আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উত্তরবঙ্গের আদিবাসী নারী

ঢেউ খেলানো বরেন্দ্র অঞ্চলের বুকে পদ্মা, মহানন্দা, পুনর্ভবা, তিস্তা, করতোয়ার ছুটে চলা স্রোতধারা যেন সদ্য যৌবনার বেনী দুলানো দেহ পল্লব। শাসে রসে ভরপুর রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরের আম লিচুর মিষ্টতা মনের তিক্ততা, রুক্ষতা নিমিষেই শুষে নেয়। সবুজে শ্যামলে জঙ্গল সমতলের এ অঞ্চলে রয়েছে ৩৭টি আদিবাসির প্রায় ১৫ লক্ষ লোকের বসবাস। সাঁওতাল, ওরাঁও, পাহান, মাহাতো, মুন্ডা, মালো ছাড়াও রয়েছে নানা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বসবাস। আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী।

কাজেই কোনো কাজে সফলতা পেতে হলে নারীর অংশগ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। নারীকে বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে রেখে কখনোই কাংখিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুস্থ, সবল, স্বাভাবিক নারীকে যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধি করে রাখা হয় তাহলে আমাদের এই সমাজ, জাতি, দেশ চিরকালই পঙ্গু হয়ে থাকবে। প্রত্যেক সমাজেই নারীরা কমবেশি নানা ক্ষেত্রে পদে পদে নিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। আদিবাসি সমাজের মেয়েরা তো আরো বেশি পশ্চাদপদ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নারীরা।

আমাদের আদিবাসি নারীরা সবার আগেই ঘর ছেড়েছে পুরুষের সাথে। জীবন, জীবিকার তাগিদে জলে-স্থলে ঘুরে বেড়িয়েছে। নগর সভ্যতার আলো থেকে দুরে থাকতেই এরা পছন্দ করে কিনা তাই আজও তারা পাহাড়, অরন্যে নিভৃতচারী জীবন যাপনেই স্বস্তি বোধ করে। অন্যান্য নারীরা যখন দল বেঁধে নভোচারী রুপে চাঁদে যেতে উদ্যত আমাদের আদিবাসি নারীরা তখনও মাঠের কাজে বেরোয়, সাতসকালেই । কাল প্রবাহে বিশ্বায়নের থাবায় যখন তছনছ হচ্ছে আদিবাসিদের আবাসভূমি, অস্তিত্ব যখন সংকটাপূর্ণ তখনই তারা আড়মোড়া ভেঙ্গে দাবি, অধিকার আদায়ে উচ্চকিত হচ্ছে।

কানে বাজে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে আমরা কতটা একতাবদ্ধ ও আন্তরিক? যে নারী নাকি পুরুষ বেশে রোহিতাসগড় দূর্গ রক্ষা করেছিল সেই নারী কি এখনও তার যোগ্য অবস্থান আর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারছে? সেই নারী এখন অরক্ষিত, ভোগ্যপণ্য, অসহায়! বেশির ভাগ আদিবাসি নারীর ক্ষেত্রেই কথাটি খাটে। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বিরশা মুন্ডার উত্তরসুরীদের তীরের অব্যর্থ নিশানা পশুপাখিই মারে শুধু সম্পদ, সম্ভ্রম নিরাপত্তা দিতে পারে না। অথচ এককালে শিশু-নারীদের রক্ষণব্যুহ ছিল এই তীর-ধনুক । তীরের ফলা অগ্রাহ্য করে নারীদের উপর চোখ বুলায় এমন সাধ্য ছিল কার? এখন সাত বছরের শিশুও রেহায় পায় না। তীরের ফলায় যেন জং ধরেছে।

মনের চেতনাতে তো বটেই। আমরা এমন স্বাধীনতা পেয়েছি যা ভোগের ক্ষেত্রে, দেশকাল পাত্রে বিস্তর ফারাক। গানিতিক আর জ্যামিতিক। অ-আদিবাসিরা জ্যামিতিক আর আদিবাসিরা গানিতিক। উন্নয়নের উর্দ্ধমুখী চলন্ত সিড়িতে আমরা নামছি নিচের দিকে, পদপিষ্টের ভয়ে! স্বকীয়তার সংরক্ষণে! কাজের মৌসূমে কোনো আদিবাসি গ্রামাঞ্চলে গেলে দেখতে পাবেন সকালবেলা নারী-পুরুষরা দলবেঁধে কাজে যাচ্ছে।

