(সুমন প্রবাহন আত্মহত্যা করেন ১৯শে এপ্রিল। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর ২৫শে এপ্রিল তাঁর বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছবির হাটে সুমনের স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং একইসাথে তারা 'একখন্ড একাকীত্ব' নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে যা অনুষ্ঠান শেষে বিনামূল্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। তাই ধারাবাহিকভাবে এখানে প্রকাশিত হলো )
গোধূলী দহনে কবির প্রস্থানে
অভিজিৎ দাস
কে?
কেউ নও কারো নই!
নিজের ঘরে নিজেই কবর খুঁড়ি
শুয়ে পড়ি কবরের হা-য়ে
কবি সুমন প্রবাহন আত্মহত্যা করেছেন এ খবরটি যখন নগরের তার বিচরণ ক্ষেত্রে তথা পরিচিত পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে, সকলেই হতবাক হয় কিন্তু এটি ততটা অপ্রত্যাশিত কোন সংবাদ হয়ে আসে না। কেননা যেন অনিবার্য ছিল এই-ওর মৃত্যু। কবি সুমন প্রবাহনের মৃত্যুকে অকাল প্রয়াণ বলে অভিহিত করা যাচ্ছে না।
কারণ ওর মৃত্যুটি ছিল একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার নিঃশব্দ অবসান। যার স্বেচ্ছা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে গেল সবাইকে। এই মৃত্যুটি সকলের জন্যই হয়ে উঠেছিল আত্মহন্তারকের ভূমিকা। কোন এক মধ্যাহ্নে সিলিং ফ্যান থেকে মেঝের দূরতের মধ্যবর্তী শূণ্যতায় ভর করে কবি সুমন প্রবাহন পাড়ি জমিয়েছে অন্য ছায়াপথে। দিবসের মধ্যভাগের সূর্যকে মাথার ওপরে রেখে ওর মেলে দেয়া ডানার ঝাপট আমরা শুনতে পাই নি, এতটাই বধির হয়ে গেছি।
অথচ এর পূর্বাভাস সুমন আগেই দিয়েছিল আমাদের।
পায়ের নিচে পৃথিবী গোলক ঠেলে দিয়ে
মেলে দেবো ডানা দুই ছায়াপথে
যে কবি নীরবে নিজের ঘরে নিজেই খুঁড়েছে কবর। আদৌ কবর কি?
পারিবারিক সূত্রে প্রদত্ত মোঃ মশিউর রহমান সুমন নামের যে শিশুটি সত্তর দশকের মধ্যভাগে ১৯৭৬ সালের ১১ নভেম্বর তার পৈত্রিক ভিটা সমুদ্র উপকুলবর্তী জেলা শহর পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার বাজিতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বত্রিশ বছরের ব্যবধানে এসেই কবরের হা-য়ে সে খুঁজে নিয়েছে নিজের বসত। পিতা এম ওয়াজেদ আলী খানের কর্মসূত্রে সুমন প্রবাহনের শৈশব কেটেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এয়ার ফোর্স কলোনিতে। ভীষণ দূরন্তস্বভাবের এই শিশুটি পরিণত বয়সে এসে চুপচাপ,শান্ত ও মিতভাষী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়।
অসম্ভব ঘোরগ্রস্থতা আচ্ছন্ন করে রাখত এই আত্মমগ্ন ধ্যানী কবিকে।
ঢাকা বড় মগবাজার, মীরবাগ হোসেন আলী উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালে শুরু হয় স্কুল জীবন। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করে সে। ইতিমধ্যে সুমনের পিতা কর্মসূত্রে দেশের বাইরে পাড়ি জমান। পরিবারে তিন ভাইবোনের মধ্যে সুমনের অবস্থান ছিল মেজো।
বড় বোন সায়রা জেসমিন সীমু ও ছোট ভাই তসলিম সহ ১৯৮৪ সালে সুমনের মাতা দিলারা বেগম পারুল ওদের পূর্বপুরুষের ভিটায় ফিরে যান। সেখানে সুমন তার জন্মস্থান বাজিতা গ্রামের বাজিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে লেখাপড়ার পর পঞ্চম শ্রেণীতে চলে আসে বরিশাল শহরের বগুড়া রোড অক্সফোর্ড মিশন বিদ্যালয়ে। এ সময় সুমন তার মা ও ভাইবোনের সঙ্গে বরিশাল শহরের গোরস্থান রোড ধোপা বাড়ির মোড় সংলগ্ন এলাকায় বাস করতে শুরু করে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে স্কুল পরিবর্তন করে তাকে ভর্তি করা হয় বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে (কবি জীবনানন্দ দাশ এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন)।
