ভুলে যেতে চাইবো।
তবে এই বিশ দিনে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। এক একটা বিষয় জেনেছি, আর মনটা বিষিয়ে উঠেছে। হতাশ হয়ে দেয়ালে কপাল ঠুকেছি আমি, মন মানতে চায় নি কিছুতেই।
এই অজানা জায়গাটা একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, সোজা কথায় নরকের দক্ষিণ দুয়ার।
যমদূতের গরম নিঃশ্বাস এখানে সরাসরি এসে পড়ে, বাইরের জগতের যারা এই জায়গার নাম জানে, এবং জানে যে এখানে কী হয়, তারা কেঁপে ওঠে বলেই আমার বিশ্বাস।
এটা অত্যাচারের একটা ঘাঁটি। বিভিন্ন সন্দেহভাজন লোকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হয়, অমানুষিক কষ্ট দেয়া হয়। মুখ থেকে বিভিন্ন কথা বের করার চেষ্টা করা হয়। অনেকে সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনকি পাঁচ দিন আগে একজন মারাও গেছে।
পায়ুপথে রড ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো ওর, ষাঁড়ের মতো চিৎকার করতে করতে, ঈশ্বর আর নিজের মা'কে স্মরণ করতে করতে মারা গেছে সে। মৃত্যুর পরও মাতাল সৈনিকগুলো লাশের ওপর পদাঘাত করে বিকৃত করেছে, তারপর লাশটা কোথায় গুম করে ফেলেছে জানি না। হয়তো মাটিচাপা দিয়েছে, অথবা কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। বাইরের কেউ তো জানেও না সে মারা গেছে। কোন দাবীদার নেই, বেওয়ারিশ লাশ।
বেচারার জন্য আমার মায়াই লেগেছে। কিন্তু এখানে মায়া নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মায়া-দয়ার জায়গা এটা নয়। গা শিউরানো সব অত্যাচার এই ক'দিনে সবার ওপর করা হয়েছে, আমিও বাদ যাই নি।
মারধোর তো আছেই।
হাতের মার, লাঠির মার। এসব কিছুই না, আদর বলেই ধরা চলে। কিন্তু যখন নগ্ন করে হিমঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রাখা হয়, বিষপিঁপড়ের গর্তে আগুন দিয়ে তার ওপর শুইয়ে দেয়া হয়, গরম পানি নাকের ভেতর ঢেলে দেয়া হয়, নিজের প্রস্রাব পান করতে বাধ্য করা হয়, বাথরুমের নোংরা কমোডে মুখ চেপে ধরে ফ্লাশ করে দেয়া হয়, কিংবা ভাঙা কাঁচের টুকরো মুখের ভেতর ভরে দিয়ে চিবোতে বলা হয়, তখন মনে হয়, এটা সাক্ষাৎ নরক, আর এই শয়তানগুলো আমাদের নির্যাতন করে পাশবিক আনন্দ পাচ্ছে।
সত্যিই তাই। মানুষকে মেরে এরা খুব আনন্দ পায়।
নতুন কেউ যখন এখানে আসে, তখন এদের চোখ চকচক করে ওঠে, শিকার পেলে শিকারি যেমন খুশি হয়ে ওঠে।
ভাবছেন, আমার মতো আর বন্দীরা সব অসহায়, খুব শান্তশিষ্ট মানুষ? মোটেই তা নয়। দিনের পর দিন অত্যাচার সয়ে এরাও এক একটা পিশাচ হয়ে উঠেছে।
ডার্ক স্ক্র্যাচ নামে এদের লিডারগোছের একজন আছে। আমি একদিন ওর সামনে বসেছিলাম, মনের কথা খুলে বলেছিলাম।
হাত বাড়িয়ে বলেছিলাম, তুমি, মানে তোমরা তো আমার মতোই, ভাগ্যাহত লোকজন, কপালের ফেরে এখানে এসে পড়েছ। ওরা আমাদেরকে মারধোর করে, অত্যাচার করে। তুমি আমার বন্ধু হবে?
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অবশ্যই হবো। কিন্তু এখানে বন্ধু বন্ধুর সাথে কী করে জানো?
আমি সামনের দিকে ঝুঁকে বললাম, কী?
ডার্ক স্ক্র্যাচ আমার নাকে সজোরে ঘুষি মেরে বলল, এটা!
