আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ শহরে শিউলী-ভোর যে কারনে ফিরে আসে

mostafizripon@gmail.com
এক এ শহরে অখন্ড আকাশ নেই। নীল লুঙ্গি, বার-হাত-বহরের টাঙ্গাইল শাড়ী আর লাজুক অন্তর্বাসের মতো এখানে সৌভাগ্যবানদের টুকরো আকাশ ঝুলে থাকে বারান্দার গ্রীলে- যেখানে পাখী ওড়ে, মেঘডাকে, ফুলের টবে দারুন গোলাপ কিংবা নয়নতারা আলো ছড়ায়। এ শহরে কিশোরীর আনুনাসিক কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ ভেসে বেড়ান প্রতিবেশীর মশলাদার তরকারীর সুবাসে একাকার হয়ে। এ বাড়ীর বিদ্যাময়ীর সশব্দ অধ্যয়নে ও বাড়ীর কাজের-মেয়ে বিদুষী হয়ে ওঠেন- এমনই গায়ে-পড়া পরশীপনা দালানগুলোর। রাস্তার মোড়ে, গাড়ী-বারান্দার মুখ ঘেঁষে, ফুটপাতে বাহারী বাজার বসে এখানে; প্রতিদিনই এদের হাট বার।

এখানে লাঙ্গল-চষা মাশকলাই খেতের মতো রাস্তায় শৌচাগারের কিংবা বৃষ্টির পানি জমে, তারপরও যাদুকরের মতো ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলগুলো পেরিয়ে এ শহরের মানুষগুলো ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় গন্তব্যে। এখানে জীবনের ইস্টিমার সিটি বাজায়, কৃষ্ণগহ্বরের মতো আরো মানুষকে শুষে আনে পাকস্থলিতে, বহরে গতরে বেড়ে চলে। বড় জীবন্ত এই শহর। তখন সূর্য ডুবে গেছে; রাস্তার যে বাতিগুলো এখনো খোয়া যায়নি সেগুলো গলির অন্ধকারকে আলো-আঁধারী করতে জ্বলে উঠেছে; বিল্ডিংগুলো সাদা আর হলদেটে আলোয় আসন্ন রজনীর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। রিক্সাভ্যানে চেপে হাকিম মুন্সীও ঘরে ফিরছেন, কোলে সন্তানের মৃতদেহ।

যে মানুষগুলো সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে, আর বা-হাতে পরনের প্যান্টটাকে ইঞ্চি দুয়েক উঁচুতে তুলে, কাঁদা-বাঁচিয়ে পথে শুটকো পটল-আদা-মরিচ কিংবা ভাগে আইড়মাছ কেনে, তারা দৃশ্যটি দেখে এক মূহুর্ত থেমে থাকে; কেউ কেউ জীভে চুকচুক শব্দ তুলে 'কি কইরা হইল'জাতীয় প্রশ্ন করে। মায়ে-খেদানো কয়েকটি শিশু ভ্যানের পেছনে ভীড় বাড়ায়, এ যাত্রায় ওদের কোন হুড়োহুড়ি নেই; শিশুরাও শবযাত্রার মানে বোঝে। হাকিম মুন্সী বাড়ী ফেরার আগেই এ গলির বারোমেসে থিকথিকে কাদাজমা পথে পড়শিরা ভীড় করে, মহিলারা মুখে শাড়ির আঁচল টেনে জীবনের নশ্বরতার বেদনা চোখে লেপ্টে রাখে, আর হাকিম মুন্সীর 'গাইয়া' বউটির 'পোলাপান' মানুষ করার অপারদর্শিতার বিষয়ে আলোচনা করে। ঘরের ভেতরে হাকিম মুন্সীর শিশু কন্যা আর তার গেঁয়ো বউটির বিলাপ শোনা যায়। শবযাত্রীরা গলির মুখে ঢুকতেই সমস্ত পাড়া যেন শোক প্রকাশের জন্য বিদ্যুতহীন হয়; ভ্যানচালক লোডশেডিংয়ের অপরাধে 'কারেন্টের' মায়ের নামে অশ্লীল খিস্তি করে।

