বাংলাদেশ লিনাক্স ইউজার্স এলায়েন্স (বিএলইউএ) হচ্ছে বাংলাদেশের লিনাক্স ব্যবহারকারীদের জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন। বর্তমানে এ সংগঠনটি বিশ্বব্যাপী লিনাক্স কমিউনিটিগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষার এবং বাংলাদেশের লিনাক্স ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে। পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ কমন্সের বাংলাদেশী অ্যাফিলিয়েট হিসেবে কাজ করছে এবং বিভিন্ন ওপেনসোর্স প্রজেক্টের সাথে জড়িত।
http://www.linux.org.bd
ইদানিং প্রযুক্তি বিষয়ক ম্যাগাজিন পত্রিকা ওয়েবসাইট ফোরামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা তর্ক বিতর্ক হয়। তার মধ্যে সবসময়ই আলাদা স্থান করে রেখেছে উন্মুক্তসোর্স প্রযুক্তি বা মুক্তসোর্স সফটওয়্যার (open source software-OSS)।
অসংখ্য মানুষ এর পক্ষে আবার অগনিত মানুষ এর বিপক্ষে। এই তর্ক বিতর্ক টানাপোরেনের মাঝে দেখা যায় মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। মানুষ আরও বেশি দ্বিধান্বীত হয়ে পরে। আজকের এই লেখাটা আসলে মুক্তসোর্স (ব্যক্তিভেদে উন্মুক্তসোর্স) নিয়ে আমার ধারনা সম্পর্কে।
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় মুক্তসোর্স বললে মানুষ মুক্তসোর্স সফটওয়্যারের কথা বুঝে থাকেন।
তবে মুক্তসোর্স কেবল সফটওয়্যারের ক্ষেত্রেই নয় বরং বিশ্বের প্রতিটি পন্যের সাথে প্রতিটি বিষয়ের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। উন্মুক্তসোর্স, আরেকটু ভালো করে বললে উন্মুক্ত সংস্কৃতি (free or open culture) আসলে একটি দর্শন, একটি আদর্শ। উন্মুক্তসংস্কৃতি একটি উন্মুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখায়।
আমরা ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরন করি। আহরন করতে পারি কারন সেগুলো আহরনের জন্য উন্মুক্ত।
কেউ বাধা দিচ্ছে না আমাদের এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আরও বিকশিত হতে। আমরা শিখি আগুন কিভাবে জ্বলে, আমরা জানি কিভাবে ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ধরে রাখা হয়। এই সবই হয়েছে উন্মুক্ত জ্ঞানের ভান্ডারের জন্য। এই উন্মুক্ত ভান্ডার কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজেকে আরও বিকশিত করে নতুন ধ্যান ধারনা জ্ঞানের দ্বার খুলে দেয় এবং তার দ্বারা আবিষ্কার করে নতুন অভিনব প্রযুক্তি।
কিন্তু একটা সময়ে এসে দেখা যায় ব্যবসার খাতিরে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে কিছু তথ্য গোপন রাখা হয়।
কিসের জন্য 'ক' ব্যাটারি 'খ' ব্যাটারির চেয়ে বেশিদিন টিকে। কি উপাদানের কারনে এই সুবিধা অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিসের জন্য ফেরারী গাড়ি টয়োটার চেয়ে দ্রুত ও ভালোভাবে চলছে। এগুলো ট্রেড সিক্রেট বা 'বানিজ্যিক গোপনীয়তা'-র আড়ালে রেখে দেয়া হয়েছে। আবার প্যাটেন্ট বা নিবন্ধনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হচ্ছে যাতে এই বিশেষ জ্ঞানগুলো যাতে অন্য কেউ ব্যবহার করতে না পারে।
