ছোট্টবেলার কথা। আমার বয়স তখন ততটাই কম যতটার আগে মানুষের স্মৃতি শক্তিরই জন্ম হয় না। তখন ইসলামপুরে থাকতাম। দেওয়ানগঞ্জের কাছাকাছি জায়গা ইসলামপুর উপজেলা। আজ এত্তগুলো বছর পর সেই ইসলামপুরটা কেমন আছে খুব জানতে ইচ্ছা করে।
নিশ্চই অনেক অনেক পাল্টে গেছে। বাবার ছিল বদলির চাকরী। প্রতি তিনবছর পর পর একজায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া। মা’র মুখে শুনেছিলাম আমরা নাকি প্রথম থাকতাম নকলা’য় । বাবার চাকরি শুরু সেখানেই।
মা আর আমাকে নিয়ে ছিল বাবার সংসার। তখন মায়ের কোলে আমি। সেই নকলা আমার স্মৃতিতে নেই- কি ছিল সেখানে, কেমন ছিল আশপাশ তার কিচ্ছু নয় –শুধু মায়ের মুখে শোনা কিছু বিচ্ছিন্ন ছবি ছাড়া আর কিছু ভাসে না চোখে। নকলা থেকে গেছি আমরা ইসলামপুর-যেখানে আমার স্মৃতির খাতা সবে খুলেছে মাত্র। ইসলামপুরের পাট চুকিয়ে বাবা বদলী হয়েছিলেন দেওয়ানগঞ্জ।
বিখ্যাত চিনিকলের দেওয়ানগঞ্জ। এখানকার বিশাল অঙ্কের একটা স্মৃতি মনে করতে পারি। আজো চোখে ভাসে বাবা’র অফিসের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেল-লাইনের দুপাশে ছোট-বড় বিল, যে বিলে ওখানকার লোকেরা চাষ করত ‘পানি ফল’। অনেকে আমরা যাকে ‘সিঙ্গারা’-ও বলে থাকি। অসম্ভব প্রিয় ছিল আমার।
বাবার চাকরীর সুবাদে আমাদের বাসা ছিল তখন উপজেলা কোয়ার্টারে। কোয়ার্টার থেকে বাবার অফিস খুব কাছেই ছিল। প্রায়ই চলে যেতাম ওদিকে, এমনি হাটতে হাটতে। আমাকে দেখলেই বাবার অফিসের দারোয়ান কাকা দৌড়ে গিয়ে বিল থেকে থোকা থোকা পানিফল তুলে আনত। বলা বাহুল্য সেই লোভেই মাঝে মাঝে মার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম বাবার অফিসের নিচে।
বাবাও জানতে পারত না কারন, বাবার অফিস ছিল দোতলায়। অফিসের ধারে কাছে গিয়েও , বাবার সাথে কোন দেখা-টেখা না করে নিচে থেকেই আমার পানি ফল সংগ্রহ শেষে -ফুট। সেই দারোয়ান কাকার কথা খুব মনে পড়ছে আজ।
যাই হোক, আজ দেওয়ানগঞ্জ নয়, মুলত বলছিলাম ইসলামপুরে থাকা কালীন আমার খুবই খন্ডিত এক ঝলক বিদ্যুত চমকের মত মনে পড়া একটি হাস্যকর স্মৃতির কথা। স্মৃতিটুকু হাস্যকর কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না, আবার খুব সিরিয়াস কিছু কিনা তাও বলতে পারছি না।
তবে সেই স্মৃতির ছবিটুকু জানি কোন্ অজান্তে আমার সত্ত্বার গহীন কুহরে দিব্যি লীন হয়ে গেছে। প্রত্যকেরই ছোটবেলার কিছু টার্নিং পয়েন্ট বা ঘটনা বা খন্ডিত ছবি থাকে এবং সেই ছবি গুলো হতে পারে খুব নগন্য হতে পারে ভয়াবহ । যাই-ই হোক না কেন, তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা পিএইচডি করুন-এমুহুর্তে সেটা নিয়ে বিচলিত নই, যেটুকু বলতে চাইছি সেটুকু হল- ঐ ছবিগুলো, সচরাচর মানব শিশুর অবচেতনের গহীন গভী্রে বোধয় প্রবল কিছু প্রভাব ফেলে যায়। আমার এই স্মৃতি-ছবিটা যেন সেরকমই ছিল কিছু। ছবিটা কিছুটা এরকম- বাবা সকাল বেলা ঘরের দরজার সামনে সপ (পাটি ও বলে) পেড়ে বসে হাতে কিছু কাগজ নিয়ে কি যেন লিখছেন খুব মনযোগ দিয়ে।