দলে কিশোর কিশোরী থেকে সচল বুড়াবুড়িকেও দেখতে পাবেন। কাজ করার সাথে সাথে গান গায় শরীর মন দুলিয়ে দুলিয়ে। উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে শ্রান্ত মন, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরে। শক্ত সামর্থ শরীরের বাড়তি উৎপাদন কার না কাম্য। ঘামে ভেজা কালো চিটচিটে নারী শরীরের গন্ধও মনিবদের মন ভরায়।

কাজের মৌসুমে স্কুলের হাজিরা খাতায় উপস্থিতির হার কমে, ক্ষেত খামারে উপস্থিতি বাড়ে, কমে পরীক্ষার হলে উপস্থিতি ও খাতার নাম্বার। এভাবেই ঝরে পড়ে সম্ভাবনাময় সজীব প্রাণ। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরা শিখতে না শিখতেই বিয়ে হয় অনেকের। জন্মদায়িনী মা হয় অল্প বয়সেই। এই বয়সে মা হওয়ার কারনে নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগে মা ও সন্তান দুজনেই।

যে মুহুর্তে তারই কোনো সহপাঠি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে কিংবা কোনো বান্ধবী মোটা অংকের টাকা কামায়, খ্যাতি লাভ করে, ঠিক সে সময়ে আদিবাসি মেয়েরা সন্তান কোলে পিঠে নিয়ে কাজ করতে ছোটে। পড়া ভুলে, পাকে ঘোরে। সমাজ সামাজিক অবস্থা দেখার সময় কই? শিক্ষিত নারীদের বেলায় যেটা হয় গ্রামের শান্ত সুবোধ মেয়েদের অনেকেই শহুরে পরিবেশে এসে নিজের ভোল পাল্টিয়ে অচেনা হয়ে যায়। দেড় বছরের ব্যবধানে দেড় যুগের চর্চিত মাতৃভাষা ভুলে যায় কেউ কেউ। বাংলা-ইংরেজি টোনে ভাষার ব্যবহার শ্র“তিকটু হলেও অনর্গল উদগিরন ঘটে মোবাইল আড্ডায়।

পরনের টি শার্ট আর জিন্সের হাল ফ্যাশন-ডিজাইনে বাহারী রং এর ছাপ লাগান যোগান চাহিদার সূত্র মেনে। ব্যাঙ্গাচির লেজের মতো কারো কারো নামের শেষাংশ লুপ্ত হয়, হ্রস্ব হয় কেশ-বেশ। চেনা জগতের বিস্তার ঘটে। বন্ধু মহলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। ফেসবুক, মোবাইলের নেটওর্য়াকে অবাধ বিচরণ ঘটে।

আবার এমন জনও আছেন যারা তাদের অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য ক্যাম্পাস-মেসের রুটিন অনুসরণ করেন কড়া নিয়মে। আবার কেউ কেউ চিন্তার চরকি কেটে মগজ ঘামান। সবাই যে যার কাজে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না। আন্তরিকতাহীন হাই-হ্যালোর মতো সস্তা সংলাপে কুশল বিনিময় করেন। প্রশ্ন জাগে, বন্ধুত্বের তালিকাটা লম্বা হলেই কি আন্তরিকতায় ঘাটতি পড়ে? জুটিতে-খুটিতে বাধা পড়লেই কি চিন্তা চেতনায় বনসাই হতে হয়? অবাধ তথ্য প্রযুক্তির ডিজিটাল যুগেও যেন আমরা যোজন যোজন দুরত্বে অবস্থান করছি।

