সাদাসিধে কথা
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
রাহেলার কথা মনে আছে?
======================
যাঁরা এই লেখাটা পড়তে চাইছেন, তাঁদের আগে থেকে একটু সতর্ক করে দিই−হয়তো এটা না পড়াই ভালো। আমি যেহেতু লিখেছি, আমি জানি−একজন পাঠকের এ রকম একটা লেখা পড়তে ভালো লাগবে না। আমি এ রকম কিছু লিখতে চাই না, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা−আমাকে যেন এ রকম লেখা খুব বেশি লিখতে না হয়।
২.
সময়টা ২০০৪ সালের আগস্ট মাস, মেয়েটার নাম রাহেলা। রাহেলার বয়স ১৯ বছর, সে গার্মেন্টসে কাজ করে।
একদিন বেতনের টাকা পেয়ে মিনি চিড়িয়াখানা থেকে সে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ভেতর দিয়ে বাসায় ফিরছে। পথে তার এককালীন সহকর্মী লিটনের সঙ্গে দেখা হলো। লিটন তাকে বলল দেলোয়ারের সঙ্গে দেখা করে যেতে। দেলোয়ারও তার সহকর্মী। সরল বিশ্বাসে রাহেলা একটু অগ্রসর হয়েছে, তখন হঠাৎ করে তারা রাহেলার মুখ চেপে ধরে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে গেল জাহাঙ্গীরনগর ইউনির্ভাসিটির মোশাররফ হোসেন হলের পেছনে জঙ্গলে।
সেখানে আকাশ, কবীর−এ রকম নামের আরও কয়েকজন ছিল। সবাই মিলে তাঁরা তখন রাহেলাকে সেখানে গণধর্ষণ করল (আহারে! কী ভয়ঙ্কর একটা শব্দ−আমি কী অবলীলায় লিখে ফেললাম)! মেয়েটির ব্যাগে থাকা দুই হাজার ৪০০ টাকা তারা কেড়ে নিল। দরিদ্র গার্মেন্টস কর্মীর শরীরে দু-চারটি শখের গয়না থাকে, সেগুলোও ছিনিয়ে নিল। রাহেলা নামের মেয়েটি মানুষগুলোকে চিনে ফেলেছে, তাই তাকে তো আর এমনি-এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় না, মানুষগুলোর তো এখন তাকে মেরে ফেলতেই হবে।
আমি চাই না তার পরও কীভাবে কীভাবে জানি চোখের সামনে দৃশ্যটি ভেসে ওঠে।
১৯ বছরের একটা মেয়ে প্রাণভিক্ষা চেয়ে কত কাকুতি-মিনতি করেছে; কিন্তু সেই মানুষগুলোর বুকের ভেতর এতটুকু করুণা হলো না। তারা রাহেলাকে মাটিতে শুইয়ে মানুষ যেভাবে গরু-ছাগল জবাই করে, সেভাবে জবাই করে ফেলল (কী অবলীলায় আবার কী একটা ভয়ঙ্কর কথা আমি লিখে ফেললাম)! রাহেলাকে জবাই করেই মানুষগুলো থেমে গেল না, তার মৃত্যুটাকে নিশ্চিত করার জন্য তারা তার চুল ধরে ঘাড়টাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করল। কতটুকু নিষ্ঠুর হলে একজন মানুষ এ রকম কিছু একটা করতে পারে?
মেয়েটি মরে গেছে নিশ্চিত হওয়ার পর মানুষগুলো তার দেহটাকে সেই জঙ্গলের ভেতর ফেলে চলে গেল, কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো যে রাহেলা মরে গেল না। একসময় তার জ্ঞান ফিরে এল, গলা কেটে ফেলেছে, ছিন্নভিন্ন কশেরুকা, তার নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। দুর্বল-ক্ষীণ কাতরকন্ঠে সে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করল।
কেউ তার গলার স্বর শুনতে পেল না, সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল না।
দিন কেটে রাত হলো, রাত কেটে আবার দিন হলো কেউ রাহেলার কাছে এল না। তার দগদগে কাটা ঘায়ে রাজ্যের পোকা-মাকড় কিলবিল করছে, সেগুলো তার শরীরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। চলৎশক্তিহীন রাহেলা নামের ১৯ বছরের মেয়েটি সেভাবে জঙ্গলে পড়ে রইল।
দুর্বল মৃতপ্রায় রাহেলা যখন জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছে, তখন দুই দিন পর হঠাৎ সে মানুষের কন্ঠস্বর শুনতে পায়।
