ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....
ইংল্যান্ডে এসে কয়দিন বেশ ঘরকুনো অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু বন্ধুরা কোথাও বেড়াতে যাবার কথা বললে আমার পক্ষে না বলাটা খুব কষ্টকর। অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষাগুলো সব শেষ। এদিকে সাগর দেখিনা বহুদিন। ছোটবেলায় পড়া আরব্য রজনীর এ কথাটাই আমার মনে পড়লো.... 'সাগর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
'
কয়েক বন্ধু মিলে প্ল্যান করা হলো সোয়ানসি বেড়াতে যাবো। সোয়ানসি হচ্ছে ওয়েলসের একটা কাউন্টি ও শহর। সোয়ানসির সি বিচ খুব সুন্দর। আর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও নজরকাড়া। এখানকার যাবতীয় তথ্য, বাস-ট্রেনের টাইম টেবিল সবই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
যাবার আগেই ওয়েবসাইটে সোয়ানসি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করলাম। ভাবছিলাম আমাদের দেশে কবে পর্যটন স্থানগুলো সম্বন্ধে এতো তথ্য দেয়া হবে। পর্যটকরা এখন যে কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে ইন্টারনেটে বিস্তারিত জেনে তবেই যায়।
সমুদ্র তীরবর্তী এ শহরটিতে অতীতে ভাইকিংরা প্রচুর সংখ্যায় বাস করতো। তাদের হাতেই এ শহরটা গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়।
আমাদের যাত্রা পরিকল্পনায় ছিল সোয়ানসি থেকে কিছুটা দূরে রোসিলি নামে এক এলাকায় যাওয়া। আর স্পিড বোটে করে দুইটা ছোট দ্বীপ ভ্রমণ করা। সেই সাথে আটলান্টিকের পানির রংটাও দেখা হবে....
ট্রেনের টিকেট কাটা হলো। এখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ট্রেনের টিকেট কাটলে ভাড়া বেশ কম পড়ে। আমার বন্ধু বহু খোজখবর করে শেষ পর্যন্ত সোয়ানসির আপডাউন ট্রেনের টিকেট কাটলো।
ভাড়া জনপ্রতি ৩০ পাউন্ড করে। কিন্তু ট্রেন কয়েকবার বদলাতে হবে। আর রাতে চার ঘণ্টার একটা বিরতি আছে। সে সময় স্টেশনে বসে থাকতে হবে। সঙ্গে যাবে আামার তিন বন্ধু (এর মধ্যে দুইজন আবার স্বামী-স্ত্রী)।
আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমার ব্রেক জার্নি কিংবা স্টেশনে রাত কাটানো, এসব দিক দিয়ে কোনো অসুবিধা নাই। ওরা পারলেই হলো....
আগে থেকেই ইন্টারনেটে আবহাওয়াটা চেক করলাম। কিন্তু বিশেষ সুবিধার মনে হলোনা। সব আবহাওয়ার পূর্বাভাসেই এই এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হবে বলে লেখা আছে। কিন্তু সান্ত্বনা দিলাম এভাবে, এদেশে ভারী বৃষ্টিপাত মানে আমাদের দেশের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি।
একেবারে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিটা এই দেশে হয়না বলতে গেলে।
যাই হোক রাতে ট্রেনে করে রওনা দিলাম। বৃটেনে এটা আমার প্রথম ট্রেনে চড়া। স্টেশনে গিয়ে শুনি আমাদের ট্রেন ক্যানসেল হয়ে গেছে। স্পিকারে ঘোষণা আসলো, দেরী হওয়ার জন্য দুঃখিত... ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু তার তিন মিনিটের মাথায় নতুন একটা ট্রেনে আমাদের উঠিয়ে দেয়া হলো। ট্রেনটার ভেতরের সাজসজ্জা খুব সুন্দর। সিটগুলো অনেকটা প্লেনের সিটের মতো। তবে সবগুলোই ফিক্স। কোনোভাবেই হেলানো যায়না।
(ছবি: দ্রুতগামি ট্রেন থেকে বাইরের দৃশ্য)
রাত একটার দিকে আমরা স্রিউসবারি নামে এক ছোট্ট শহরে নামলাম। এখানে স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে ভোর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। কিন্তু স্টেশনে নেমে আমরা দেখি স্টেশন খুবই নির্জন। কর্তব্যরত অফিসার জানালো স্টেশন বন্ধ হয়ে যাবে, খোলা হবে ভোর সাড়ে পাঁচটার সময়। এ সময় স্টেশনের ভেতরে থাকা যাবে না।
আমরা বাধ্য হয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে আসলাম। এখানে চুরি-ডাকাতি ছিনতাই বলতে গেলে হয়ই না। এ কারনে ক্যামেরা আর জিনিসপত্র নিয়ে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে আমরা একটুও ভয় পাচ্ছিলাম না। তারপরও রাতে থাকার জায়গা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।
এর মধ্যে আমাদের একজনের আবার ঠাণ্ডা লেগেছে।