সেখানে এক বছর শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হবার পর সপ্তম শ্রেণীতে এসে ভর্তি হয় বরিশাল উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে। ইতিমধ্যে সুমন প্রবাহনের পিতা দেশে প্রত্যাবর্তন করলে তারা সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসে। ঢাকায় এসে দশম শ্রেণীতে ক্যান্টনমেন্ট শহীদ রমিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাশ করে। বরিশালে থাকাকালীন সুমন যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন তার কবিতা লেখার শুরু।
এ সময়ে তার নিয়মিত ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল। এসএসসি পাশের পর সুমন একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজে। ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গল্প থিয়েটার নামক একটি নাট্য সংগঠনের সাথে যুক্ত হয় সে। সেখানে নিয়মিত নাট্য চর্চায় সম্পৃক্ত থেকে এ বছরেই জানুয়ারি মাসে তার এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র চার মাস আগে শাহবাগ মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে গুরুতর আঘাত পায়। অসুস্থ হয়ে তাকে তিন মাস ধানমণ্ডির একটি কিনিকে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়।
ফলে সে বছর আর এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠে না সুমনের। এর পরে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেদ ঘটে। এই পর্বে কাব্য রচনায় তুমুল আগ্রহ নিয়ে মনোনিবেশ করে সে। ১৯৯৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তার এক কাজিনকে সঙ্গে করে কবি সুমন প্রবাহন শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে আসে, সঙ্গে কবিতার খাতা। সেখানে বেশ কয়েক জন তরুণ কবির সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
যাদের সঙ্গে পরবর্তিতে তার নিবিড় সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর নিয়মিত সে শাহবাগ আসতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে ফিল্প এপ্রেসিয়েশন কোর্স ও পাঠ চক্রে সক্রিয় সদস্য হিসেবে অংশ নেয়। পাশাপাশি মাহাকাশ বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতুহলি হয়ে ওঠে এসটোনোমিক্যাল এ্যসোসিয়েশনের সাথে সম্পৃক্ত হয়। এরই মধ্যে সুমনের সঙ্গে আজিজ সুপার মার্কেটের দোতলার পুবের বারান্দায় আড্ডারত একদল তরুনের পরিচয় হয়।
এ সময় তাদের উদ্যোগে কালনেত্র নামে একটি ছোট কাগজ প্রকাশিত হলে সুমন এই পত্রিকা গোষ্ঠির সঙ্গে সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত হয়। তার কবিতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট কাগজে প্রকাশিত হতে শুরু করে। ২০০১ সালে সুমন প্রবাহন ও তার দুই কবি বন্ধুর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ছোট কাগজ বুকটান। এ সময় তার কৈশোরের শহর বরিশালের সাথে এক ধরনের যোগযোগ পুনস্থাপিত হয়। এ ছাড়া ফরিদপুরে তার একমাত্র বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাবার সুবাদে সেখানে ভূমিজ নামক একটি ছোট কাগজের আড্ডায় অংশ নেয় সে।
ভ্রমণ প্রিয় সুমন প্রায়শই বরিশাল ও ফরিদপুরে ঘুরে বেড়াত। ঢাকার নাগরিক জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল চষে বেড়ায় সে। এ বছরেই কবি সুমনের জীবনে ঘটে যায় বড় এক অঘটন। যা তার পরবর্তি জীবনকে ব্যাপক প্রভাবান্বিত করে, পাল্টে দেয় তার চেতনালোক। এ বছর ২৪ আগষ্ট সুমন প্রবাহনের মা দিলারা বেগম পারুল মৃত্যু বরণ করেন।
তার মৃত্যুতে সুমন মানসিক ভাবে যার পর নাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চরম আবেগাপ্লুত এই কবি আর কখনই সহজ স্বাভাবিক উচ্ছলতায় ফিরে আসেনি। সদা হাস্য উজ্জল, প্রণাবন্ত সুমন তার জীবদ্দশায় মাতৃবিয়োগের শোক আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি কোনদিন। এর পর থেকে তার মানসিকতা ও আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মাতৃ মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে না পারার দরুন সুমন ক্রমশই অবসাদগ্রস্ত ও বিষন্ন হতে থাকে।