আমার নাক দিয়ে তখন দরদর করে রক্ত পড়ছে, আর চারিদিকের অন্য বন্দীরা হা হা করে হাসছে। আমি সেদিনই বুঝতে পারলাম, এখানে কেউ কারো বন্ধু নয়।
আমার সাথে আরও যারা এখানে আটক আছে, তাদের কেউ কেউ হয়তো আমার মতোই ভুলে আটকা পড়েছে, অথবা সত্যিই দোষী, অপরাধী। কে যে আসলে কী, তা জানার চেষ্টা বৃথা। আমি তাই একা একা আলাদা থাকতে অভ্যেস করলাম।
অত্যাচারের মাত্রা, ধরণ ইত্যাদি প্রতিদিন বদলায়। আমি প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি, আমাকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
রাতগুলো ছিল আরেকটি ভয়ংকর দিনের জন্য প্রতীক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়।
একবার ভেবেছিলাম, যে ভ্যালেরি কনরের কথা এরা জিজ্ঞেস করছে, তার অবস্থান সম্পর্কে একটা মনগড়া কথা বলে দিয়ে খালাস হয়ে যাই। কিন্তু এরা যে পিশাচ, যখন দেখবে যে আমার দেয়া তথ্য ভুল, তখন আমাকে কী করবে ভেবেই বাদ দিয়ে দিয়েছি সে চিন্তা।
পালাবার চিন্তাও করেছি, কিন্তু কড়া প্রহরা উপেক্ষা করে এই জেলখানার কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার চেষ্টা নিজের মৃত্যু ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু নয়।
আত্মহত্যার কথাও যে চিন্তা করিনি তা নয়।
কিন্তু শয়তানগুলো সে সুযোগও রাখে নি। আমার সাথে আটক এক ছোকরা মার্ক যখন ইলেকট্রিকের তার জিভে ছুঁইয়ে মরার চেষ্টা করেছিল, তখন দেখতে পেয়ে দুটো পাহারাদার ছুটে এসে ওকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেললো, আর সারাদিন হিমঘরে ভরে রাখল, সারারাত বিষপিঁপড়ের কামড় খাওয়াল। শরীর ফুলে ঢোল হয়ে গেল মার্কের, যন্ত্রণায় অচেতন হয়ে পড়লো।
খুব বেশি খারাপ অবস্থা হলে "মেডিক" দের ডাকে ওরা। ডাক্তারগুলোও এক নম্বরের বদ, রাক্ষুসে চেহারা, ঘ্যাঁচ করে কনুইয়ে বড় বড় সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দেয়।
একবার তো রক্ত বার করে ছাড়ল। ছোট একটা হাসপাতালও আছে এখানে, ওটার ভেতর কী হয় জানি না। নিশ্চয়ই চিকিৎসার নামে নতুন ধরণের অত্যাচার হয়।
আমি প্রথমে ভদ্রলোকের মতো আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, একজন আইনজীবীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। অনুরোধ করেছি, এমনকি সৈনিক বদমাশটার পায়ে পর্যন্ত ধরেছি; একটা ফোন, অন্তত একটা ফোন করতে দেয়া হোক আমাকে।
কিন্তু ওরা সেটা করতে দেয় নি আমাকে। বলেছে, সিকিউরিটি প্রটোকল। আমি আমার নাগরিক অধিকারের কথা তুললে আরেক দফা মার খেতে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম আমি। ধরেই নিলাম, এই নরকেই আমার মৃত্যু লেখা আছে।
আর কোনদিন আমি আমার জেন আর লিসার কাছে ফিরে যেতে পারবো না।
*****
এগার বছর পরের কথা। না, ভুল পড়েন নি, পুরো এগার বছর পার হয়েছে আজ সাতদিন হয়। ঈশ্বর আমাকে এই দিনটি দেখানোর জন্যই বুঝি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
সেদিন সকালে একজন সুন্দরী মহিলা আমার কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ডাকলেন, মিস্টার আর্থার উডস!
আমার মাথার ভেতর যেন বজ্রপাত হল, এতদিন পর কেউ আমার নাম ধরে ডাকল, এটা যে আমার নাম তা তো ভুলতেই বসেছিলাম। এতদিন বেজন্মা, চতুষ্পদ বিভিন্ন প্রাণীর সন্তান এসব, কিংবা তার চেয়েও খারাপ নামে ডাকা হতো আমিসহ এখানকার সব কয়েদীদের।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে?