অনেক আশা নিয়ে সে যখন মানুষগুলোর দিকে তাকাল, তখন তার হূৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল−লিটন, দেলোয়ার, আকাশ আর কবীরের দল এসেছে রাহেলার মৃতদেহটি দেখতে−রাহেলা তখনো বেঁচে আছে দেখে তাদের বিস্নয়ের সীমা নেই। রাহেলা কাতরগলায় অনুনয় করে একটু পানি খেতে চাইল, মানুষগুলো তার মুখে এক ফোঁটা পানিও দিল না। তার বদলে যেটা করল পৃথিবীর সভ্য মানুষ সেটি বিশ্বাস করবে না। মানুষগুলো এসিড নিয়ে এসে তার ওপর ঢেলে দিল। প্রথমবার তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করে তারা চলে গিয়েছিল, রাহেলা তবুও মরে যায়নি।
দ্বিতীয়বার আবার তারা তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করে তারপর ফিরে গেল।
রাহেলা তবু মরে গেল না। দাঁতে দাঁত চেপে সে বেঁচে রইল। দিন কেটে রাত আসে, রাত কেটে দিন যায়, সে সেই জঙ্গলে পড়েই রইল। এসিডে পোড়া শরীরে পচন ধরেছে, গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে, পোকা-মাকড় কিলবিল করে খাচ্ছে।
তার মাঝে সে বেঁচে রইল, কাতরগলায় ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘আমি মরি নাই। আমি মরি নাই। আমি মরি নাই। ’
জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির একজন মালি হঠাৎ করে একদিন তাকে খুঁজে পেল; ফিসফিস করে কেউ একজন কিছু বলছে শুনতে পেয়ে কাছে গিয়ে দেখে ১৯ বছরের একটি মেয়ের গলে যাওয়া, পচে যাওয়া দেহ। মানুষটির বেঁচে থাকার কথা নয়, কিন্তু সে বেঁচে আছে।
তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
মানুষের জীবন যদি একটা উপন্যাস হতো, তাহলে কী সুন্দর করে এই কাহিনীটা শেষ করা যেত! চিকিৎসা করে একেবারে মৃত্যুর কাছে চলে যাওয়া মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তোলা যেত। জীবনের সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে তার একটা নতুন জীবন দেওয়া যেত। কিন্তু মানুষের জীবন আসলে উপন্যাস নয়−তাই যে জীবনীশক্তি নিয়ে সে বেঁচে ছিল, সেই জীবনীশক্তি নিয়ে সে আরও ৩৩ দিন বেঁচে রইল। লিটন, দেলোয়ার, আকাশ আর কবীর যখন তাকে মারতে চেয়েছিল, তখন সে মরতে রাজি হয়নি।
যখন তার আশপাশে তারা ছিল না, যখন মরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই−তখন যেন অনেকটা অভিমান করেই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
মৃত্যুর আগে রাহেলা শুধু একটা কাজ করে গেল। যে মানুষগুলো তার এই সর্বনাশ করেছে, সে তাদের সবার নাম বলে গেল। পৃথিবীর মানুষ তাকে বাঁচাতে পারেনি−কিন্তু যারা তার এই সর্বনাশ করেছে, তাদের অন্তত শাস্তি দিয়ে পৃথিবীর মানুষ যেন তাদের আত্মগ্লানি একটুকু হলেও কমাতে পারে, তার একটা সুযোগ সে করে দিয়ে গেল।
৩.
এইটুকু ছিল ভুমিকা।
এবার আসল কথায় আসি। দেশের মানুষ কী জানে এ অপরাধের সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল লিটনকে কখনো ধরা হয়নি? সবাই কী জানে যে কয়জনকে ধরা হয়েছিল, তারা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে? সবাই কী জানে মামলাটির কোনো আলামত সংরক্ষিত নেই। সাক্ষীরা যখন আদালতে এসেছিল, তখন আলামতের অভাবে তাদের সাক্ষী নেওয়া যায়নি। সবাই কী জানে আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় শুনানি হয়নি? সবাই কী জানে যে পিপি’র ধারণা, প্রমাণের অভাবে এই মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাবে?