মাকে হারিয়ে তার জীবন যাপন তথাচেতনালোকে গভীরতর আলোড়ন তোলে। এ সময়ে তার একাকীত্ববোধ চুড়ান্ত রূপ লাভ করে। মাতৃবিয়োগের শোক সামলে ওঠা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে সুমনের। ২০০৩ সালে তার বিসন্নতা ও অবসাদ গ্রস্ততা প্রকট আকার ধারণ করে। তবে কাব্য চর্চা তথারীতি অব্যাহত থাকে।
সুমন তার একসময়ের সতির্থদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চরম নিঃসঙ্গতায় নির্বাসিত হয় নিজেরই ভুবনে। যেন একাকিত্বের উপাসনায় ব্রতী কোন ঋষি পুরুষ। এ সময় নিজের ঘর থেকে বেড়োনোর সুযোগ খুব একটা হতো না তার। মাঝে মধ্যে হুটহাট বন্ধুদের কাছে ছুটে যেত সে, ঘরে ফিরতে চাইতো না সহসা। সংসারের প্রতি চরম বৈরাগ্য ভাব দেখা দেয়।
তথাপি ঘরে ফিরতেই হয় তাকে। এর পর দীর্ঘ কাল অন্তরালে থাকায় সুমন প্রবাহন প্রায় বিস্মৃত একজনে পরিণত হয় তার এক কালের সতীর্থদের কাছে। কালে ভদ্রে শাহবাগ বা চারুকলা অঞ্চলে আসলে কিংবা বিশেষ কোন দিবসকে উপলক্ষ্য করে বাইরে যাবার সুযোগ করে উঠতে পারলে বন্ধুদের কারও কারও সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়ে যেত। এ সময়ে সুমনের ব্যাক্তি জীবনের বিবর্তনের পাশাপাশি তার বাহ্যিক অবয়বেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন।
২০০৫ সালে পরিবার থেকে তাকে পাঠানো হয় মনমিতা মানসিক হাসপাতালে।
সেখানে প্রথম দফায় ২০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তাকে ফিরিয়ে নেয়া হয় ঘরে। ২০০৬ সালে দ্বিতীয় দফা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে এক মাস থাকতে হয় তাকে। এ সময় তার মধ্যে সহসাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার প্রবনতা লক্ষ করা যায়। এ বছরেই পুনরায় তাকে মনমিতা মানসিক হাসপাতালে এক মাসের জন্যে রাখা হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর সুমনের শারীরিক অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হয়।
এ সময়ে তার ছবি আকার প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়। বেশ কয়েকটি স্কেচ খাতায় কলম পেন্সিল ও পেস্টালের বেশ কিছু ড্রইং ও স্কেচ করে সে। পাশাপাশি সেল ফোনে তার বন্ধু ও পরিচিত জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। বেশ কয়েকটি পত্রিকা অফিসে কাজের জন্যে নিজেই গিয়ে হাজির হয়। কাজের আশ্বাসও দেয়া হয় তাকে।
পরবর্তিতে যা আর বাস্তবে হয়ে ওঠে না। তার কবি বন্ধুদের সংস্পর্ষে আশার জন্য মাঝে মাঝে শাহবাগে দেখা যেত তাকে। আজিজ মার্কেট, চারুকলা, টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান প্রভৃতি স্থানে একসময়ে যার ছিল অবাধ বিচরণ শুধুমাত্র অনুপস্থিতির কারণেই তাকে ভুলেও গিয়েছিল পরিচিত জনেরা। অনেক আগ থেকেই সুমন প্রবাহন নির্বসিত হয়েছিল তার পরিচিত পরিমন্ডল দ্বারা। গত ১৯ এপ্রিল দুপুরে নিজ রুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে থেকে সেই কবি সুমন প্রবাহন প্রমাণ করলেন যে আদতে আমরা কেউ বেচে নেই।
জিন্দা লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
পুনঃর্বার মোঃ মশিউর রহমান সুমনের জীবন বৃত্তান্তের বিকল্প এ ধারা বিবরণী হয়তো কবি সুমন প্রবাহনের জীবন নির্দেশ করে না, প্রকৃত অর্থে এ লেখা ইহলৌকিকতার আলোকে আমার দেখা। সুমন প্রবাহনের অনুজ তসলিমের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে এই লেখাটি তৈরী করা হয়েছে। এতে কোন তথ্য বিভ্রাট থেকে থাকলে নিজ গুনে মার্জনা করবেন পাঠক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।