জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের ক্ষমতা-অক্ষমতা
ফকির ইলিয়াস
====================================
একটি রাষ্ট্রে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলে আমরা দুটি বিষয় খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করি। প্রথমটি হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশা। জনগণ মনে করেন তাদের ভোট প্রয়োগের মধ্যদিয়ে আরেকটি পরিবর্তন সাধিত হবে। তারা শান্তির কািক্ষত আশ্রয় খুঁজে পাবেন। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাবার উচ্চাকাক্ষা।
তারা অপেক্ষায় থাকেন, ক্ষমতা তাদের দখলে আসবে। এতদিনের রাজনীতি করার ফসলটি ঘরে উঠবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, জনগণের প্রত্যাশা এবং রাজনীতিকদের ক্ষমতায় যাওয়া এই দুটি স্বপ্নের সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়। ধরা যাক, ২০০৮ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা। বুশ তার দুই মেয়াদ শেষ করছেন।
এবার তাকে যেতেই হবে। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানরা এখন তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ করছেন ক্ষমতার জন্য। অনুধাবন করতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের সিংহভাগ মানুষই চাইছেন এবার ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু এর প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী নির্বাচন। প্রাজ্ঞ ডেমোক্রেটদের মতে, হিলারি ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা এই দুইজনই যদি রেস থেকে দূরে থাকবেন তবেই ভাল করতেন।
তখন অন্য কোন প্রার্থী এগিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টিকে। বারাক ওবামা কৃষ্ণাঙ্গ আর হিলারি ক্লিলটন মহিলা। যুক্তরাষ্ট্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা মহিলা প্রেসিডিন্ট দেখতে প্রস্তুত কি না সে প্রশ্ন উঠছে গেল বিশ বছর থেকেই। ২০০৮ এর প্রাথমিক রেসে এই দুজনই দৌড়াচ্ছেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে।
শেষমেষ বারাক ওবামাই ডেমোক্রেটদের নমিনেশন পাবেন আপাতত তাই মনে হচ্ছে। মূল নির্বাচনে মুখোমুখি হবেন জন ম্যাককেইন এবং বারাক ওবামা। তারপর ফলাফল কি হবে? জনগণের পরিবর্তনের প্রত্যাশা পর্ণ হবে কি? নাকি আবারও রিপাবলিকান বুশের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে ম্যাককেইনই এগিয়ে যাবেন? এসব প্রশ্ন নিয়েই কাল যাপন করছে যুক্তরাষ্ট্র। জনগণের শেষ ভরসা হচ্ছে এই ক্ষমতায় যে পার্টিই আসুক না কেন, চরম অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে কাজ করে যাবেন শক্ত হাতে।
দুই.
নির্বাচনী হাওয়া ক্রমশ সরগরম করে তুলছে বাংলাদেশের মাটিও।
তবে পার্থক্য হচ্ছে, রাজনীতিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। জনগণ পরিবর্তনের কোন বিশ্বাস স্খাপন করতে পারছেন না। এর প্রধান যে কারণটি গোটা জাতিকে সংশয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তা হচ্ছে ডিসেম্বরে নির্বাচন আদৌ হবে কি না। হলে তা সুষ্ঠু হবে কি না। বড় বড় দলগুলো তাতে অংশ নেবে কি না।
একটি ছবি আবারও দেখেছেন দেশবাসী। বিএনপির খালেদা জিয়া মনোনীত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। তার পাশে বসে আছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারের আল বদর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। বলা হয়েছে, চারদলীয় জোটের পুনরুজ্জীবন ঘটতে যাচ্ছে। যে জামায়াত এতদিন প্রায় নীরবই ছিল তারা নিজামী কারাগারে যাওয়ার পর পরই সরব হয়ে উঠেছে।
আন্দোলনের হুমকি, ধমকিও দিতে শুরু করেছে। পুরনো মিত্রও খুঁজছে।
নিজামীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে জামায়াত আরেক দফা পিছিয়েছে বলা যায়। কারণ তারা ‘মজলিশে শরার’ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একেএম ইউসুফকে ভারপ্রাপ্ত আমির বানিয়েছে। যে ব্যক্তির সাজা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, দালাল আইনে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, জামায়াত বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা তারা একাত্তরে তাদের ভূমিকার জন্য নিজেরা ‘গর্বিত’ই বোধ করছে। না হলে চরম বিতর্কিত একেএম ইউসুফকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ না করে অন্য কাউকে করতে পারত। একাত্তরের মতোই তারা যে তাদের সিদ্ধান্তে অটল, সে প্রমাণই দেখেছে মৌলবাদী দল জামায়াত।
যদি সংলাপ ব্যর্থ হয়, যদি প্রধান দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তা হলে অবস্খা কি দাঁড়াবে? এখানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট তা হচ্ছে বড় দলগুলো দুটি দাবি ক্রমশ জোরালো করছে। এক হচ্ছে, তাদের শীর্ষ নেতানেত্রীদের মুক্তি।
আর দুই হচ্ছে, নির্বাচনে জিতে ক্ষতায় গিয়ে নেতানেত্রীদের কারগার থেকে বের করে আনা। কিন্তু পরিস্খিতির বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে এই সত্য স্পষ্ট হচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এই দুই দাবি কিংবা পরিকল্পনার কোনটাই বাস্তবায়িত হতে দেবে না। যারা রাজনীতি থেকে মাইনাস হবেন তারা যেমন রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবেন না তেমনি তাদের দল (আসলে কোন দলই) একক কর্তৃত্ব পাবে না আগামী সংসদ নির্বাচনে।
আবার কারও কারও মতে সংলাপ ব্যর্থ হলে গণভোটের মধ্য দিয়ে তাদের স্খায়ীত্ব খুঁজবে বর্তমান সরকার।
তারপর তারা যদি সংসদ নির্বাচন করেও তবে তা হবে তাদের সার্বিক অনুকূলে।
গ্যাটকো, নাইকো, বড় পুকুরিয়া মামলায় হাসিনা-খালেদাকে জড়িয়ে চার্জশিট তৈরির ব্যবস্খা সম্পন্নের পর বিএনপি-আওয়ামী লীগ আন্দোলনের কথাই ভাবছে। যা ক্রমশ জটিল হয়ে রাজনীতির বাতাসকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। এই বৈরী পরিবেশকে মোকাবেলার জন্য কি শক্তি কিংবা কৌশল বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কাছে রয়েছে তা এখনও বুঝা যাচ্ছে না।
তিন.
জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের ক্ষমতাই সকল উৎস এই তত্ত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বুলি আওড়ালেও তারা তার চর্চা থেকে বিরত থেকেছেন বার বার।
বরং তারা জনগণের ক্ষমতাকে নিûিক্রয় করার চেষ্টা করেছেন বিভিন্নভাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে ‘প্রাথমিক পর্যায়ে প্রার্থী নির্বাচন’ পদ্ধতি না থাকায় দলই প্রার্থী চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর। মন্ত্রী, শীর্ষ নেতানেত্রীদের প্রিয়ভাজন যারা হতে পেরেছে তারাই নমিনেশন পেয়েছে। একটি দেশের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বন্দি করে রেখে দেয়া হয়েছে শীর্ষদের হাতের মুঠোয়। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মূল্যায়নই করা হয়নি অধিক ক্ষেত্রে।
বিশেষ করে যেসব দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি জাতিকে দুর্বিষহ পরিস্খিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল তার সিংহভাগই ঘটেছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। একটি খুন চেপে দেবার জন্য যে দেশের স্বয়ং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কোটি কোটি টাকা উৎকোচ লেনদেন করতে পারেন সে দেশের ভবিষ্যৎ বলতে আর কি থাকতে পারে?
বড়পুকুরিয়া মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিনিধি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন বিষয়ে জেরা করেছেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি কোন দুর্নীতি করেননি যা করেছেন তা রুটিন ওয়ার্ক মাত্র। খালেদা জিয়া আরও বলেছেন, এ রকম চলতে থাকলে কোন সরকার প্রধানই রাষ্ট্রের কাজকর্ম করতে পারবেন না। ভবিষ্যতেও এ রকম মামলা চলতেই থাকবে।
বাংলাদেশের মানুষ দেখেছেন, চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ‘হাওয়া ভবন’ নামক একটি ভবনের শক্তি এবং নেপথ্য শক্তিরা দেশে একটি প্যারালাল সরকার গড়ে তুলেছিল। সবকিছু তাদের অঙ্গুলি নির্দেশেই পরিচালিত হতো। এমনকি শীর্ষ মন্ত্রীরা পর্যন্ত ভয়ে তটস্খ থাকতেন ওই ভবনের কর্মকর্তাদের। এসব বিষয়গুলো কি বেগম জিয়ার অজানা ছিল? না অজানা ছিল না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী চাইলে রাষ্ট্রকে এই রাহুর কবল থেকে মুক্ত রাখতে পারতেন।
ওয়ান ইলেভেনের যাঁতাকলের শিকার অনেক রাজনীতিবিদদের মুখে একটি কথা শোনা যাচ্ছে আর তা হলো তারা দেশের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। আমি বলি, তারা যা করেছেন তা হয়েছে রাষ্ট্রের জনগণের কর্মযজ্ঞ এবং চাপের সুখে। ষোলআনা কাজের ছয়আনা সম্পূর্ণ করে বাকি দশআনা হজম করে নিয়েছেন ক্ষমতা লোভী রাজনীতি-বেনিয়ারা। আর সেই জঞ্জালই আজ দেশকে ঠেলে দিয়েছে আরেকটি অনিশ্চিত যাত্রার দিকে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভোটের কোন বিকল্প নেই।
একটি বৈধ সংসদই দিতে পারে রাষ্ট্রকে চলার পথদিশা। কিন্তু যোগ্য লোককে নির্বাচিত করার নামে সংসদ যদি রাবার স্ট্রাম্পে পরিণত হয় তবে সব আশা আকাক্ষাই বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
কোন দেশে লোভী বুর্জোয়া শ্রেণী যখন তীব্র ভোগবাদী হয়ে সব কিছু গ্রাস করতে তৎপর হয় তখন কাউকে না কাউকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। ওয়ান ইলেভেন তেমনি একটি পরিস্খিতিতেই সৃষ্টি হতে বাধ্য করা হয়েছে বাংলাদেশে। যে পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা যদি পর্ণাঙ্গ রূপ ভাল করতে না পারে তবে জাতির দুর্ভোগ কখনই শেষ হবে না।
নিউইয়র্ক, ২৭ মে ০৮
-------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ৩০ মে ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।