সমাজ বিকাশে সংস্কৃতির শত্রু-মিত্র
ফকির ইলিয়াস
====================================
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। বেড়াতে গিয়ে দুবাইয়ের একটি শপিং কমপ্লেক্স এলাকা দিয়ে হাঁটছি। আমার সঙ্গে আরো দুই বন্ধু। একজন আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন, এই সেই কোম্পানি, যারা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে হিন্দি সিনেমাগুলো বাজারজাত এবং প্রদর্শনের প্রধান এজেন্ট। আমার কৌতূহল বাড়ে।
একটু ভেতরে যেতে আগ্রহী হই। আল-নিমা এন্টারপ্রাইজেস। মালিক ভারতীয়। গুজরাটের অধিবাসী। দুবাইতে জয়েন্ট ভেঞ্চারে ব্যবসা করেন।
প্রধান ব্যবস্থাপক মি. রনজিত কোরে। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হই। তিনি তার অফিসে আমাদেরকে সাদর আহ্বান জানান। জমে যায় নানা বিষয় নিয়ে জম্পেশ আড্ডা।
মি. রনজিত জানান, তারা ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ।
সে চুক্তি অনুযায়ী মুভিগুলো আনেন। সরবরাহ করেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে। লক্ষ্য মুনাফা অর্জন, সে সঙ্গে বহির্বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতার বিকাশ ঘটানো। সে সময়ে ডিভিডি যুগ পুরোদমে চালু হয়নি। ভিএইচএস ক্যাসেটে রেকর্ডকৃত মুভিগুলোই দখল করে রেখেছিল বাজার।
সে ব্যবসাও নিয়ন্ত্রিত হতো এরকম বিভিন্ন চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
হালে সে অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বড়ো বড়ো শহরগুলোতেই গড়ে উঠেছে এরকম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। বেড়েছে ভারতীয় হিন্দি ছবির চাহিদাও। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের হলগুলোতে এখন হিন্দি ছবির প্রতাপ এতো প্রবল, কোনো কোনো হল আছে যেখানে সপ্তাহে সাতদিনই হিন্দি ছবি প্রদর্শিত হয়।
এমন অবস্থার ঢেউ লেগেছে ইউরোপ আমেরিকায়ও। বিশেষ করে বাঙালি অধ্যুষিত অভিবাসী দেশগুলোতে বাংলা ছায়াছবির বদলে হিন্দি ছবির জনপ্রিয়তা বাড়ছে ভীষণভাবে। এর কারণ কী? কারণটি হচ্ছে বাংলা ছায়াছবি, পাল্লা দিয়ে হিন্দি ছবিগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না। ফলে প্রজন্ম বেছে নিচ্ছে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি মুভির পর, হিন্দিকেই প্রথম পছন্দ হিসেবে।
বিশ্ব সংস্কৃতির গতানুগতিকতা এবং ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে কোনো রাষ্ট্র বা জাতির নির্মাতা শ্রেণী যখন সমকালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্মাণে বিফল হয় তখন অন্য সংস্কৃতি এসে সে স্থান দখল করে নেয়।
বলা যায়, বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাতাদের ব্যর্থতা সে জন্য বহুলাংশে দায়ী।
এরপর আসা যাক সাহিত্য প্রসঙ্গে। বাংলা ভাষাভাষী বাংলাদেশের অন্যতম বাংলা ভাষাভাষী প্রতিবেশী কলকাতা। অতীতের পানে তাকালে আমরা দেখবো পঞ্চাশ দশকের অনেক নামকরা কবিই কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য ম্যাগাজিন, সাময়িকীতে লেখার চেষ্টা করেছেন, লিখেছেন। সংস্কৃতি সাহিত্যের আদানে তা ছিল গুর"ত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী।
বাংলাদেশের এমন কিছু লেখকও আছেন, যারা বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পান এবং ব্যাপক জননন্দিত হন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মহান স্বাধীনতা লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্যেও ঘটে যায় নানা যোগাত্মক-বিয়োগাত্মক বিবর্তন। অনেকে বলেন, হিন্দির আগ্রাসনে কলকাতা জর্জরিত। আশির দশক থেকে আকাশ সংস্কৃতির পরিবর্ধনের কারণে বাংলাদেশেও, বিশেষ করে হিন্দির আবির্ভাব ব্যাপকতা পেতে থাকে।
আগেই বলেছি, পজেটিভ নেগেটিভ দুটি দিকই কিন্তু ঘটেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পরাজিত রাজাকার শক্তি নানাভাবেই সংগঠিত হতে থাকে। তাদের এজেন্ডায় তারা পরিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ র"দ্ধ করে দেওয়ার কাজটিকেও প্রাধান্য দিতে থাকে। রাজনৈতিকভাবে ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরির পাশাপাশি কলকাতার বাংলা সাহিত্য, সভ্যতা সংস্কৃতির বির"দ্ধেও এই চিহ্নিত মহলটির অপপ্রচার অহরহ লক্ষ করা যায়। এমন কি এক সময় যারা ভারতের লিটলম্যাগে কবিতা ছাপাবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন, তারাই হয়ে ওঠেন চরমভাবে পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা বিরোধী।
এ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রাহমানের একটি কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। নিউইয়র্কে এক আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, আজ যারা কথায় কথায় কলকাতার সাহিত্যকে খাটো করতে চায়, কটাক্ষ করে এরা মূলতই ছিল সুযোগ সন্ধানী। এক সময় তারা আবু সয়ীদ আইয়ুব কিংবা বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সখ্যতার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। এসব তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলা সংস্কৃতির চারণভূমি বাংলাদেশই হবে এবং থেকে যাবে।
