ইন্টারমিডিয়েটের পর অনার্সে ভর্তি হIয়ার আগ মুহূর্তের এই মধ্যবর্তী সময়টাতে হ্রদয়ঘটিত কারণে অসামাজিক জীবন যাপন করছিলাম। কারো সাথে যোগাযোগ নেই, কথা নেই। একা একা সময় কাটাই, ঘোরাঘুরি করি। বাসায় থাকলে বই পড়ি। এই সময় কী করা উচিত এমন ভাবনা থেকেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে আমাকে লেখক হতে হবে এবং প্রফেশন্যালি লিখতে হবে।
পুনরোদ্যমে লেখালেখি শুরু হল। হ্রদয়ের ব্যথা ভুলে যাIয়ার জন্যেই তখন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হIয়া প্রয়োজন ছিল। আমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অথৈ জলে পড়ে গেলে বাঁচার একমাত্র উপায় যেমন সাঁতার কাটা আমার তেমনি লেখালেখি।
কিভাবে একজন ভাল লেখক হIয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় বিরাট কনফিউশানে ফেলে দিয়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ।
তিনি এক জায়গায় লিখেছিলেন যে লেখালেখি করার জন্য তিনি আগে থেকে কোন পরিকল্পনা কিংবা ছক আঁকেন না। কলম নিয়ে প্রথমে একটা লাইন লিখেন, তারপর অটোম্যাটিকলি লেখা চলতে থাকে। লিখতে লিখতেই ইন্সট্যান্ট গল্প তৈরী হয়ে যায়। তার মত অটোম্যাটিক পদ্ধতিতে চেষ্টা করে দীর্ঘদিন ব্যর্থতায় ভুগেছি । সে সময় সমাধান মিলল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
তিনি এক জায়গায় লিখেছেন যে লেখালেখির শুরুতে তিনি অনেক পরি্শ্রম করেছেন। রীতিমত মজুরদের মত খেটেছেন। ছক তৈরী করেছেন, গল্পের প্লট তৈরী করেছেন। একটা লাইন বারবার কেটে তারপর সাজিয়েছেন। পরিশ্রম ছাড়া ভাল লেখা সম্ভব নয়।
অসাধারণ সমাধান সাধারণ ভাবে পেয়েছি বলেই শীর্ষেন্দু আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক।
একজন লেখকের যে কোন সময় যে কোন বিষয়ে লেখার ক্ষমতা থাকতে হয়। এই চিন্তা থেকে আমার চারপাশের সবকিছু নিয়ে আকষ্মিক একটা বর্ণনা তৈরি করে করার চেষ্ট শুরু করলাম। আমাদের বাড়ির যে চিলেকোঠায় থাকি সেটা নিয়ে, বাড়ির সামনের মেইন রোড দিয়ে করতোয়া বাস চলাচল করে সেটা নিয়ে। চোখের সামনে যা পড়ে তা নিয়েই ভিতরে ভিতরে কোন বর্ণনা সাজাতে থাকি।
সে সময় রাস্তায় হাটাহাটি করার সময়I এই কাজ করতাম বলে প্রায়ই অন্যমনষ্ক হয়ে যেতাম। এখন বুঝি যে ব্যপারটা কত রিস্কি ছিল। যে কোন সময় গাড়ির চাকার তলায় পড়ে Iস্তাদি বের হয়ে যেত।
একদিন একাউন্টিং কোচিং শেষে বাসায় ফেরার পথে পলি ক্লিনিকের সামনে আসতেই বৃষ্টি শুরু হল। পলি ক্লিনিকের আন্ডারগ্রাউন্ডে তখন বসার সুন্দর ব্যবস্থা ছিল।
আমি সেখানে পায়ের উপর পা তুলে ভাব নিয়ে চেয়ারে বসলাম। বাইরে মুক্তার মত বৃষ্টি ঝরছে। ব্যাগ থেকে খাতা বের করে লেখা শুরু করলাম। আশে পাশে মানুষজন কথা বলছে, হাটাহাটি করছে। ব্যস্ত পরিবেশ।
কোলাহলে আমার কনসেনট্রেইট করতে সমস্যা হত। কিন্তু তখন খসখস করে লিখেই চলছি। কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারছে না। বৃষ্টি শেষ হতে হতে আমার একটা লেখা কমপ্লিট হয়ে গেল। এখন যতটুকুই লিখতে পারছি তার বেইজটা তৈরি হয়েছে সেই সময়েই।
আমার লেখা গল্প সাপ্তাহিক২০০০ ম্যাগাজিনে পাঠালাম। পর পর দুই বছর দুটি গল্প বেস্ট সিলেকশানে সেকেন্ড এবং থার্ড প্লেসে প্রকাশিত হল। একজন নতুন লেখকের কাছে এটি বিরাট ঘটনা। আমি স্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম।
সে সময় একদিন সুধীজন পাঠাগারে বসে ছিলাম।
আমার পাশেই দুইজন লোক সাপ্তাহিক২০০০ এর ভালবাসা সংখ্যাটি পড়ছিল। সেই সংখ্যায় আমার ‘মেঘে মেঘান্তরে‘ গল্পটি ছিল। আমি শুনি দুইজন লোকের একজন আরেকজনকে বলছে - ‘দেখছ, এই লেখাটা নারায়ণগঞ্জের একজন লিখছে। ভাল লিখছে। ‘ আমার মনে হল এমন চমৎকর কথা আমি আগে কখনো আর শুনিনি।
পাঠাগার থেকে বের হলাম। সেই আগের চাষাড়া অথচ কত সুন্দর লাগছে তখন। যেন অন্য রকম আলো, অন্য রকম বাতাস। রিক্সাIয়ালা পাঁচ টাকার ভাড়া চাইল সাত টাকা। দিয়ে দিলাম।
মনে হল, আহারে! দুইটা টাকাই তো বেশি চেয়েছে। কী আর এমন। মনটা ভাল হয়ে গেল।
লেখালেখির আনন্দটাই বুঝি এমন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।