যে মানুষগুলো চায়ের দোকানের আশেপাশে লুঙ্গি হাটুঅব্দি গুটিয়ে জগতের আগরুম-বাগরুম আলোচনায় ব্যস্ত থাকে, যারা লোড-শেডিংয়ের শুরুতে বিচিত্র এক শব্দ করে, আর বিদ্যুৎ ফিরে এলে খুশিতে আটখানা হয়ে হাততালি দেয়, তাদের একটি দলও হাকিম মুন্সীর বাড়ীতে আসে। ছেলের লাশ দেখে হাকিম মুন্সীর স্ত্রীর বিলাপ মাতমে রূপ নেয়, প্রতিবেশীদের কেউ একজন তাকে স্বান্ত্বনা দেন। 'মরা' বিষয়টি বুঝতে না-পারা মেয়েটি ভাইয়ের নিথর শরীরটার দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে। পাশের দালানে যারা থাকেন, যাদের শোক কিংবা উচ্ছ্বাস নানা কারনেই পরিমিত, তারা জানালার পর্দা সরিয়ে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করেন এবং বোঝেন যে, স্বামীর হাতে বেদম মা'র খাওয়া মেয়েছেলের কান্না নয় এটি। হাসি কিংবা কান্না দুই-ই এই গলিতে প্রকট।

হাকিম মুন্সী, যিনি গত দুইদিন ডায়রিয়ার রোগী নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতে করতে কান্নারও অবকাশ পাননি, এইবেলা তিনিও কেঁদে ওঠেন, নিষ্ঠুর সৃষ্টিকর্তার নামে অভিসম্পাত করেন। কেউ একজন দোকান থেকে দু'টো আগরবাতি এনে জ্বেলে দেয় হাকিম মুন্সীর ঘরে; পুরো গলিটাই কেমন এক অপার্থিব গন্ধে ডুব দেয়, লাশ হয়ে ঘরে ফেরা কিশোরটির খেলার সাথীরা মায়ের আঁচলের খুঁট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ভ্যান চালক ভাড়ার জন্য তাগাদা দিলে হাকিম মুন্সীর কান্না থামে; ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন তাকে লাশ দাফনের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুই যারা হাকিম মুন্সীর মৃত পুত্রের কবর খুড়তে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে জানাল, এই এলাকার 'মাইট্টা গোরস্থানে' নতুন কোন কবর দেয়া যাবেনা। প্রথমে কথাটা শুনে সবাই অবাক হলেও তা মৃদু আক্রোশে পরিনত হতে সময় নিল না।

আক্রোশটি গোরস্থান সংলগ্ন মসজিদের পেশ-ইমামের বিরুদ্ধে। অনেকে বলল, 'এইসব ফাইজলামি'। আবার কেউ কেউ নাফরমান ইমামের ওপর আল্লাহ কেন এখনো 'ঠাটা' ফেলছে না ভেবে অবাক হল। যারা হাকিম মুন্সীর মুদিদোকানে 'বাকি চাহিয়া' তাকে লজ্জা পেতেন, তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, এসব পাপের ফসল। অভাব অনটনের সাথে সাথে হাকিম মুন্সীর কিছু শ্ত্রুও তৈরী হয়েছিল।

হাকিম মুন্সী খিদে পেটের টক-ঢেকুর লুকিয়ে, দেয়ালে হেলান দিয়ে মৃত পুত্রের শেষ গোসলের আয়োজন দেখছিলেন, খবরটা শুনে তিনি সজোরে কেঁদে ঊঠলেন। যারা হাকিম মুন্সীর দাড়িওয়ালা রুক্ষ চেহারাটা নানা কারনেই অপছন্দ করে, আর যারা তার নিতান্তই কাছের মানুষ, তারা সবাই বয়স্ক লোকটার কান্নায় বিচলিত বোধ করে এবার এবং সীদ্ধান্ত নেয়, এসবের শেষ দেখে নেবে। অসহায়ত্ব কখনো কখনো মানুষকে সাহসী করে তুলে। তিন হাকিম মুন্সীকে নিয়ে এ পাড়ার মানুষেরা যখন মসজিদে আসল, তখন এশার নামাজ শেষ হয়েছে, ইমাম সাহেব কপালের কালসিটে-ইবাদত-চিহ্নে দিনের শেষ ফরজ-পূণ্য যোগ করেছেন। ইমাম সাহেব মসজিদের সিঁড়ির গোড়ায় ছোট জটলাটি দেখে এক মূহুর্ত ভাবেন, তারপর বিশুদ্ধ আরবী উচ্চারণে তাদের যে সালামটি দেন তা 'ওয়া রহমতুল্লাহ'য় এসে সমাপ্ত হয়।