আমিও জানতাম না। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহর থেকে একজন আমাকে ই-মেইল করে এটা প্রথম জানিয়েছিলেন−দেশে বসে আমি যে খবরটা পাই না, সেই খবরটা এসেছে ইন্টারনেটে ভর করে।
এটি অবশ্যি নতুন কিছু নয়। আজকাল খবরের কাগজগুলো কেমন জানি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাচ্ছে−অনেক খবরই এখন ইন্টারনেটে পেতে হয়।
একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও মনে হয় এই কথাটা বলা যায় যে আজকাল খবরের কাগজে আর সবকিছু ছাপানো যায় না। ১/১১-এর পর আমাদের প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটুকু এত দিনে মোটামুটি কেটে গেছে, এখন আমাদের সবার ভেতরে এক ধরনের উদ্বেগ। সেনাপ্রধান, প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশনার−সবাই বলছে নির্বাচন হবে, কিন্তু কেউ আর সেটা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে না।
মুখ ফুটে আমরা সব কথা বলতে পারি না, মোটামুটি শ্বাসরুদ্ধকর একটা অবস্থা। সাম্প্রতিককালে আমার অনেকবারই মনে হয়েছে একটা লেখা আমি দেশের খবরের কাগজে ছাপাতে পারব না, এটা ইন্টারনেটে ছাপাতে হবে! দেশের এই অবস্থার কারণে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক একটা নেটওয়ার্ক দাঁড়িয়ে গেছে।
আমাদের সরকার এখনো মাঝেমধ্যে খবরের কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেলের টুঁটি চেপে ধরে−তাদের জানা দরকার, খামোখা সেই চেষ্টা করে লাভ নেই−ইন্টারনেটে করে মুহুর্তের মধ্যে সেই খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়। যে খবরটা যত বেশি চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়, সেটা ছড়ায় তত দ্রুত, তত পরিপূর্ণভাবে।
ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগে এই অভাগিনী রাহেলা সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে, আমি তার কিছু হুবহু তুলে দিই; ‘...এই সুত্রে পিপি কয়েক দিন আগে আমাদের কোর্টের প্রদায়কের মাধ্যমে জানিয়েছেন মামলাটির কোনো আলামত এখন আর সংরক্ষিত নেই।
তদন্তকারী কর্মকর্তারাও জানেন না আলামতগুলো কোথায় আছে। ...একই সঙ্গে জানাল এর আগের দফায় সাক্ষী হাজির না হওয়ায় শুনানি হয়নি। প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেও জানালেন ভদ্রলোক। ’
অন্য একটি ব্লগ থেকে আরও একটু তুলে দিই: ‘বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল কাইয়ুম খান সোমবার জানান তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক রাশেদ আহমদ চৌধুরীসহ আরও দুই তদন্ত কর্মকর্তা আলামত সংগ্রহে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে কোনো সাহায্য করছেন না বলে আদালত জব্দ তালিকার এই দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে পারেননি। ...এই মামলার তিনজন আসামি হাইকোর্ট থেকে আগেই জামিনে মুক্তি পেয়েছে।
...মামলার প্রধান আসামি লিটন এখনো পলাতক। ...’
হ্যাঁ, আসামি লিটন এখনো পলাতক! আমাদের দেশের পুলিশের নানা রকম বদনাম আছে, কিন্তু এ কথাটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, পুলিশ যখন কাউকে ধরতে চেয়েছে, তারা তাকে ধরতে পারেনি, সেটা কখনো ঘটেনি। বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান, মুফতি হান্নান−কাকে তারা ধরতে পারেনি? লিটনের মতো একজন অপরাধীকে ধরতে পুলিশের কতক্ষণ সময় লাগে?
ইচ্ছে করলে এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে ধরে ফেলা যায়, কিন্তু তাকে ধরা হয়নি। তাকে ধরার জন্য যেন একটু চেষ্টা করা হয়, সে জন্য পুলিশের একেবারে প্রধানের কাছেও কেউ কেউ আবেদন করার চেষ্টা করেছেন−তার কাছে সেই আবেদনটি পৌঁছেছে কিংবা আবেদনটি পৌঁছানোর পর কোনো একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে রকম কোনো প্রমাণ কোথাও নেই।
আসলে সত্য ব্যাপারটি অনেক বেশি কঠিন।
রাহেলা একজন তুচ্ছ গার্মেন্টসের কর্মী, তার তুচ্ছ জীবন তুচ্ছভাবে শেষ হয়েছে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এ দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আছেন, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ জীবন দিয়ে খবরের কাগজ ভরে থাকে। তাঁদের আনন্দে আমরা আনন্দিত হই, তাঁদের দুঃখে আমরা ব্যথিত হই, তাঁদের হতাশায় আমরা ক্রুদ্ধ হই। রাহেলা নামের ১৯ বছরের একটা অতিসাধারণ মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার না হলে এ দেশের কোনো মানুষের কী আসে যায়?
রাহেলার মৃত্যুর পর চার বছর কেটে গেছে, এখনো কিছু হয়নি। কিছু হবে কি না আমরা জানি না।
সে যদি বেঁচে থাকত, আমি তার কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বলতে পারতাম−রাহেলা, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। এই পৃথিবী তোমার ওপর খুব বড় অবিচার করেছে। আমরা তোমাকে সেখান থেকে রক্ষা করতে পারিনি। যারা তোমার এই সর্বনাশ করেছে, আমরা এখনো তাদের বিচার করতে পারিনি। আমাদের ক্ষমা করো রাহেলা।
’
অভাগিনী মেয়েটা মরে গিয়েছে−ক্ষমা চাইবার জন্য আমরা আর কোনোদিন তার কাছে যেতে পারব না।
১৩.০৩.০৮
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
=== প্রথম আলো / ১৯ মার্চ ২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।