এই বিষয়গুলো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের মানব জাতির অগ্রগতিকে পিছিয়ে রাখছে।
আমরা যদি আদর্শ পৃথিবীর কথা চিন্তা করি তাহলে কি এতোগুলো কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের প্রয়োজন আদৌ আছে কি? একটি কোম্পানি বা ব্র্যান্ড থেকেও কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট সেবা প্রদান সম্ভব। কিভাবে? এখনেই উন্মুক্ত সংস্কৃতি- আদর্শের কথা আসছে।
উন্মুক্ত সংস্কৃতি -উন্মুক্ত জ্ঞান, কিভাবে একটি জিনিস প্রস্তুত হচ্ছে, কিভাবে 'ক' ব্যাটারী 'খ' ব্যাটারীর চেয়ে বেশিদিন টিকছে এগুলোরই উন্মুক্ত জ্ঞান। এই উন্মুক্ত জ্ঞানের মাধ্যমে সর্বোৎকৃষ্ট পন্য উৎপাদন করা সম্ভব।
কেবল সেটাই নয়, যা এখনও আবিস্কার হয়নি, যে জ্ঞানের পথ কেউ দেখেনি সেই জ্ঞানের পথও এই উন্মুক্ত সংস্কৃতি দেখাতে পারে। কিভাবে? যতখানি জ্ঞান আছে আবিস্কার আছে কিভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে এটা যদি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে তাহলে বিভিন্ন মানুষ সেই জ্ঞানের চর্চা করতে পারে। উক্ত জ্ঞানের সুবিধা-অসুবিধা দেখতে পারে। পূর্বের উন্মুক্ত জ্ঞানের সাহায্যে পরীক্ষানিরীক্ষা সহজ হবে। অনেকে হয়তো ক্রুটি বের করবে অনেকে সমস্যার সমাধান বের করবে।
আবার পুরানো জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নতুন জ্ঞান নতুন প্রযুক্তির আবিস্কার সহজতর হবে।
এখন অনেকেই বলবে জ্ঞান উন্মুক্ত হলেই বা কি সবাই তো আর গবেষক-আবিস্কারক নয় যে নতুন তত্ত্ব নতুন প্রযুক্তি আবিস্কার করে ফেলবে। কথাটা ঠিক যে সবাই গবেষক নন, সবার মাধ্যমে কালজয়ী আবিস্কার হয় না। তবে সব আবিস্কারই কিন্তু গবেষণাগারে গবেষণার মাধ্যমে বের হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ন জ্ঞান, আবিস্কারের পিছনে ছিলো সাধারন মানুষের সাধারন কার্যকলাপ, সেই জ্ঞান, সেই কালজয়ী আবিস্কারই আমাদের মানব সভ্যতাকে এতো এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মুক্ত সংস্কৃতির মাধ্যমে নতুন আবিস্কার উন্মুক্ত বলে মূল ব্যবসায়ী জানছে এই নতুন আরও উন্নত প্রযুক্তি বা পদ্ধতির কথা। তখন তারা আরও পারদর্শীতার সাথে পন্য উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।
ধরুন আপনার প্রিয় কোমল পানীয়র কথা। কোকাকোলা অথবা পেপসি, অথবা স্প্রাইট অথবা সেভেন-আপ। এই কোমল পানীয়গুলো তৈরির প্রক্রিয়া কিছুটা উন্মুক্ত করে গোপন ফর্মূলা পেটেন্ট করে রেখে দিয়েছে এদের প্রস্তুতকারকেরা।
এর সম্পূর্ন বিপরীতে ছিলো উন্মুক্তসোর্স, উন্মুক্ত সংস্কৃতি জগতের অন্যতম উৎকৃষ্ট উদাহরন 'ওপেনকোলা'। 'ওপেনকোলা' প্রস্তুতপ্রণালী উন্মুক্তসোর্স মানে সবার দেখার পড়ার ও জানার অধিকার সমান ছিলো। এই 'ওপেনকোলা' প্রচারণামূলক কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে থাকলেও যুক্তরাস্ট্রে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো এবং বানিজ্যিকভাবে বেশ সফল হয়েছিলো। তাহলে কে বলে উন্মুক্তসোর্স উন্মুক্তসংস্কৃতি বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক?