কারণ বাংলাদেশ এককভাবে বাঙালি অধ্যুষিত একটি রাষ্ট্র। যদিও এ দেশের উপজাতিদের ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতাকেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এদিকে ইংল্যান্ড অভিবাসী বাঙালিরাও তাদেরকে ‘তৃতীয় বাংলা’র অধিবাসী বলে দাবি করছেন। বাঙালি প্রজন্মের সংখ্যা বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডাতেও।
তারপরও একটি চিহ্নিত শ্রেণী কলকাতা বিরোধী নানা ধুয়া কেন তোলে মাঝে মাঝে? এ প্রশ্নটি তাদেরকে করলে তারা জবাব দেন, তারা আগ্রাসন, আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করছেন।
আধিপত্যবাদ সম্পর্কে বর্তমান বিশ্বের মানুষ কম অবহিত নন। এই যুক্তরাষ্ট্র, যারা এখন গোটা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, এ রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নাগরিকরা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকেই এর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। ভিন্নমত পোষণ করছেন। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখতে হবে আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করা, আর পরিশুদ্ধ সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরা এক কথা নয়। এডওয়ার্ড সাইদ, নোয়াম চমস্কি, বিলি কলিন্স, আমিরী বারাকা, অ্যালেন গিন্সবার্গসহ এরকম শতাধিক নাম নেওয়া যাবে, যারা আধিপত্যবাদের বির"দ্ধে কথা বলেছেন।
কিন্তু কোনো হিংসা বিদ্বেষ ছড়াননি। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে পরাজিত রাজাকার শক্তির হাত ধরে একটি শক্তি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে তেমনি হিংসা ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। লক্ষ করলে আরো দেখা যাবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের সিটের জন্য কিংবা ভণ্ড প্রগতিবাদী সেজে নিজের নাম কামানোর জন্য যারা ঘাপটি মেরে বসেছিল এক সময়, তারাও এখন স্বরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। বাঙালির সংস্কৃতির বিশুদ্ধ পরিবেশকে কলুষিত করছে। আর এই তর"ণতম শক্তিকে প্ররোচনা দিচ্ছে সেই প্রাচীন গোষ্ঠী।
যাদের বই এখনো কলকাতার কোনো প্রকাশনী থেকে বের"লে গোপনে নিজেকে ধন্য মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে নমস্য ব্যক্তিত্ব শিবনারায়ণ রায়ের একটি কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীলরাই দ্র"ত রঙ বদলাতে পারে। নিজের স্বার্থের জন্য সব ধরনের ফতোয়া দিতে পারে তারা। যে কোনো সৃজনশীল মানুষকে অযথা আক্রমণ করতে কখনোই পিছপা হয় না।
খুঁজলে দেখা যাবে বাংলাদেশে এসব ভণ্ড ধারকরা কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করলেও নিজ স্বার্থের জন্য তারা সবকিছুকে মেনে নিতে এগিয়ে যায়। আনন্দবাজার পাবলিকেশনস যদি এদের কাউকে একটি বই প্রকাশের জন্য অফার করে, তবে তারা তা প্রথমেই বিনা দ্বিধায় লুফে নেবে। মুখে ‘ইনডিয়া’র বিরোধিতা করলেও নিজ স্বার্থে নাকে দাসখত দিতেও কার্পণ্য করবে না।
একইভাবে তারা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, সাংস্কৃতিক আদান প্রদান চুক্তিরও বিরোধিতা করেছে এবং করে যাচ্ছে। আরো গভীরে গেলে দেখা যাবে এরা মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন, সহযোগিতাকেও মেনে নিতে পারে না এখন পর্যন্ত।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে তাহলে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এসব ভণ্ড, সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীদের কেউ যখন ধরা খেয়ে যায় তখন নানা সুশীল বুলি আওড়িয়ে পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহের আপ্রাণ চেষ্টা করে। তস্করবৃত্তির জন্য এমন ধরাপড়াদের সংখ্যা এখন ক্রমশ বাড়ছে।
এটা কে না জানে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে যারা ব্যক্তিগত উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে, করতে চায়, এরা প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি-সভ্যতার শত্রু। আর একটি সংস্কৃতির প্রকৃত মিত্র হচ্ছে সে ভাষার সাধারণ মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র সংস্কৃতির ঝলক বুকে ধারণ করে একটি কথা স্পষ্ট বলতে পারি, কোনো রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষই আধিপত্যবাদকে সমর্থন করেন না।
সে রাষ্ট্র যতো ধনী কিংবা যতো দরিদ্রই হোক। বাংলাদেশে হাজার বছরের বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতিকে যারা হিংসা-প্রসূত অস্বীকার ও ধ্বংস করতে চাইছে, এরা অন্তঃসারশূন্য। রাজনৈতিক প্রয়োজনে তো বটেই, সমাজ বিকাশের প্রয়োজনে এ গোষ্ঠীকে প্রতিহত করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
নিউইয়র্ক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
-------------------------------------------------------------------------------
--দৈনিক ভোরের কাগজ । ১ মার্চ ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।