যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
রফিকের বিষন্ন সময় যাচ্ছে। বড় বড় অনুষ্ঠানগুলো একেএকে শেষ হয়ে গেল। সামনে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাইকে একত্রিত করার মত ভাল কোন পর্ব নেই। হ্যা - যেকোন একটা উপলক্ষ্য বানিয়ে সবাইকে দাওয়াত দেয়া যায় বটে, কিন্তু সেটা ঠিক আন্তরিক হবে না। কেউ ব্যবসায়িক স্বার্থ, আভিজাত্য গুলিয়ে ফেলতে পারে।
জন্মদিনের ঘটা করে আয়োজন ঠিক রুচিসম্মত নয়। বিবাহ-বার্ষিকী অনেক পুরাতন হয়ে গেছে, ঠুনকো সম্পর্কগুচ্ছ কিছু লোক দেখার কোন মানে হয় না। একমাত্র ছেলের মুসলমানী ধুমধাম করে দিয়ে মনে হলো শেষ বড় অনুষ্ঠানটাও শেষ করে ফেললো। যদিও মুসলমানীর অনুষ্ঠান আকীকার চেয়েও কম ভাবগাম্ভীর্য্যের, উৎসবের উপলক্ষ্যটাও তেমন জাকালো নয়। আজকালকার শহুরে লোকেরা আমলও দিতে চায় না।
ফের নতুন এমন অনুষ্ঠানের লগ্ন এই ছেলের বিবাহ উপলক্ষ্যে ঘটতে পারে। কিন্তু সে তো মেলা দিনের ইতিহাস। সবেমাত্র ছেলের বয়স সাত পেড়ুলো।
ছোট বোনের বিয়ে নিয়ে শোরগোল করা গেছিল। কয়েক দিন ব্যাপী হুলস্থুলে কান্ড।
এরপরে ভাইয়ের বিয়েতেও নানা আয়োজন করা গেছে। দুই ভাই বোনের বাচ্চা-কাচ্চা হলে সেগুলোতে নানা পর্ব মেপে ঝেপে বছরে তিন-চারটে অনুষ্ঠান একদম পরিবার কেন্দ্রিক মিলনাত্মক সমাবেশ করা গেছিল। এছাড়া ছিল দাদা, দাদি আর নানার মৃত্যু উপলক্ষ্যে মিলাদ-মাহফিল, কাঙালিভোজ। বিষয় চরিত্রে এমন শোকাবহ অনুষ্ঠানগুলোও প্রকারন্তরে মিলন-মাহফিল হয়ে উঠেছিল। ঈদ, কোরবানী, সাংস্কৃতিক দিবসগুলো তো সবার, কিন্তু যে অনুষ্ঠানে রফিক মধ্যমনি তেমন আয়োজনের কোন উপলক্ষ্য এখন আর চোখের সামনে নেই।
রফিক অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্য তৈরী করে। স্ত্রীকে একদিন রাতের খাবারের সময় বলে, চলো এবার আমরা একটা গেট টুগেদার পার্টি দেই!
শান্তা প্লেটের প্রান্তে রাখা বোম্বাই মরিচ খুটে খুটে ভাতে মিশাচ্ছিল। জিভে ঝালের পরশ পরখ করতে করতে বলে, ক্যান?
রাতুলের তো মুসলমানী হয়ে গেল তিন চার মাস হয়ে গেলো। সবাই মিলে একটু হৈচৈ করি! কতদিন উত্তরার মামাদের দেখি না!
শান্তার হাতে গ্লাস, ঢকঢক করে গলায় ছেড়ে বলে, তুমি তো গিয়ে দেখা করে আসতে পারো!
ক'জনের সাথে দেখা করবো? শ্যামলীর পরান চাচাকেও তো দেখি না অনেক দিন, শারমিন ফুফু তো এই গ্রীন রোডেই থাকেন, তার সাথেও দেখা হয় না মাস খানেক হলো! রফিকের খাওয়া শেষ, চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে বলতে থাকে।
শান্তার মুখে তীর্যক একটা ছায়া খেলা করে।
খাওয়া শেষ হলে সেও উঠে দাড়ায়, রফিকের মাথায় একটা চাটকা মেরে বলে, কি হলো তোমার? সময় করে সবার সাথে দেখা করে আসলেই তো হয়! ঘটা করে আয়োজন করার কি দরকার?
