আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আটলান্টিক পাড়ের সোয়ানসি-শেষ পর্ব

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....
রোসেলি বিচে আমাদের গন্তব্য শুধু সমুদ্রের ধারে বসে থাকাই ছিল না। আমরা প্ল্যান করেছিলাম হেঁটে ওয়ার্মস হেড নামে একটা জায়গায় যাবো। পরিকল্পনা মতো আমরা হেঁটে রওনা দিলাম। রাস্তার ধারে লেখা ওয়েলকাম টু ও রোসেলি দেখে আমরা একটু আমন্ত্রিত বোধ করলাম। কয়েকটা খানদানি রেস্টুরেন্ট ও বার আছে দেখলাম।

একপাশের পার্কিং লটে অনেক গাড়ি, কারাভ্যান পার্ক করা আছে। সামারে এ এলাকায় প্রচুর পর্যটক বেড়াতে আসে। বেশ কিছু ফ্যামিলি বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এসেছে দেখলাম। আবহাওয়াটা ঘুরার জন্য খুব ভালো ছিল। আগে আমি যা অনুমান করেছিলাম ঠিক তাই।

মেঘলা আকাশ। কিন্তু বৃষ্টি ছিলোনা। ফলে অনেকদূরে হেঁটে যাবার মতো এনার্জি ছিল। পাহাড়ি এলাকা। তাই গাড়ি থেকে নামলাম যেন পাহাড়ের মতো উচু উপত্যকার উপরে।

সেখান থেকে সমুদ্র অনেকটা নিচে দেখা যাচ্ছিলো। প্রায় ১০০ মিটার তো হবেই। ডান পাশে প্রায় চার মাইল লম্বা লাল বালুর বিচ। এ এলাকা অনেকটা উপদ্বীপের মতো। পশ্চিম দিকটা সোজা আটলান্টিকের দিকে চলে গেছে।

আর এর দুই পাশে দুইটা উপসাগর। আমাদের গন্তব্য ছিল এ এলাকার একেবারে পশ্চিমে আটলান্টিকের পারে। পিছনে কয়েকটা বেশ বড় পাহাড় দেখা যাচ্ছিলো। আর সেই পাহাড়ের গায়ে কয়েকটা বাড়িও ছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো আটলান্টিক পাড়ের এ বাড়িগুলিতে যারা থাকে তারা নিশ্চয়ই খুব সৌখিন.... যাওয়ার পথে স্থানীয় পর্যটকদের লক্ষ্য করছিলাম।

কেউ কেউ গাড়িতে করে সাইকেল নিয়ে এসেছে। একটা খুব ছোট বাচ্চাকেও সাইকেল চালাতে দেখলাম। পেছনে অন্য সাইকেলে তার বাবা-মা আছে। দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না....। আরেক বাচ্চাকে দেখলাম হামাগুড়ি দিয়েই মাটির টিলার উপরে উঠে গেছে।

মনে হলো বড় হলে বিশাল পর্বতারোহী হবে.... এই রাস্তা দিয়ে মাইল খানেক হাঁটার পর আমরা একটা ছোট অফিস ঘরের সামনে গিয়ে পৌঁছলাম। উপরে টাঙ্গানো পতাকা দেখে মনে হলো কোস্ট গার্ডের অফিস। কাছে গিয়ে দেখলাম, কয়েকজন কোস্ট গার্ড অফিসার বাইনোকুলার দিয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশের সাইনবোর্ডে লেখা বিপজ্জনক এলাকা। বাংলাদেশে কোস্ট গার্ডের ছবি তোলা নিষেধ।

এখানেও ছবি তোলা নিষেধ কিনা বুঝতে পারছিলাম না। এজন্য আমি ক্যামেরা গলায় ঝোলানো অবস্থাতেই ছবি তুলে ফেললাম। কিন্তু ছবি তোলা নিষেধ বা এরকম কোনো সাইনবোর্ড দেখলাম না। কোস্ট গার্ড অফিসের দিকে এগিয়ে যাওয়া মাত্র এক বয়স্ক কোস্ট গার্ড অফিসার এগিয়ে আসলেন। তিনি মুখে তর্জনি নিয়ে ইশারা করে আমাদের চুপ থাকতে বললেন।

আস্তে আস্তে কথা শুরু হলো। আমরা ওয়ার্মস হেডের পশ্চিমে যেতে চাই শুনে তিনি ব্যাপারটা বিপজ্জন বলে জানালেন। যাওয়ার রাস্তাটা বেশ বিজ্জনক আর জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে যায়। তিনি একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে, জানালেন জোয়ারের কারণে আজকে সেখানে গেলে অবশ্যই দুপুর ১টা ৪০ এর মধ্যে চলে আসতে হবে। অন্যথায় আসার রাস্তাটা পানিতে ডুবে যাবে।