এরপর তিনি দু’হাত বাড়িয়ে সবার সাথে হাত-মেলান এবং তাদের এশার নামাজ আদায় হয়েছে কিনা জানতে চান। মানুষগুলো, যারা একটু আগেও ইমাম সাহেবের শাপান্ত করছিল, তারা তার দীর্ঘ সালাম আর অশত্রুতাপনায় কিছুটা হতাশ হয়, ধরা-পড়া অপরাধীর মতো এর-ওর মুখের দিকে তাকায়, মাথা চুলকায়। ইমাম সাহেব এশার নামাজের ফজিলত বয়ান শেষ করে তাদের মসজিদের ভেতর আসতে বলেন। 'আমি একটু আসতেছি' বলে কয়েকজন কেটে পড়ে, বাকিরা ইমানদার মানুষটির সামনে রাজ্যের অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাকিম মুন্সী মরিয়া হয়ে ইমাম সাহেবকে বলেন, 'হুজুর আমার ছেলের দাফনের ব্যবস্থা করেন।

' নামাজ না পড়ার অপরাধে যারা এতক্ষন কাচুমাচু করছিল, হাকিম মুন্সীর কথায় তাদের প্রাণ ফিরে আসে, তারাও ইমাম সাহেবকে সাক্ষীমেনে হাকিম মুন্সীর নাবালক পুত্রের গোর আর বেহেস্ত কামনা করে। ইমাম সাহেব অনেক কথায় তাদের যা জানান, সেগুলোকে সংক্ষিপ্ত করলে বিষয়টা দাঁড়ায়- এটা পারিবারিক কবরস্থান। এ জমির মালিকেরা নিতান্ত ধর্মপরায়ন বলেই এতদিন এখানে মহল্লাবাসীদের লাশ সৎকারের অনুমতি দিয়েছে। মাস তিনেক হল এখানে নতুন লাশ দাফন বন্ধ আছে এবং আল্লাহর ঘরের সাথে কোন যোগাযোগ নেই বলেই মহল্লার কতিপয় পাপী-তাপী এই ক্ষুদ্র তথ্যটি অবগত নয়। ইমাম সাহেবের কথা শেষ হলে হাকিম মুন্সী কান্নাচাপা কন্ঠে একটি শব্দই ফোটাতে পারেন, 'ক্যান?' এবার ইমাম সাহেবের বিব্রত হওয়ার পালা।

কথাটা কিভাবে শুরু যায় ভাবতে ভাবতে ইমাম সাহেব মাথার টুপি খুলে তাতে ফু দিয়ে খসা-চুল আর খুশকি পরিস্কার করেন অথবা এই প্রক্রিয়ায় কোন পূণ্য আদায় করেন, আর কিছু শোনার আশায় মানুষগুলো হা-করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইমাম সাহেবের দৃষ্টি বয়স্ক মানুষগুলোর চোখের সমান্তরাল পথ ছেড়ে হাকিম মুন্সীর কোমর বরাবর এসে থামে, যেখানে একটি কন্যাশিশু বাবার শার্টের এক কোণা টেনে ধরে বিস্ফারিত চোখে বড় মানুষদের আলোচনা শুনছে। ইমাম সাহেব, যিনি এতক্ষন শব্দ হাতড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ করেই কথা আর গলার জোর ফিরে পান, বলেন, 'এইখানে মেয়েছেলে কি করে?' শিশুটির ওপর সকলের চোখ যায়, কেউ কেউ ইমাম সাহেবের ওপর বিরক্ত হন, কেউ কেউ হাকিম মুন্সীর ওপর। হাকিম মুন্সী মেয়ের মুখের দিকে তাকান, শিশুটিও বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে, শুকনো মুখে একটু হাসার চেষ্টা করে। ভাই মারা যাওয়ার বেদনা বোঝার বয়স না হলেও শিশুটি হয়ত বাবার কষ্ট বোঝে।

হাকিম মুন্সীর ইচ্ছে করে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন কাঁদেন। ইমাম সাহেব শরিয়ত মেনে চলার ফজিলত বর্ননা শুরু করলে- তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে রাস্তায় অপেক্ষা করতে বলেন। গোরস্থানের জমি, হোক না তা পারিবারিক, সেটি কি বিক্রি করে দেয়া যায় মানুষগুলোর মাথায় ঢোকেনা; তারা চোখে বিস্ময় মেখে ইমাম সাহেবের কায়দা করে ছাঁটা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যারা একদিন এ মহল্লায় জন্মে ছিল, তাদের সন্তানেরা- যাদের দু’ একজন এ মূহুর্তে 'মাইট্টা গোরস্থান' জামে মসজিদের বেতনভূক ইমামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যারা তাদের ঠিকানা বোঝাতে 'গোরস্থানের ডাইনের গলি' বা 'গোরস্থান পার হইয়া দুইটা বাড়ী সামনে গেলেই'-জাতীয় কথা বলে, তারা গোরস্থানের জমি বিক্রির সবিস্তার জানতে চায়। ইমাম সাহেব আবারো মাথার টুপি হাতে নিয়ে ফু দেন এবং তা থেকে খুশকি পরিস্কার অথবা পূণ্য আদায় করেন; মানুষগুলো অপেক্ষা করতে থাকে।