রফিকের অনুষ্ঠান প্রীতি শান্তার ভাল করেই জানা আছে। ঠুনকো অজুহাতে দু'চারশো লোক খাওয়ানোর ধকল তার উপর দিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকবার। এখন আর এসব ভালো লাগে না। কিন্তু রফিক এই উপলক্ষ্যগুলোতে উৎফুল্ল হয়। তার মনে হয় নিমিষে তার আপন বিশ্ব দেখা হয়ে যায়।
শান্তাকে বলে, তুমি বুঝবে না, সবাই মিলে একটু মজা করে খেলাম, গল্প করলাম, এমন মুহূর্ততো সব সময় আসে না!
রফিক জানে তার এসব ভালো লাগাগুলোকে শান্তা তেমন বাধার সৃষ্টি করে না। সেজন্য মতামত তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয়। কষ্ট সব যায় বাবুর্চির উপর দিয়ে, যেটুকু কষ্ট তা কেবল এই আমন্ত্রণ প্রেরণ নিয়ে। ফোন করা, কার্ড বিলি করা - এগুলোতে রফিক শান্তাকে একজন অভিজ্ঞজন হিসাবে পেয়ে যায়।
কিন্তু এখন আসলেই কোন পর্ব নাই।
তবে অকষাৎ কত কিছুই হতে পারে। হুট করে তার কোন রিলেটিভ মরে যেতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের কারো বাড়ীতে বিয়ের উৎসব লাগতে পারে, কোথাও কারো সন্তান হতে পারে। এসব সুযোগ করে দেয় অংশ গ্রহণের কিন্তু রফিক সেখানে আয়োজক নয়, রফিককে ঘিরে সে মিলন-সমাবেশ নয়।
ঈদ, নববর্ষে কাউকে দাওয়াত দেয়ার বিষয়টা আগেই পরিত্যক্ত।
এই দিবসগুলো অন্য কারো, রফিকের নিজের নয়। নিজের হতে পারে কেবল নিজের বিবাহ হলে, যেটা সে আগেই করে ফেলেছে, যা নিয়ে দশ-বারোটা অনুষ্ঠান বিবাহ বার্ষিকী মিলেঝুলে হয়েও গেছে। গত বছরই বন্ধুরা টিটকারী মেরে গেছে, মাসে মাসে বিবাহ বার্ষিকীর করার পরামর্শও দিয়ে গেছে কেউ কেউ।
এসবের চেয়ে স্বত্বস্ফূর্ত সমাবেশ বরঞ্চ রফিকের দাদির মৃত্যুতে হয়েছিল। কাউকে বলতে হয়নি, অথচ কি প্রানবন্ত অংশগ্রহণ।
রফিক এজন্য সুযোগ বুঝে পরপর তিনদিন বিভিন্ন প্রোগ্রাম রেখেছিল। দ্বিতীয় দিন কোরআন-খতম, তৃতিয় দিন মিলাদ, গরীবদের খাওয়ানো , চতুর্থদিন আত্মীয়স্বজনদের এক্সক্লুসিভ ভোজসভা। এমন সুযোগ রফিকের বাবার মৃত্যুতে আবার ঘটতে পারে। এ পর্যন্ত ভাবতেই রফিক সম্ভাবনা দেখে। কিছুদিন যাবত বাবা অসুস্থ্য।
মরার সময়ও হয়েছে বলা চলে। সত্তর ছুঁইছুই বাবা হয়তো কিছুদিন পরে মরে গিয়ে রফিকের একটা অনুষ্ঠানের সিডিউল দিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু এরপরে কি!
শেষ রাতে রফিকের ঘুম ভেঙে যায়। কিছু বোঝার আগেই খাদ্যনালীতে টের পায় কোন আটকে যাওয়া ঘোৎ ঘোৎ। যখন সবকিছু নীল হয়ে যায় তার চোখের সামনে - সাত সকালে রফিকের মনে হয় বড্ড জলদি বাড়িতে নতুন একটা অনুষ্ঠানের হিড়িক পড়লো। পার্থক্য কেবল সামান্যই - রফিক সেখানে থাকলো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।