তখন আমরা নির্জন দ্বীপটাতে আটকিয়ে পড়বো। ভদ্রলোকের আমাদের নিরবতার অনুরোধের কারণটা পরে বুঝতে পারলাম। কোস্ট গার্ডের অফিসের ভেতরে কোনো একটা শুটিং চলছিল। আমরা জোরে কথা বললে তাদের অসুবিধা হবে। কথাবার্তা শেষে আমি ভুল করে ভদ্রলোককে বেশ জোরেই ধন্যবাদ জানিয়ে ফেললাম।

এতে তার হাসি মুখটা আবার গম্ভীর হয়ে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলে নাই অবশ্য। কোস্ট গার্ড ভদ্রলোকের আন্তরিক কথাবার্তায় আমি মুগ্ধ। আমার মনে পড়লো, বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন্সের ছেড়াদিয়া দ্বীপও এমন বিপজ্জনক জায়গা। সেখানে যাবার পথটাও জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে যায়।

কিন্তু সেখানে এমন ওয়ার্নিং লেখা কোনো সাইনবোর্ড দেখিনি। কোস্ট গার্ডের একটা ঘাঁটি আছে। কিন্তু তাদের আমি কখনো পর্যটকদের সাথে কথা বলতে দেখিনি। যাই হোক, কয়েকটা ওয়ার্নিং লেখা সাইনবোর্ড আর জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম পাশ কাটিয়ে আমরা সাগরের দিকে নিচে নামতে থাকলাম। আমাদের এক বন্ধু এ এলাকা থেকেই নিচে নামার পরিকল্পনা বাদ দিলো।

বাকি তিনজন শেষ পর্যন্ত যাবো বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম। এ এলাকায় আমরা একা না। আরো বহু পর্যটক সেখানে এসেছেন। তবে সবাই ব্রিটিশ বা সাদা চামড়ার মানুষ। কোনো এশিয়ান বা কালো মানুষ এ এলাকায় ভ্রমণে আসে বলে মনে হলো না।

কিছুদূর যাবার পর এখানে যাবার মূল কষ্টটা বুঝতে পারলাম। যাওয়ার কোনো পথই নাই। যেতে হচ্ছে বেশ বড় বড় পাথরের চাইয়ের মধ্য দিয়ে। উঁচু নিচু পাথর ডিঙ্গিয়ে আধা মাইলের মতো যাবার পর আমরা ওয়ার্মস হেডে পৌঁছলাম। এরপর যাওয়ার পথটা এতোটা কঠিন ছিল না।

এতোদূর হেঁটে আমি ক্লান্ত ছিলাম। ক্ষুধাও কম লাগেনি। সামনে একটা খাড়া পাহাড়ের মতো উঁচু জায়গা ছিলো। উচ্চতা ৫০ মিটারের মতো হবে। আমি এক দৌড়ে সেটার উপরে উঠে গেলাম।

পাহাড়টার উপরে এতো বাতাস যে সাবধানে দাড়াতে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন বাতাসে উড়ে চলে যাবো। আমার পিঠে একটা ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগে বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসা নুডলস আর খাওয়ার পানি ছিল। নুডলস বের করে আমি খাওয়া শুরু করলাম।

জোরালো বাতাসের কারণে নুডলস চামচে থাকছিলো না। তাই খাওয়ার জন্য নতুন টেকনিক প্রয়োগ করতে হলো। খাওয়া দাওয়ার পর শরীরে কিছুটা শক্তি আসলে আবার আমরা পশ্চিম দিকে রওনা দিলাম। পশ্চিমে দ্বীপটা আরো মাইলখানেক গিয়ে শেষ হয়েছে বলে মনে হলো। আমরা টার্গেট করলাম একেবারে পশ্চিম পর্যন্ত যাবো।

এ এলাকায় প্রচুর পাখি দেখা যাচ্ছিলো। পাখি ভালো চিনিনা। কিন্তু এগুলিকে দেখে সিগাল বলেই মনে হলো। আমি কয়েকটার ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। ভালো ক্যামেরা হলে আরো ভালো হতো মনে হলো।

কিছুদূর যাবার পর আবার অনেকখানি উচু নিচু পাহাড়ি পথ পার হতে হলো। এরপর আমরা যে জায়গাটাতে পৌঁছলাম সেটাকে বইয়ের ভাষায় প্রাকৃতিক ব্রিজ বলা হয়। এর উপর দিয়েই রাস্তাটা পশ্চিমে চলে গেছে। কিছুদূর যাবার পর কয়েকজন ব্রিটিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। এখানে বেড়াতে এসেছেন।