মতিহারের সবুজ চত্তরে গন্ডা পায়ের ছাপ ফেলে, ইডেনের আলিসান অট্টালিকায় বসবাস করেও কি মনের সংকীর্নতা কাটে? প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা অপরাজেয় বাংলা’র মূর্তি কি মনে কোনো আদর্শের ভিত্তি গড়ে? কেতাবী জ্ঞানের ও নামের বহর বাড়ে, উঁচু দরের-মানের ডিগ্রী জোটে, গ্রাজুয়েটের মিছিল ভারী হয়, মোটা মোটা বইয়ের গাদায় ভরে উঠে ট্রাংক, বস্তা, আলমারী কিন্তু বাড়ে কি তাদের কর্মের কাভারেজ? ইউক্যালিপটাস গাছের মতো পানি শুষে দৈর্ঘ্যইে বাড়ে শুধু, দেয় কি ছায়া ফল? সন্দেহ উঁকি দেয় এসব কি শুধু বর পক্ষের নজর কাড়তে? ব্যক্তি বিশেষের মন পাবার জন্য বা প্রিয়জনের মানভঞ্জন ও মনোরঞ্জনের খাতিরে কতই না আয়োজন করা হয়! বাল্যশিক্ষা, নীতি-নৈতিকতার কতটুকু মগজে ঢোকে? হাইহিলে পথ মাড়িয়ে হাই-হ্যালোতে মন ভরিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয়, ছাত্র-ছাত্রী সম্মেলনে রসিয়ে, শাসিয়ে, ইনিয়ে-বিনিয়ে আত্মজাহির করার প্রবনতা থাকে না ক’জনের ? সংকর সম্পর্কের ব্যপারে অত্যুৎসাহী হয়ে ওঠে শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই। এ বাতিক প্রবণতা হীন মানসিকতারই স্বাক্ষর। সৃষ্টিশীলতার কী উদাহরণ পিক আওয়ারে আমাদের সোনাজাদুরা ঘুম হারাম করে মোবাইলে কল্প-কথার রং-রেণু ছড়িয়ে স্বপ্নাকাশে রংধনু আঁকে। সাশ্রয়ী রেটে ম্যারাথন কথার রেসিং চলে লাগামহীন ঘোড়ার মতো দিকবিদিক। জীবন নদীর গভীর নাব্যতায় পানকৌড়ির মতো ডুব-সাতার দিয়ে তো আর কাংখিত ফল পাওয়া যাবে না! কোনো নারী তার অর্জিত আয়ে নির্মিত নিজের বহুতল বাড়ির ছাঁদে হ্যালিপ্যাড বানাতে পারে অনায়াসে, কিন্তু হিমালয়ের মতো উচ্চতায় উঠতে গেলে টাকা বা ডিগ্রী মুখ্য নয়।

শারীরিক সক্ষমতা তো বটেই অসীম ত্যাগ, ধৈর্য, সাহস সর্বোপরি মানসিক দৃঢ়তা লাগে। পুরুষ শাসিত সমাজের পরতে পরতে বৈরি পরিবেশ আর প্রতিবন্ধকতার কাঁটাতার ডিঙ্গোতে হয়, মাড়িয়ে যেতে না পারলে পাশ কাটিয়ে যেতে হয় সন্তর্পণে। কিছু কিছু আদিবাসি মেয়ে হিলজুতায় পা চালান দিয়ে ক্যাটওয়াক করতে পারলেই নিজেদেরকে এভারেস্ট জয়ী নিশাত, নাজরীনদের সমকক্ষ মনে করে। কোনো সংকটময় মুহুর্তে, নাজুক পরিস্থিতিতে, কোনো প্রয়োজনে যেচে কারো সাথে কথা বলতে গেলে কিংবা মিটিং, সমাবেশ, মানববন্ধনে অংশগ্রহনের কথা বললেই অনেক মেয়েই ভাশুর জ্ঞানে কথা বলে। পরীক্ষার অজুহাতে এড়িয়ে যায় বার বার।