ইমাম সাহেব মিনমিনে কন্ঠে উত্তর দেন, 'আমি ঠিক জানিনা, তবে মনে হয় জমিটা বিক্রি করা হইছে। ' গ্রামের শেষ চিহ্ন ধরে রাখতে এ এলাকায় যেখানে ধানক্ষেত ছিল, যে ডোবায় একটু পানি জমলেই পাতলা পায়খানা আর সর্দি-ভোগা পাজি ছেলেমেয়েরা গোসলে নামতো- সেখানে উঁচু-উঁচু দালান উঠেছে, গলির মুখ থেকে অশ্রাব্য গালি শোনার আগ পর্যন্ত যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নর্দমার দুর্গন্ধ বাঁচিয়ে ভদ্র মেয়েছেলেরা বিকেলের হাওয়া খায়। বস্তির কোণ ঘেঁষে, গোরস্থানের মুখের ওপর, ড্রেনের ঠিক মাঝখানে হাউজিং-এর বাহারি বিজ্ঞাপন ঝুলে এখানে। নাবালক অজপাড়া থেকে উপশহরের সালকত্ব গ্রহন করে এ এলাকার মানরক্ষা এবং সুনাম বৃদ্ধি দুই-ই ঘটেছে। উপশহর থেকে শহরে নাম লেখানো কি প্রক্রিয়ায় ঘটে- তা না জানলেও এ এলাকার জমির মালিকেরা বুঝে গেছে, তারা আড়াই-তিন বা পাঁচ কাঠার সোনার টুকরোর ওপর শুয়ে আছে, প্রাতঃকৃত্য করছে।

তাদের বাপ-দাদারা আরেকটু জমি-জমা কেন করেনি- একথা ভেবে এ মানুষগুলো মাঝে-মাঝেই কষ্ট পায়, চা-বিস্কুট খেতে খেতে এসব দীর্ঘশ্বাসের গল্প ভাড়াটিয়া প্রতিবেশীর শ্বাসকষ্ট বাড়ায়। হাকিম মুন্সীর সঙ্গীরা, যারা জমির মালিকানা দূরে থাক- বউ-বাচ্চার মালিকানা নিয়ে প্রতিবেশীর অশ্লীল গালি শোনে, তাদের সমস্ত রাগ ইমাম সাহেবের নূরানী চেহারা ছেড়ে গোরস্তানের ঢোকার মুখে হাউজিং-এর বিজ্ঞাপনটির ওপর জমা হয়; তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন 'আস আমার সাথে' ঘোষনা দিয়ে গোরস্থানের দিকে পা বাড়ায়; ইমাম সাহেব 'কর কি, কর কি' বলে রাগী মানুষটাকে থামানোর চেষ্টা করেন। হাকিম মুন্সী 'হুজুর, আমার ছেলের একটা ব্যবস্থা করেন' বলতে বলতে ইমাম সাহেবের পেছনে ছোটেন। এ শহরে কোন কাজেই যেমন মানুষের অভাব হয়না। যিনি 'আস আমার সাথে' বলে রাগ-প্রশমনের নেতৃত্ব নিলেন, তার পেছনে নাকে সর্দিঝরা কিশোর থেকে সদ্য নামাজ শেষ করা মুসুল্লিসহ অনেকেই জুটে গেল।

রাগী মানুষের খ্যাপামী কে না পছন্দ করে? আর এসব বিনোদন একবারে শেষ হয় না; এর লেজ থাকে, মাথা থাকে, পঁচিশটা করে আঙ্গুল থাকে এবং এর যেকোন একটা টানলে আরেকটা আসে। যে উৎস থেকেই তৈরী হোক না কেন, এ শহরের মানুষ মজা চায়; নিখুঁত-নিরেট মজা। একটু পরে কিছু একটা ভেঙ্গে ফেলার শব্দ শোনা যায় গোরস্থানের সামনে। ভাংচুরের শব্দটাকে বিকট আর ভয়াবহ করতে আশেপাশের দোকানের ঝাঁপ সশব্দে বন্ধ হতে থাকে। ফর্সা হোন, চর্ম-যৌন-সেক্স, টিউটর দিচ্ছি’র বিজ্ঞাপনগুলোর পাশে 'ফ্লাট বিক্রয় চলিতেছে' লেখা বিশাল বিলবোর্ডটি দেখতে না-দেখতেই মাটিতে নামে আসে।