আবহাওয়া বাংলাদেশের শীতকালের মতোই হালকা ঠাণ্ডা। এরপর আশপাশে কোনো হোটেল আছে কিনা তার খোজখবর নেয়া হলো। কিন্তু কোনো হোটেল খোলা পাওয়া গেল না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা পার্কের মতো জায়গা আবিষ্কার করলাম। এর পিছনে আবার বেশ বড় একটা পাথরের তৈরি পুরনো আমলের বিল্ডিং।
অন্ধকারে বেশ বড় কয়েকটা কাঠের বেঞ্চিও পাতা আছে দেখলাম। আমি বন্ধুদের বললাম, এখানে ঘুমিয়েই আমি আজকের রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো।
তারা আমার কথাটা গুরুত্বের সঙ্গেই নিলো। এক বন্ধু ব্যাগটা বালিশ বানিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
আরেকজন বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে মন খারাপ করে আবার হোটেল খুজতে বের হলো।
সে জানালো, বিয়ে করার অনেক ঝামেলা।
আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম, পার্কের মধ্যে এতো সহজে আমার ঘুম আসবে না। তাই মোবাইল ফোন নিয়ে গেমস খেলা শুরু করলাম।
অন্যদিকে যে বন্ধু ব্যাগ মাথায় দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল সেও উঠে আসলো। খোলা আকাশের নিচে, শক্ত বেঞ্চে শুয়ে আগে কখনো ঘুমায়নি বলেই মনে হলো।
তাই বেচারার ঘুম হলো না।
আমি বলছিলাম, বেচারার ওই অবস্থার একটা ছবি তুলে সেইটা তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানো দরকার। দেখেন আপনাদের ছেলের অবস্থা। টাকার অভাবে পার্কে রাত কাটাচ্ছে.... আমার এই কথায় সবার মুখে হাসি ফুটলো।
এ সময় আমরা অন্ধকারেই পার্কে একটা বেশ বড় মূর্তি আবিষ্কার করলাম।
এতো বড় মূর্তি দেখে জাদরেল কোনো মানুষেরই মনে হলো।
আশপাশে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই দেখে আমরা অবাক হচ্ছিলাম। এতোক্ষণ এ এলাকায় আছি। এখনো অন্য কোনো মানুষের টু-শব্দটাও পেলাম না।
এর মধ্যে আমি যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো, নামলো বৃষ্টি।
পাশে একটা ছোট গেটের মতো ছিল সেখানে গিয়ে আমরা আশ্রয় নিলাম। রাতে ঠাণ্ডাও বাড়ছিল। সেখানে একটা সিঁড়ির মতো ছিল। সেই সিঁড়িতে বসে আমি জ্যাকেটটার ভেতরে ভালোভাবে ঢুকে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম। সেখানে ওভাবেই কিছুক্ষণ ঘুমালাম।
বৃটেনে এখন ভোর পাঁচটার আগেই আকাশ ফর্সা হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর আকাশ ফর্সা হয়ে আসলো। আমরা আবিষ্কার করলাম, আমরা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় আজকের রাতটা কাটিয়েছি। মূর্তিটা চার্লস ডারউইনের। আর আমরা যেখানে আজকের রাতটা কাটালাম এটা ডারউইনের স্কুল নামে খ্যাত।
কিং এডওয়ার্ড-৬ প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন ডারউইন। পরে স্কুলটাকে লাইব্রেরীতে পরিণত করা হয়েছে। পাথরের তৈরি বিল্ডিংটাও খুব সুন্দর।
স্রিউসবারি শহরটাও খুব সুন্দর পুরনো শহর। লাইব্রেরীর বিপরীত দিকেই একটা খুব সুন্দর প্রাচীন কেল্লা ছিল।
পরে আবার একসময় এই শহরটা দেখতে আসবো, এমন পরিকল্পনা করে কয়েকটা ছবি তুলে আমরা স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।
সোয়ানসি নেমে আমরা রোসিলি বিচে যাবার জন্য খুব সুন্দর একটা বাসে উঠলাম। যাবার রাস্তাটা খুব সঙ্কীর্ণ ছিল। ইংল্যান্ডে সাধারণত এমন রাস্তা দেখা যায়না। বড় দুইটা বাস পাশাপাশি চলতে পারছিলো না।
এ কারনে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িকে সাইড দেয়ার জন্য ড্রাইভারের দুইবার গাড়িকে বেশ কিছুটা ব্যাক করা লাগলো। এ ঘটনা দেখে আমি হেসেই ফেললাম। বৃটেনের রাস্তারই এ অবস্থা....
ড্রাইভার অবশ্য বেশ পাকা ছিল। আর গাড়িটাও উন্নতমানের। খুবই স্মুথ চলে।
এটা গ্রাম অঞ্চল। তাই দেখলাম গাড়ির যাত্রিরা পরস্পর পরিচিত। কয়েকজন মহিলা নিজেদের মধ্যে বেশ সরব হয়ে গল্প করতে লাগলো।
রোসিলি নেমে প্রথম দর্শনেই আমরা পাহাড় আর সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। এ এলাকার বামপাশে মিউসলেড বে, ডানে রোসিলি বে আর সোজা তাকালে আটলান্টিক মহাসাগর।
এখানকার লাল বালির এই বিচের দৈর্ঘ্য প্রায় চার মাইল।
উইকিপিডিয়ায় দেখুন....
http://en.wikipedia.org/wiki/Rhossili
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।