ব্রিটিশদের অভ্যাসমতো একজন আমাকে জানালো, আজকের দিনটা খুব সুন্দর....। আমিও সায় দিলাম। আরো কিছুদূর যাবার পর পথটা আবার সমুদ্র থেকে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। এই পাহাড়টাই আমাদের শেষ গন্তব্য। এরপর আটলান্টিক মহাসাগরের শুরু।

পাহাড়ে উঠার পথেই ডান পাশে একটা গভীর খাদের মতো। সেখানে সমুদ্রের মাঝে বেশ বড় ঘূর্ণির মতো দেখা যাচ্ছিলো। একজন লোক সেদিকে তাকিয়ে কি যানি দেখছিলো। আমি যাওয়া মাত্রই সে আমাকে ডাক দিয়ে দেখালো, সিল সিল....। প্রায় ১০০ মিটার নিচে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে সমুদ্রের ঢেউ ভেঙ্গে পড়ছে আর তার পাশে পানিতে কয়েকটা গুহার মতো দেখা যাচ্ছে।

গুহার মুখে কালো কালো কয়েকটা সিল মাছ খেলা করছে। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ১০০ মিটার দূর থেকে জুম করে ধরতে পারছিলাম না। এরপর আমরা শেষ পাহাড়টাতে উঠে পড়লাম। এ পথটা বেশ খাড়া ছিল।

আমি একটু বান্দর টাইপের মানুষ। আমার কাছে এসব উচ্চতা কোনো বিষয়ই না। কিন্তু আমার বন্ধুদের উঠতে একটু কষ্টই হলো মনে হয়। উপরে উঠে আমরা খুব খুশি। বাতাসের ঝাপটায় সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না।

অনেক খাড়া পাহাড়। পড়ে গেলে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করাটা বৃথা। ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেলাম। তাড়াতাড়ি কয়েকটা ছবি তুলে আমরা আবার নিচে নামা শুরু করলাম। সময় অনেকখানি চলে গেছে।

খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে না পারলে জোয়ারের কারনে পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমাদের আর যাবার কোনো উপায় থাকবে না। আবার পথের পুরনো কষ্ট। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর আমরা নিরাপদে কোস্ট গার্ডের অফিসের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। এরপর আমরা আমাদের দ্বিতীয় ট্রিপ নিয়ে মাতলাম।

আটলান্টিকে স্পিড বোটে করে ঘুরার জন্য আমরা টুর কম্পানির অফিসে ফোন করলাম। তারা জানালো খারাপ আবহাওয়ার কারণে স্পিড বোট ট্রিপ বাতিল করা হয়েছে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো সময় স্পিড বোট ট্রিপ দিবো এমন পরিকল্পনা করে আমরা সোয়ানসি শহরে ফিরে আসলাম। সোয়ানসিতে গিয়ে নামলো বৃষ্টি। এদিকে ট্রেন ছাড়তেও দেরী আছে।

তাই আমরা কাছের স্টার সিনেমা হলে ঢুকে পড়লাম। সময় কাটানোর জন্য বেছে বেছে সেখানে সবচেয়ে লম্বা সিনেমাটা নেয়া হলো.... দি ডার্ক নাইট। দিনের ক্লান্তিতে ব্যাটম্যানের সিনেমাতেও আমাদের মন বসছিলো না। সিনেমা শুরু হওয়ার আগেই এক বন্ধু নাক ডেকে ঘুমানো শুরু করলো। আমিও কয়েকবার ঘুমে ঢলে পড়লাম।

সিনেমার শেষের দিকটা অবশ্য ভালোভাবেই দেখলাম। রাত সাড়ে দশটার ট্রেনে করে আমরা আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এবার যাত্রাবিরতি যে স্টেশনে ছিল সেটা সারারাত খোলা থাকে। সেখানে একটা ভাল ওয়েটিং রুমও ছিল। যদিও সাইনবোর্ডে লেখা ছিল রুমটা রাতে বন্ধ রাখার কথা।

কিন্ত আমরা চারজন আছি শুনে স্টেশনের অফিসার আর কিছু বললেন না। তাই এই রাতে আর কোনো অ্যাডভেঞ্জার করার সুযোগ পাওয়া গেল না। ছবি কৃতজ্ঞতা: সবচেয়ে উপরের আমার অসাধারণ ছবিটা তুলেছে বন্ধু সুমন (অন্যগুলো অবশ্য আমারই তোলা)।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.