আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাহাজী জীবনের গল্প: আটলান্টিক ঘুরে নাইজেরিয়া: কালো মেয়ের রূপকথা (২)

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

জোয়ার আসার পর ছাড়লো জাহাজ। এর মাঝে জাহাজ চালনোর ভার নিয়েছেন এক নাইজেরিযান পাইলট। যে কোন দেশের নিজস্ব সমুদ্রসীমায় প্রবেশের পর এমনি এক পাইলটের হাতে ভার দেয়াটাই আন্তর্জাতিক নিয়ম। কিন্তু তা নিয়েও ঝামেলা হয়েছিল একটা। প্রথম জাহাজে উঠেছিলের একজন অঅনোমোদিত পাইলট।

পরে নৌকা নিয়ে জাহাজে ওঠে তাকে তাড়া করেন অনুমোদিত একজন। প্রথমজন পানিতে ঝাপ দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। তৃতীয় বিশ্বের এক অনুন্নত দেশে এসব ঘটনা তেমন বেশী অবাক করে না কাউকে, যদিও আমরা ছোরা হাতে তাড়া দেখে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বেশ। ধীরে ধীরে ওয়ারী বন্দরের জেটিতে ভিড়লো আমাদের জাহাজ। ঠিক সেই মুহুর্তেই ছেড়ে যাচ্ছে আরেকটি বন্দর ছেড়ে।

সে জাহাজের নাম দেখে চমকে উঠলাম। 'এলপিদা' ! আমাদের চার বন্ধুর একজন, আমার স্কুলজীবনের সবচে্থ ঘনিষ্ট শাজাহান তো কাজ নিয়েছে এই জাহাজেই। ইস্তাম্বুলে আমাদের আলাদা হয়েছিল পথ। তারপর দু্থ তিন পরপর চিঠির যোগাযোগ ছাড়া আর কোন যোগাযোগ ছিল না। আমরা চার বন্ধু আবার একসাথে হবো, সে শপথ তখনো অটুট।

দ্রুত এসে ডেকের বাইরে দাঁড়ালাম। শাজাহান দেখলো আমাদের। আমাদের জাহাজের নাম তার চোখেও পড়েছিল। আমরা হাত নাড়লাম। মন খারাপ হলো খুব।

এত কাছে একই বন্দরে আসার পরও প্রিয় বন্ধুর সাথে কোন কথা হলো না ভেবে ভীষন খালি খালি লাগলো বুকটা। এলপিদা অদৃশ্য হবার পর পরই নিজের কেবিনে গিয়ে অন্ধকারে ডুব দিলাম। এতেদিন লম্বা ভ্রমণের পর পায়ের নীচে শক্ত মাটির আহব্বান, আবার মানুষের জগতে পদার্পণ, কিছুই আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় ডেকে আনতে পারলো না। রাত এগারোটায় বেরিয়ে এলাম বাইরে। এক ঘন্টা পর নামতে হবে মেশিনরুমে।

বাইরে এসেই দেখি জাহাজের চেহারা আন্যরকম। কৃষ্নসুন্দরীদের ভীড়ে উপচে পড়ছে জাহাজ। নাবিকবন্ধুদের চোখে আনন্দের ফোয়ারা। চারদিকে কেমন উৎসব উৎসব ভাব। ক্যপ্টেন অফিসারদের মুখে আনন্দ ও প্রশ্রয়ের হাসি।

ডেকের উপরে যে যার সঙ্গীনি খুজে নিয়ে আলাপে মশগুল। দেখেই অবাক হয়ে গেলাম। তারপরও সারা জীবনের সামাজিক যে শিক্ষা নিজের ভেতরে, তাই বড় হয়ে উঠলো। সবাইকে পাশ কাটিয়ে তাই কিচেনে ঢুকলাম এক কাপ কফি হাতে মেশিনরুমে ঢোকার জন্যে। তক্ষুনি একটি মেয়ে এসে ঢুকলো কিচেনে।

কোমর জড়িয়ে ধরে বললো, - আমি তোমার সাথে যাব। নিজেকে ছাড়নোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মেয়েটি সহজ পাত্র না। ছাড়লোনা কিছুতেই। জাহজের মেসবয় সোমালিয়ান আলী কে পেছনে খিক খিক করে হাসতে দেখে পিত্তি জ্বলে উঠলো।

কিন্তু তাতে কি লাভ। মেয়ের বজ্রআটুনী তো তাতে সামান্যও নরম হলো না। বললাম, - ডিউটি আছে এখন আমার। - কতোক্ষন ডিউটি ? - ভোর চারটা অবধি। - তাহলে তখনই তোমার কেবিনে আসব।

আমি কোন উত্তর দেয়ার আগেই কথা বলে উঠলো আলী। - আমি তোমাকে তার কেবিনে পোঁছে দেব। আলীর আশ্বাসে ছাড়া পেলাম। কথা বাড়াতে চাইলাম না আর। কফির কাপ হাতে দ্রুত পালালাম জাহাজের খোলে।