মা বোধয় সকালের চায়ের কাপ হাতে কছে এসেছেন-দেখেন বাবা কি যেন লিখছেন এবং মা আসার সাথে সাথে খুব লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে পাশে সরিয়ে রাখলেন। মা বুঝে গেলেন যে এটা অফিসের কোন কাজই হতে পারে না। তা নাহলে এত লজ্জা পাওয়ার কিংবা এতটা হতচকিত হওয়ার কি আছে? তাই মা সেটা দেখতে চাইলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার ঘটল বাবা সেটা দেখতে দিচ্ছেন না। মা যতই জোর করছেন বাবা ততই না না করছেন।
অবশেষে মার সাথে আর না পেরে বাবা বললেন- এটা ‘পান্ডুলিপি’। মা বললেন – ‘পান্ডুলিপি? পান্ডুলিপি কিসের?’ বাবা বললেন- ‘এই আছে...একটা কিছুর’। মানে হল- বাবা মোটেও মাকে সেটা দেখাতে চাচ্ছেন না। মা’র তাই ভীষণ অভিমান হল। মুখ গোমড়া করে ফেললেন।
বাবা সেটা দেখে তড়িঘরি করে বললেন- এটা আসলে একটা গল্প। এটাই সেই ছবি টুকু।
আমার স্মৃতিময় এই ছবির সমস্তটার নির্যাস এসে জমা হয়েছে ‘পান্ডুলিপি’ শব্দটার ভিতর। আমার ওইটুকুন জীবনের মধ্যে প্রথম শোনা একটা শব্দ। যার মানে দাঁড়ালো আমার কাছে......গল্প।
অর্থাৎ ঐ মূহুর্তে আমি ভাবছিলাম ‘পান্ডুলিপি’ মানে গল্প। যাই হোক পরে এই পান্ডুলিপি নিয়ে মা , বাবাকে অনেক ক্ষেপাত। আরো পরে বুঝতে পেরেছি পান্ডুলিপি মানে কি। তবে সেই যে ছোট্টবেলায় ‘পান্ডুলিপি’ শব্দটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল...আর বাবাকে সেটা লিখতে দেখেছিলাম- সেটা নিজের ই অজান্তে কখন যে নিজের ভিতরে ঢুকে গেছে.........খেয়াল ই করিনি। বলা যায় লেখা লেখির একটা অণুবীজ যেন সেদিন বপিত হয়ে থাকল আমার মাথার মধ্যে.........যার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল তার ও সাত-আট বছর পরে, ক্লাস সিক্স- সেভেনে এসে.........অসম্ভব হাস্যকর আর ছেলে মানুষি টাইপের একটা কবিতা লেখার মাধ্যমে।
সেই ইসলামপুরে খোলা কেবল ঝকঝকে তকতকে স্মৃতির খাতাটি আজ বেশ ধুলোমলিন- মরচে রঙ্গা হয়ে গেছে, যেন ক্লাস ওয়ানের বাংলা বইয়ের ( ‘আমার বই’ প্রথম ভাগের) প্রায় ছিঁড়েই যাবার দশায় উপণীত সূচীপত্র পাতাটি। এ বই পড়তে নিলে কোন দিনই সূচীপত্র দেখার প্রয়োজন হয় না যেহেতু, তাই খুব হঠাৎই খেয়াল করাতে আজ এতোটা বছর পর মনে হল যেন – পাতাটা লেমিনেটিং করে রাখা দরকার। তাই এই প্রয়াস।
এরপর এই লেখাটি ভালো লাগলেও লাগতে পারে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।