গোলগাল মুখের, সোনালী চুলের, বছর ত্রিশেক বয়সী, শার্ট আর জিন্স পরা কাঁধে ব্যাগওয়ালা মহিলাটি হাসিমুখে বললেন, আমি সামান্থা ক্লার্ক। আপনার ব্যাপারটা তদন্ত করেছি।
আপনি যে ওদের ভুলে এখানে বহুদিন ধরে আটক আছেন, সেটা প্রমাণ করা হয়েছে। আপনি এখন মুক্ত।
মুক্ত! বিড়বিড় করে বলি আমি।
হ্যাঁ, মুক্ত। আপনি এখন আপনার পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন।
পেছন থেকে এক কয়েদী আমাকে আর এই মহিলাটিকে নিয়ে কিছু কুৎসিত কথা বলল।
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, আনন্দের আতিশয্যে জ্ঞান হারালাম।
*****
আমাকে আঁধার কুঠুরি থেকে বের করা হয়েছে, এবং আমার হাতে হাতকড়া নেই। মুক্তির বাতাস গায়ে লাগছে আমার, অনুভব করছি। আবার বাইরে বেরুবো, নীল আকাশ দেখবো! কতদিন পর! একদিন নয়, দু'দিন নয়, এগার বছর পর! যখন বেরিয়েছি, অন্য কয়েদীদের চোখে ঘৃণা আর প্রচণ্ড হিংসে দেখেছি।
সারাক্ষণ ওরা আমাকে যেসব গালাগালি দিয়েছে, সেগুলো মুখে আনার যোগ্য নয়। আহা, যদি ওরাও আমার সাথে ছাড়া পেত, কত খুশীই না হতো!
মহিলাটি আমাকে নিয়ে এলেন ভারপ্রাপ্ত সৈন্যটির কাছে। কড়া গলায় বললেন, একে যে কাগজে সই করতে হবে, সেটা দিন।
এ সেই আগের সৈন্যটি নয়, বুড়ো শয়তানটা অক্কা পেয়েছে অথবা অন্য কোথাও চলে গেছে। এখন কম বয়সী একজন এই টেবিলে বসে।
কম অত্যাচার করে নি সে-ও, আমাকে নিজের হাতে মেরেছে, রুল দিয়ে পেটে গুঁতো মারতে সে সিদ্ধহস্ত।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে কাগজটা বের করে দিলো সে, আমি কাঁপা হাতে সই করলাম। মুক্তির সনদে স্বাক্ষর করা যে এত মধুর, জানতাম না, চোখে পানি চলে এলো।
আমি বোধহয় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মিলিটারি লোকটির দিকে তাকিয়েছিলাম। সে আমাকে বলল, আমরা দুঃখিত, মিস্টার উডস।
সামান্য একটা ভুলের জন্য আপনি এতদিন আটক ছিলেন। আশা করি আপনি ব্যাপারটা ভুলে যাবেন। আপনার ভবিষ্যৎ জীবন সুখময় হোক। ঠোঁট দুদিকে ছড়িয়ে একটা লজ্জিত হাসি হাসার চেষ্টা করলো লোকটা।
আমি বিস্ফোরিত নয়নে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কত সহজে সে বলে ফেললো, সামান্য একটা ভুল হয়ে গেছে! আমি ব্যাপারটা ভুলে যাবো!
আমার জীবনের এগার বছর কেড়ে নিয়েছে ওরা, করেছে অমানুষিক অত্যাচার। তার চেয়েও বড় কথা, আমার প্রিয়জনদের কাছে, আমার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের কাছে আমাকে যেতে দেয় নি, একটু চোখের দেখা দেখতে দেয় নি, ওদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয় নি, ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে জানতে দেয় নি, ওদের কণ্ঠস্বর পর্যন্ত শুনতে দেয় নি। আর বলছে এটা সামান্য একটা ভুল, আমি এটা ভুলে যাবো!