নীচে গিয়ে কয়েকটা মেশিন চেক করে আবার ডুবে গেলাম এলপিদা ও আমার বন্ধুর ভাবনায়। বাইরে সবার আনন্দ আমার বিষন্নতা না কমিয়ে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি দিন বা একটি ঘন্টা যদি বন্ধুর সাথে কাটাতে পারতাম! শব্দ শুনে উপরে সিড়ির দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে থ্থ হয়ে গেলাম। জাহাজের থার্ড ইন্জিনীয়ার সে মেয়েটিকেই কোলে করে ধীরে ধীরে নামছে। নেমেই খুব যত্নে একটি কাপড় বিছালো কালিমাখা মেঝের উপর।

সাবধানে মেয়েটিকে দাড় করালো কাপড়টির উপর। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। - আনন্দ করো। মজা করো। পরিস্কার কথা থার্ড ইন্জিনীয়ারের।

তার মুখে মৃদু হাসি। মনে হলো আমাকে জব্দ করতে পেরে মহানন্দে। একটু আগে যে কিছু কাজ চাপিয়েছিল মাথায়, বেমালুম ভুলে গিয়েছে। কিন্তু আমি রেগে গেলাম খুব। - একটু আগে কাজ দিয়েছ।

এখন আবার নিয়ে এসেছ একে ! ভাগো জলদী। একেও সাথে নিয়ে যাও। আমার বিরক্তি টের পেয়ে আর কথা বাড়ালো না ইন্জিনীয়ার। মেয়েটিকে সাথে করে আবার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে আবার ডুবলাম নিজের ভাবনায়।

ভোর চারটায় ডিউটি শেষ হবার পর উপরে গেলাম না। ইন্জিনরুম থেকে জাহাজের পেছনে প্রপেলার পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। সুড়ঙ্গের শেষে একটি সিড়ি বেয়ে পৌছানো যায় কেবিনে। এই পথেই খুব কষ্টে কোনক্রমে পৌছলাম কেবিনে। পৌছেই বাতি না জালিয়েই শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

একটু ঘুম এলো চোখে। আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আলীকে সাথে করে মেয়েটি ঢুকলো ঘরে। আলীর মুখে শয়তানী হাসি। মাথায় রক্ত চড়ে উঠলো। দরজার দিকে আঙ্গুল তুলে ্তুগেট আউট, গেট আউট বলে চিৎকার্থ করে উঠলাম।

মেয়েটি থতোমতো চোখে তাকালো একবার, কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। ওর চোখের দৃষ্টিতে আমার বিষন্ন মন আরো বেশী বিষন্ন হলো। ওয়ারীতে এক সপ্তাহ ছিলাম। এখানে থেকে মনে হলো, নাইজেরিয়ায় মেয়েদের বয়প্রাপ্তির পর দুটো ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ গৃহবধু ও আরেক ভাগ দেহপশারিনী।

কথাটা এক নাবিককে বলার পর সে ভুল শুধরে বলল, এটা হচ্ছে শুধুমাত্র বন্দরেরই চেহারা। বাংলাদেশের খুলনা বন্দরেও সে একই চেহারা দেখেছ। আরো কয়েকজন নাবিনেরও খুলনার কথা বলে চোখ চকচক করে উঠতে দেখলাম। জাহাজে এই একটি সপ্তাহ ধরে এই মেয়েদের নিয়ে তুলকালাম কান্ড চললো। এত সস্তায় এমন সার্ভিস পাওয়া তো সহজ কথা নয়।

আশি বছরের ইজিপশিয়ান মুসলিম বারবাও বাদ গেল না। তার ঘরে কোন মেয়ের অন্তর্বাস খুজে পাওয়ায় হাসির রোল উঠলো সবার মাঝে। লজ্জায় লুকোলো বারবা। কয়েকজন সেই অন্তর্বাসকে পতাকা বানিয়ে পুরো জাহাজ বারবাকে খুজে বেড়ালো। আমরা জাহাজে এক কার্টুন সিগারেট পেতাম দুই ডলারে।

এই এক কার্টুনে সারারাতের সার্ভিস আমি ও আমার বন্ধু বাদে সবাই নিয়েছে। প্রায়ই সিফিলিসের প্রতিশোধক ঔষধ বিলি করা হতো। আমাদের তার দরকার না পড়ায় নিজেরাই হাসির পাত্র হয়েছি। অনেকে নানা সন্দেহে বাঁকা কথার বার ছুড়েছে। আমাদের সহানুভুতি ছিল এই মেয়েদের প্রতি।

সেই মেয়েটিকে এক কার্টূন সিগারেট দিয়েছি। অন্যদের মাঝেও বিলিয়েছি অনেক। তাদের দু:সহ জীবনের কাহিনী শুনেছি মন দিয়ে। তাদেরই দু:খে কষ্ট পেয়েছি। দুটো গরীব দেশের মানুষ হিসেবে যতোটা একাত্মতা থাকা দরকার, তার পুরোটাই আমরা অনুভব করেছি।

মেয়েগুলোও তা অনুভব করেছে, আমাদের কাছ থেকে পাওয়া সন্মানে আপ্লুত হয়েছে। তাই ওয়ারী থেকে যখন বিদায় নিল আমাদের জাহাজ, নৌকো করে যতদুর সম্ভব, ততদুর এলো ওরা আমাদের সাথে। শেষ অবধি হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের নাম ধরে ডেকে বিদায় নিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.