কৃষ্ণশুভ্রারা বেঁচে থাকুক দূরে সুদূর স্বপ্নসীমান্তে
লেখালেখি করিবার সাধ ছোটবেলা হইতে আমার ছিল এমন দাবি করাটা বোধ করি অযৌক্তিক। আমার লেখালেখি করিবার অনুপ্রেরণা বলিতে আমার এক ফুফা। তাহার কথা ভাবিলে অবশ্যি ভারী চশমা মোটা গোফের কোন গম্ভীর চেহারা কল্পনার নয়নে আসিয়া উপস্থিত হয় না। তিনি কোন বড় সাহিত্যিক কিনা বলিতে পারি না,তবে সাহিত্যে তার যে তেমন দখল নাই একথা নিশ্চিত করিয়াই বলা যায়। তাহার পরও তিনিই আমার প্রেরনা।
কেননা তিনি প্রথম আমাকে বলিয়াছিলেন ভালোমত দেখিলে যে কোন কিছুই করা যায়। বলিয়াই ক্ষান্ত হননি বরং ফুফুর ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সমুচিত জবাব দেবার প্রতিজ্ঞায় একদিন তিনি রাধিতে বসিয়া গেলেন। তাও যে সে রান্না নয়, ফুফু যাহা পারেন না এমন একটি আইটেম তিনি বাছিয়া লইলেন। তাহা হইল আড়াই প্যাচের জিলিপি। আমরা ছোটরা মহা ধুমধামের সহিত তাহার সাহায্যে লাগিয়া গেলাম।
সারা বিকাল খাটিয়া যাহা হইল তাহাকে জিলিপি না বলিয়া কটকটি বলাই বেশি যুক্তিসংগত বলিয়া বোধ হয়। ফুফা অবশ্য তেলের ভেজালের মর্ম বয়ান করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। আমার সেইদিকে তাকাইবার ফুরসত ছিল না। কটকটিরুপ জিলিপি গোগ্রাসে গিলিতে আমি ব্যস্ত। শত হইলেও নিজেদের গড়া।
সৃষ্টির অপার্থিব আনন্দ।
যাহা হউক,লেখলেখির কথায় ফিরিয়া আসি। বাচ্চাকাল হইতেই কবিতা অনেক পড়িতাম। দেখিয়া কাজ করিতে পারার ফুফার সেই প্রেরণাই হোক কিংবা স্কুলে বাংলায় ভালো নম্বর পাইতাম বলিয়াই হোক কিংবা আমার মাতা বাংলার শিক্ষিকা বলিয়াই হোক আমি অতি ছোট হইতেই কবিতা লিখিতে আরম্ভ করিলাম। উহা যে অতিশয় নিম্নমানের ছড়াও ভালোমত হইত না তাহা বোধ করি সবাই অনুমান করিতে পারিতেছেন।
আমার মাতাকে দেখাইতেই ,এসব রাখিয়া পড়ায় মনযোগ দাও বলে গর্জিয়া উঠিলেন। আমার কাব্য প্রতিভা দমাইয়া রাখিতে চান উনি। যাই হোক মাতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া তখনকার মত আমার কাব্য চর্চা থামিয়া গেল।
ক্যাডেট কলেজ নামক জায়গায় আসিয়া আমার সুপ্ত ইচ্ছা আবার জাগ্রত হইয়া উঠিল। এইতো সুযোগ আমার প্রতিভা সবাইকে দেখাইয়া দিবার।
দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতা সামনে। হঠাৎ করিয়া আমার মাথায় খেলিয়া গেল চার লাইন-
দুরন্ত দুর্বার যোদ্ধা মোরা
সময়ের সাহসী সৈনিক
সত্যের পথে হব না পিছপা
আসুক বিপদ দৈনিক।
আরে কী কবিতা। যাহা হউক আমি বসিয়া ২০ লাইনের অতি বিদ্রোহী কবিতা রচনা করিয়া ফেলিলাম। ইহা ভাবিয়াই আমার মনে কেমন এক বিদ্রোহ ভাব আসিয়া উপস্থিত হয়।