আমার খুব ইচ্ছে হল জানোয়ারগুলোর টুঁটি টিপে ধরতে, সবক'টাকে গুলি করে শেষ করে দিতে, কিন্তু সারাজীবন ধরে চর্চা করে আসা অর্থহীন ভদ্রতাবোধ আর নিষ্ফল কাণ্ডজ্ঞান আমাকে সেটা করতে দিলো না। আমি বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, অপেক্ষা করছি আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তির। মুখে একটা মেকী গাম্ভীর্যের ভাব।
স্থির এবং শান্ত থাকার চেষ্টা করছি।
বাইরে বেরুনোর আগে আমি পেছন ফিরে সৈন্যটির মুখের দিকে তাকালাম। সে মুখে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
পুরো পথটি আমি নির্বিঘ্নে সেই মহিলাটির সাথে পার হলাম, কেউ আমাকে মারল না, গাল দিলো না, বরং পথ ছেড়ে দিলো। স্বপ্ন দেখছি কীনা কে জানে।
জুতো ছিল, তবুও খালি পায়ে ঘাসের ওপর হাঁটতে লাগলাম আমি, বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে উঠলাম। আকাশ, এই বিশাল বিস্তৃত আকাশ দেখলাম আজ কতদিন পর! এক ভয়াল রাতে যে আকাশ আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। আর কোন দিন কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কোনদিন না।
একটা ছোট প্লেন অপেক্ষা করছিল, তাতে আমাকে তুলে দিলেন তিনি, নিজে আমার পাশে বসলেন।
পাইলট আমার দিকে একবার তাকিয়ে হেসে মাথা ঝাঁকাল, তারপর প্লেন চালু করলো। ঘড়ঘড় করে রওনা দিলো সামনের দিকে। এখুনি আকাশে উড়বো আমরা।
আমার বাহুতে একটা সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিলেন তিনি, অর্থাৎ সামান্থা ক্লার্ক। বললেন, ঘুমের ওষুধ।
জেগে দেখবেন বাড়িতে পৌঁছে গেছেন। অনেক ধকল গেছে আপনার ওপর দিয়ে, অনেক নির্যাতন সয়েছেন। এখন আপনার দরকার লম্বা একটা ঘুম এবং পরিপূর্ণ বিশ্রাম।
আমার ঘুম পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় আছি।
বড় নিশ্চিন্ত লাগছে। প্রিয়জনদেরকে আবার দেখার, আবার ফিরে পাওয়ার ব্যাগ্র কিন্তু আরামদায়ক আগ্রহ। একটা ভারমুক্ত আলস্য, যেটার স্বাদ আগে কখনো পাই নি।
চোখ বেঁধে ওরা আমাকে ধরে এনেছিল বলে এটা কোন জায়গা তা জানি না। মিস সামান্থাকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই বলবেন।
কিন্তু এই নরকের পরিচয় আমার জানার কোন দরকার নেই। ফিরে যাচ্ছি, আর এখানে থাকতে হবে না, এটাই বড় কথা। ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে ভুলে গেছি, নিজের আনন্দ আর খুশি নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম। যাক, সময় তো আর ফুরিয়ে যায় নি। এখন প্রতিটি দিনই আমার জন্য একটা উপহার।
মুক্ত জীবন যে কী, এর স্বাদ যে কেমন, এখানে না এলে কি বুঝতাম? মনে হয় না। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে করতে আমাদের মনেই পড়ে না যে এই স্বাভাবিক জীবনটুকুই দান করার জন্য বিধাতার কতটা কৃতজ্ঞতা পাওনা রয়েছে, মানুষের কাছে।
আমার কানে এখনো বাজছে টেবিলের সেই লোকটির কথা। বলেছিল, সামান্য একটা ভুল হয়ে গেছে। সামান্য, ছোট, নগণ্য ভুল।
অথচ এদিকে কেটে গেছে এগারোটি বছর। জেন আর লিসা এখন কেমন আছে? ভাল আছে তো! আমার বাবা, আমার মা, তাঁদের কী খবর? আর আমার বন্ধুরা, যাদের সাথে সপ্তাহান্তে পার্টি করতাম? নিশ্চয়ই সব ঠিক আছে, সবাই আগের মতোই আছে, কিছুই বদলায় নি। আমি কাল থেকেই আবার আমার পুরনো কাজগুলো শুরু করতে পারবো, পপকর্ণ খেতে খেতে টিভি দেখবো। কুকুরটা বেঁচে আছে তো, না মরে গেছে? আর বাগানের গাছগুলো? বাগানে ঝোলানো লিসার দোলনাটা? ওর ছবি আঁকার খাতা, রংপেন্সিল? লিসা কত বড় হয়েছে? খুব সুন্দর হয়েছে নিশ্চয়ই? আমার চাকরিটা এখনো কি আছে? অজান্তে মুখে হাসি খেলে যায় আমার, চাকরির কথা ভাবছি কেন?
সৈনিকটি আমাকে আরও বলেছিল ভুলে যেতে, এসব মনে না রাখতে। অসম্ভব এবং অবাস্তব একটি কথা।
আমার মরা শরীরও এই দিনগুলোর কথা, এই অসহনীয় অত্যাচার-নির্যাতনের কথা ভুলতে পারবে না।
আমি তবুও বিড়বিড় করে বললাম, বেশ, ভুলে যাবো।
(৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।