যারা জানেনা স্বাস্থ্যবান একটি শিশু আর তার বাবা-মায়ের শান্তির নীড়ের ছবিওয়ালা এই বিজ্ঞাপনে কয়েকজন মানুষের এত ক্ষোভ কেন এবং যাদের পায়া-ভাঙ্গা চেয়ারের জন্য কাঠ দরকার- তারাও যোগ দেয় আক্রশ-প্রশমন-যজ্ঞে। কয়েকজন মানুষ হাতের মুঠোয় জীবন আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়ে পালায় এদিক-ওদিক, যেমন তারা সবসময় পালিয়ে বাঁচে। সব সময় নিরাপদ দুরুত্বে থাকা কিছু মানুষ আর অষ্টপ্রহর বাজারে ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলো বড় রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে 'কি হচ্ছে' বোঝার চেষ্টা করে। কেউ একজন চিৎকার করে; কেউ একজন ঢিল ছোঁড়ে রাস্তার ওপর জ্যামে আটকে থাকে স্কুটারের গায়ে; রাগী রাগী মানুষগুলোর মাঝ থেকে কেউ একজন ত্বরিত অথচ নিপুন হাতে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়; দীর্ঘক্ষন রাস্তায় আটকে থাকা যানগুলো মূহুর্তে কোথাও লুকিয়ে পড়লে বা পালিয়ে গেলে এ শহরকে বড় বেমানান লাগে। সেই বেমানান সড়কে পা থেকে খসে যাওয়া কিছু স্যান্ডেল, ইটের টুকরো আর একটি শিশু নিঃশব্দে পড়ে থাকে।

শিশুটির পরনের ফ্রকটি খুব চেনাচেনা লাগে হাকিম মুন্সীর। হাকিম মুন্সীর তেষ্টা-পাওয়া বুকে হৃৎপিন্ডটি কয়েক মূহুর্ত থেমে থাকে, তারপর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সেটি যেন গলার কাছে উঠে এসে দ্রিমদ্রিম বাজতে শুরু করে; পৃথিবীটার সাথে সাথে তার গা কাঁপে, মাথা গুলিয়ে ওঠে, তিনি এলোমেলো পায়ে রাস্তায় পড়ে থাকা শিশুটির দিকে এগিয়ে যান, তাকে পরম যত্নে কোলে তুলে নেন এবং শিশুটির গায়ের গন্ধেই হোক, বা তার কোঁকরা-চুলের ছোট বেণীর জন্যই হোক- তিনি বুঝতে পারেন এ তার কন্যা নয়; তবু তার পৃথিবী দুলতেই থাকে। শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে তিনি 'শেফু, শেফু' বলে ডাকেন; হয়ত শেফু নামের শিশুটি সে ডাক শোনে অথবা শোনেনা; বেঁচে থাকার বিশাল অয়োজনের কাছে জীবনের সব ডাক সব সময় পৌঁছেনা। চার হাকিম মুন্সীর ছেলেটির কবর 'মাইট্টা' গোরস্থানেই হয়েছিল, কেউ বাধা দেয়নি। বে-শরিয়তি কর্ম আর কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কারা যেন এখানে হরতালও ডেকেছিল আধাবেলা।

মাঝে মাঝে পুলিশ আসে এ পাড়ায়, তারা মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বিনে-পয়সায় চা-সিগারেট খায়, এ এলাকার জোয়ান-ছেলেরা পুলিশ দেখলে ঝামেলা এড়াতে অন্যপাড়ায় চলে যায়। বারান্দার গ্রীলের শুকনো কাপড়ের ফাঁকে যারা আকাশ খোঁজেন এখানে, তারা বিষন্ন দুপুরে কিংবা মাঝরাতে ভুল উচ্চারণে শেফু নামের একটি মেয়ে হারানোর বিজ্ঞপ্তি শোনেন মাইকে এবং হয়ত শিউলী ফুলের সাথে মিল আছে বলেই তারা শেফু নামটি শুনলেই অতিক্রান্ত শৈশবের কথা ভাবেন, যেখানে শিশিরের ভারে জাফরানী-বোটার-সাদা ফুলগুলো ভোরবেলায় ঘাসের ওপর বিছিয়ে থাকত।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।