আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহামান্য শিক্ষক!!!

আমি এমন কেউ না। খুব সাধারণ মানুষ। তোমার মত, তোমাদের মত। হাসি খুশি থাকি, আনন্দে থাকার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে হতাশ হয়, অভিমান করি।

ভাবি বেঁচে থেকে কি হবে। একসময় নিজের ভুল বুঝতে পারি। নিজের মাথার পিছনে আনমনে হাত রাখি। মুচকি হেসে ভাবি, এত ভালবাসা আমি কোথায় প্রিয় শিক্ষক, আমার সালাম ও কদমবুচি গ্রহণ করবেন। কেমন আছেন আপনি? না! না! সৌজন্যতার খাতিরে না! মন থেকে জিজ্ঞেস করেছি।

আপনি কেমন আছেন জানতে খুব ইচ্ছে করছে। আপনি নিশ্চয় পড়ছেন আর ভুরু কোঁচকাচ্ছেন। “মাননীয়” না লিখে “প্রিয়” লিখেছি। আপনি কেমন আছেন তা আবার খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছি। কেন? বলছি! আমাকে স্যার আলাদা করে চিনতে পারবেননা।

আমি আপনার অনেকগুলো ছাত্রের একজন। আপনার সামনে আসতে আগে অনেক ভয় হত। বিশ্বাস করেন স্যার! একদিন আপনি প্যারাগ্রাফ পড়া ধরছিলেন। “ a rainy day” আমি শিখি নাই বলে ভয়ে হাত পা কাঁপছিল। আমার আগের জনও মার খেল প্রচণ্ড।

ঠিক আমার কাছে আসতেই ঘণ্টা পড়ে গেল। কি সৌভাগ্য আমার! বেঁচে গিয়েছিলাম। আপনার সমাজ ক্লাসটা না করে পালিয়ে ফুটবল খেললাম। তারপরের দিন এসেম্বলির পর কি মারটাই না মারলেন। সাদিক তো আপনাকে খুনই করে ফেলতে চেয়েছিল।

আরে স্যার! ও কিছু না! ওতো এখন অনেক বড় ডাক্তার! গরিবদেরকে একদিন ফ্রিতে দেখে দেয়। মাঝে মাঝে হাসি এসব দিনের কথা মনে করে। স্যার! আপনার কি মনে আছে পিকনিকে আমরা বাসে কি মজা করেই না গান গেয়েছিলাম। আপনার কঠোর দৃষ্টিটা নমনিয় করে বললেন, যাহ! কালকে তোদের ছুটি! পরশুদিন কিন্তু মহাকর্ষের উদাহরণগুলা করে নিয়ে আসবি! রসায়ন কোচিংটার টাকা মেরে দিয়েছিলাম দুই মাসের! সেই টাকা নিয়ে আমি আর রাকিব পালালাম। কক্সেসবাজার গিয়েছিলাম।

কি মজা! শুধু এডভেঞ্চার। তখন খারাপ লাগেনি। এখন লাগে স্যার। অপরাধবোধ থেকে ভাবি সামান্য কয়েকটা টাকাই তো। কিন্তু কিভাবে দেই।

আমি জানি আপনি আপনার সব ছাত্র ছাত্রীকে নিজের সন্তানের মত দেখেন। আমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। হয়ত আপনার মনেই নেই। তারপরও। স্যার আপনার উপর একটা কারণে অনেক রাগ ছিল।

আপনি তো বললেই পারতেন পিথাগোরাসের উপপাদ্যটা আসবেনা। আমরা রাত জেগে মুখস্ত করলাম। আসলোনা। মাথামোটা মামুনটা ঠিকই হাসতে হাসতে বের হল। আমরা মাত্র ৪ জন পাশ করলাম।

তার মধ্যে সে পেল ৯২! আপনি তাকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন বলে দিয়েছিলেন। ঐ শালা (মুখ খারাপ করলাম স্যার! মাফ করবেন) এখন সরকারি চাকরি করে। ঘুষ খায়। মাসের পর মাস ফাইল আটকে রাখে। অনেক ঘৃণা করতাম স্যার! সামান্য কয়টা টাকার জন্য আপনি! নিজেকে বিক্রি করে দিলেন? কলেজের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।

মানবদেহ পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় ফোন আসলো আপনার ছোট মেয়েটা এক্সিডেন্ট করেছে। রক্ত লাগবে। সেই দুর্লভ ও নেগেটিভ আমার ছিল। আপনার দিশেহারা চেহারাটা দেখে ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল যদি শরীরের সব রক্ত দিতে হয় দিব।