যথাসময়ে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হইলো। সম্পাদক যখন পত্রিকা পরিচিতিতে আমার দুরন্ত দুর্বার যোদ্ধা র নাম ঘোষনা করিল বিশ্বজয়ের ছাপ আমার চেহারায়। দেখুক আমার জননী। আমার ভিতরকার আগুনকে উপেক্ষা করিয়াছিলেন, তাই বলে তা চাপা থাকিবে না। কিন্তু আমার বিশ্বজয় থামিয়া গেল যখন কাছে গিয়া পত্রিকা পড়ার সুযোগ হইল।
হায় আমার কবিতা অথচ ঐ চার লাইন ছাড়া আর কিছুই তো আমার চেনা লাগিতেছে না। আসলে বিভিন্ন হাতে ঘুরিয়া বিভিন্ন জনের হাতের ছোয়ায় আসলে ওটা কবিতা হইয়াছে। আমার অবদান অতি সামান্য।
যাহাই হোক বাংলা গিয়া এবার ইংরেজি দেয়াল পত্রিকার পালা। আমি ততোদিনে আমার নিজের লেখালেখির স্বরূপ বুঝিয়া লেখালেখি থামাইয়া দিয়াছি।
আমার এক বন্ধুর লেখক হওয়ার খুব শখ। তো আগের পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হওয়ায় সে আমার নিকট আসিয়া তাহার জন্য যখন কিছু লিখিয়া দিতে বলিল আমি আতঙ্কিত হইলাম। অনুরোধের ঢেকি গিলিয়া লিখিলাম। এবার আর কবিতা লিখার দুঃসাহস করিলাম না। লিখিলাম গদ্য।
স্বাধীনতা দিবস নিয়া। বিষয় অতি চমৎকার। আমি আর আমার বন্ধু দুজনেই মুগ্ধ।
এবারও লেখা ছাপা হইল। কিন্তু আমার বন্ধু আমার উপর রাগিয়া গেল।
বানান ভুল আর গ্রামার মিসটেকের কারনে এডিটরের হাত হইতে তাহার যে উত্তম মধ্যম খাইতে হইয়াছে তাহা খাইলে বোধ করি আমার ও লেখালেখির সাধ চিরতরে শেষ হইয়া যাইত।
যাহা হউক আমি ভাবিলাম আর না। আমার এক করিতে গিয়া আরেক হইয়া যায়। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় ,শিব গড়িতে যাইয়া বাদর। তাহার পরও যখন আমরা ক্লাশ টুয়েলভে কো এডিটর হিসেবে আমার ডাক পড়িল আমি বসিয়া থাকিতে পারিলাম না।
আমি প্রুফ রিডিং করিতে গিয়া মাঝে নিজেও লেখায় হাত দেয়ার দুঃসাহস দেখাইয়া ফেলিলাম। ফল হইল লেখকের বক্তব্য অনেক জায়গায় পরিবর্তন হইয়া গেল। এতে একজন দেয়াল পত্রিকার কাজ খেমা দিল। উহহ কী ভয়ানক অনর্থ ঘটাইয়া ফেলিলাম। মিটমাট করিয়া সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ শেষ হইল।
আমরা ১ম হইলাম। কিন্তু একি সেরা লেখা কার হইল?যাহার নাম ঘোষনা হইল সে তো নিজে কিছুই জানে না। আসলে আমি ভুল করিয়া লেখায় লেখকের নাম গন্ডগোল করিয়া ফেলাতে এই বিপত্তি।
বুয়েটে ঢুকার পর আমি লেখিতে বসিলাম নতুন আগ্রহে। অতি দুঃখ কথা রচনা করিয়া এক বন্ধুকে দেখাইলাম ।
দেখি সে হাসিতেছে। এমন দুঃখের লেখায় কারো হাসি আসিতে পারে আমার জানা ছিল না। তাকে বলিতে সে বলিল। কাহিনীটা বাংলা সিনেমার মত লাগছে। তুই বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে যা ভালো করবি।
যাহা হউক তবু আমি লিখিয়া যাই । হোক না সেটা শিব গড়িতে গিয়া বাদর তবুও তো সৃষ্টির আনন্দ। আমি অবশ্য এই লেখাতে আসিয়া সফল হয়েছি বলিয়াই বোধ হইতেছে। কারণ ইহাকে আমি কিছুই করতে চাইনি এবং ইহা "কিছুই না" ই হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।