তাহলে কি পৃথিবীর বানিজ্য-অর্থ-মুনাফা কতিপয় ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীর মুঠোয় থাকবে? সেটাও নয়, জাতীয়ভাবে এই উদ্যোগগুলো নেয়া হতে পারে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই নিয়োজিত হবে শ্রেষ্ঠ সেবা প্রদানের কাজে। ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা প্রতিযোগীতার অনুপস্থিতিতে? তাও ঠিক নয় হয়তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে আসবে কিন্তু তারপরও ব্যবসা বানিজ্য টিকে থাকবে, টিকে থাকবে তারাই যারা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তির পন্য দিচ্ছে।
এক্ষেত্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে বিভিন্ন জনপ্রিয় লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনের। লিনাক্সের বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশন উন্মুক্তসোর্সের হলেও তার পিছনে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিশেষায়িত সেবা প্রদান করে থাকে ব্যবহারকারীদের। এজন্য সম্পূর্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতোই তারা কাজ করেন।
অনেকে আবার ভেবে থাকেন উন্মুক্তসোর্স বা উন্মুক্ত সংস্কৃতির উদ্দেশ্য সবকিছু বিনামূল্যে প্রদান। এই ধারনা কিন্তু ভুল।
উন্মুক্ত জ্ঞান অর্থের বিনিময়ে হতে পারে তবে সেটি যতটা না জ্ঞানের জন্য তারচেয়ে বেশি সেবার (service) জন্য। ধরুন আমরা স্কুলে কলেজে জ্ঞান আহরনের জন্য যাচ্ছি। সেখানে জ্ঞান বইপুস্তকের মাধ্যমে উন্মুক্ত হলেও আরও বিস্তারিত বুঝানোর জন্য, শিক্ষকদের সেবার বিনিময়ে আমরা অর্থ প্রদান করছি। তেমনই কোন প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার প্রয়োজন হলে আমরা উন্মুক জ্ঞানটি অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে মূল্যের বিনিময়ে জানতে পারি।
আচ্ছা এবার নাহয় একটু বানিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরে আসি।
আমাদের দৈনন্দিন কাজে, সমাজ ও সংস্কৃতির দিক চিন্তা করলে কী পাই। পরিবার, সমাজ, জনপদ গড়ে উঠে কীভাবে ,কতিপয় মানুষের মাঝের উন্মুক্ত ও নিঃশর্ত সম্পর্কের কারনেই তো। এই নিঃশর্ত সম্পর্ক কি উন্মুক্ত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না? আপনি আপনার ভাইবোনকে নতুন জিনিস শিখাবেন সেই সাথে শিখাবেন আপনার বন্ধুকে। আপনার বন্ধু শিখাবেন তার ভাইবোন ও অন্য বন্ধুদের এভাবেই নতুন জিনিস অনেক দ্রুত আমাদের সবার মাঝে ছড়িয়ে পরে। আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য এভাবেই কিন্তু প্রসার ঘটেছে এবং এভাবেই আমাদের মাঝে থেকে যাবে।
নৈতিকতা, শিক্ষা, জ্ঞান, গল্প, গান, ছবি এগুলো সবই প্রসার ঘটে উন্মুক্ত হলে। আমার ভালো লেগেছে একারনে আমি সেটা আরেকজনের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। উন্মুক্ত সংস্কৃতিও একই কথা বলে। একটি ভালো জিনিস তৈরি হয়েছে সেটা কিভাবে তৈরি হয়েছে তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।
উন্মুক্ত সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য তাহলে কি?
-যেকোন বিষয়ের জ্ঞান উন্মুক্ত হবে
-সেই জ্ঞান প্রয়োজনে যে কেউ আহরন করতে পারবেন
-জ্ঞানটি যে কেউ প্রয়োগ করতে পারবেন
-আরও উন্নত কোন জ্ঞান ধারনা পাওয়া গেলে তা জানানো হবে
-উন্নত জ্ঞান পুনরায় সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।