দেশের জন্য না পারি এই পিচ্চি মেয়েটার জন্য আমি আমার সব রক্ত দিতে পারব। ভোরে মেয়েটার জ্ঞান ফিরে। আপনি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। “দোয়া করি তুই মানুষের মত মানুষ হবি”। একটা ছোট কথা না বলে পারছিনা স্কুলের চারুকলা ম্যাডামকে না আমার খুব ভাল লাগতো।

তখন ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে তাঁকে বিয়ে করবো। কি সুন্দর একটা নীল পাড়ের শাড়ি পড়তেন। হেঁটে হেঁটে পড়াতেন। আমি উনার গালের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। সেদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম।

গালের চোয়াল ভেঙে গেছে। শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছেন। হার্টের অপারেশনের জন্য বেশ কিছু টাকা লাগবে। তার পরিবারের কাছে নেই। আমরা কয়েকজন চেষ্টা করে বেশ কিছু টাকা তুলে দিলাম।

এয়ারপোর্টে দেখতে গিয়েছিলাম। হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম আমার ম্যাডামের হাসিটা ঠিক আগের মতই সুন্দর আছে। আজকে স্যার অনেক লজ্জা নিয়ে লিখতে বসেছি।

শুনলাম আপনি নাকি গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বেতন বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। আপনার ঘর্মাক্ত মুখে নাকি ওরা মরিচের গুড়া স্প্রে করেছিল। আমি আপনার কথা সজলের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করেছি। সজল! আপনার ছেলে! ছেলেটা এত আবেগি! ঝরঝর করে কেঁদে দিল। বলল, “মায়ের কাশিটা বাড়ছে।

একটা ভাল ডাক্তার দেখাতে পারিনা। এ মাসে তেলের দাম আরও ৮ টাকা বাড়ল। বোনটা আগে রিকশা করে যেত। সেদিন দেখলাম। বাবার সাথে আসছে।

পড়ে শুনলাম সে হেঁটে আসছিল। বাবা তাকে রাস্তায় পেয়েছে। পড়ে বাবার সাথে রিক্সায় আসলো। তেমন কিছু না! একটা কাপড় তার খুব ভাল লেগেছে। চুড়িদার না কি যেন! তার বান্ধবীরা সবাই কিনেছে।

টাকা বাঁচিয়ে ওটা কিনার খুব শখ। ” আমি আর কি বলবো! শুধু এতোটুকু বলেছিলাম। তোর বাবাকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। এমনকি আমার বিশ্বাস মরিচের গুড়াও স্যারের চোখে এতোটুকু পানি আনতে পারবেনা। যে মানুষ এত কঠিন! পুরো জাতি তৈরি করেছেন শক্ত হাতে।

তার ছেলে হয়ে ভেঙে পড়লে হবে! স্যার কেন লিখেছি জিজ্ঞেস করবেননা। আমি নিজেই জানিনা কেন লিখেছি, অনেকদিন পর আপনার কথা মনে পড়ল। তাই লিখতে বসলাম। স্যার! আপনি কেমন আছেন? (পুনশ্চ ১- স্যার! লাল কালির কলমটা নামিয়ে রাখেন। বাংলায় আমি বরাবরি কম নাম্বার পেতাম।

পুনশ্চ ২- আমার ঐ হাসি খুশি ম্যাডামটা আর দেশে ফিরেননি। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর হাসিটা খুঁজি। পুনশ্চ ৩- আমি কিছু হতে পারিনি। এখনও বেকার! কোথাও চাকরি পাইনি। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করি মাঝে মাঝে।

ওদের উপরে ওঠা দেখি। শীতের সময় রাতের ট্রেনটা ধরে রংপুরে চলে যায়। কিছু গরম কাপড় বিলিয়ে আসি। পত্রিকার স্টলটার পাশে দাড়িয়ে পত্রিকা পড়ি। মানুষজন দেখি।

চা খাবার সময় আধ খাওয়া রুটিটা কোন এক প্যান্টঢোলা ছেলেকে দিয়ে দেই। এক হাতে প্যান্ট ধরে সে খায়। দেখতে ভালই লাগে। মনে হয় স্যার মানুষ হতে পেরেছি! সবাই যা করে আমি সব হয়ত করতে পারিনা। কিন্তু কোনটা খারাপ কোনটা ভাল! ঠিকই বুঝতে পারি।

পুনশ্চ ৪- মনের অজান্তেই শিক্ষক সমাজটাকে ভালবেসে ফেলেছি) আপনার স্নেহের ছাত্র, বাংলাদেশ (উৎসর্গঃ সেই সব শিক্ষকদের জন্য যারা শিক্ষকতাকে পেশা নয়, সেবা ভাবেন। আজ অভাব তাদের নীতিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.