যেন সারা বছরই পরীক্ষার মাঝে মাঝে ক্লাস হয় ওদের। অথচ সেই সময়ে তারাই কিনা জুটি বা দলবেঁধে ঘুরছে কোথাও কিংবা কোনো পার্কে বসে বাদাম চিবুচেছ। দুর্ভাগ্য এখন পর্যন্ত উচ্চতর পর্যায়ে উত্তরবঙ্গের কোনো আদিবাসি মেয়েকে প্রথম শ্রেনিতে প্রথম হতে শুনিনি। তথ্যবিনিময়, কুশল জিজ্ঞাসায় মোবাইল বা পত্রে কারো সাথে যোগাযোগ করলেই কি এইড্স এর জীবানু ছড়ায়? কোনো বিষয়ে সহভাগিতা করলেই কি তা প্রেম প্রস্তাবের ইঙ্গিত বহন করে? আমি মনে করি না আমাদের মেয়েদের মন এতটা ঠুনকো যে কারনে কারো সাথে হেসে দুটো কথা বললেই প্রেম হয়ে যাবে। আর ছেলেদের মনও এখনো প্রেমের গুচ্ছগ্রাম বা আদর্শ নার্সারী হয়নি যে, যে কেউ ইচ্ছে করলেই যখন তখন সেখানে বসবাস বা চারা বীজ সংগ্রহ করবে।

এরকম অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা; বৃহত্তর ময়মংসিংহ ও সিলেটের গারো, মনিপুরী ও খাসিয়া মেয়েরা ছাত্র-যুবদের সাথে পরামর্শ করে করণীয় নির্ধারণ করে। শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে, ন্যায্য দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল হয়। বিবৃতি দেয়, প্রতিবাদ করে । আসন্ন বিপদাশংকায় এরা পিছু হটে না। লজ্জাবতী লতার মতো এরা মিইয়ে যায় না, কর্মকান্ডের ধারা গতিও নয় শম্বুকের মতো ।

কিন্তু উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নারীরা যেকোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে চলমান কোনো আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। এর কারণ হিসেবে বলা যায় যে, কারো কারো অভিভাবকদের তরফ থেকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ না তাড়ানোর কড়া নির্দেশনা দেয়া থাকে! কারো কোনো লাভ ক্ষতিতে এদের কিচছু যায় আসে না। বলা হয় যে সমাজ তো আর তাদের জাতি উদ্ধারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়নি! ও কাজ পুরুষের! সামাজিক বা জাতিগত কোনো সমস্যাতেও তারা নিরুদ্বিগ্ন থাকে। একান্তই দায়ে না পড়লে এদের আগমন ঘটে অতিথি পাখির মতো কালে ভদ্্ের। ক্যাম্পাস জীবনে যাদের এই ভূমিকা সংসার বা কর্ম জীবনেও তারা চরম স্বার্থবাদী হয়ে থাকেন।

সমাজ, জাতি তাদের দ্বারা কতটা উপকৃত হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এক কল্পনা চাকমার অপহরণ জাগিয়ে দিয়ে যায় শত হাজার নির্জীব প্রাণকে। আর আমাদের সি.এ, ব্যারিস্টার, ডাক্তার বোনদের তো লো ফ্্িরকোয়েন্সিতে পাওয়ায় দায়! রেবেকা সরেন আর বিশুদমনি টপ্যই যেন গোটা উত্তরবঙ্গের নারী প্রতিনিধি! ডিগ্রী আর কর্মব্যস্ততার ভারে নুয়ে পড়া দিদিরা ঘর-বর-সন্তান সামলানোতেই মহাব্যস্ত সময় কাটান। ছোট ভাইবোনদের খোঁজখবর নেয় ক‘জন? খাতা কলম পায় ক‘জন? মলিন, শুষ্ক, হতাশাগ্রস্থ জীবনে আশার আলো কে দেবে জ্বালিয়ে? পরিবার সমাজে নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহীতের পক্ষে দাড়াবে কে? বড়দিদিগণ, আমাদের ছোটবোনদের জন্য এমন একটা আস্থা, নির্ভরতা আর আদর্শের স্থান তৈরী করে দিন যাতে আমাদের ভরসা হয়। আমাদের মেয়েরা মন্দিরে যায়, প্রসাদ বিলায়; গীর্জা করে, কোরাস গায়; বিহারে গিয়ে শীল ধারণ করে।

আমাদের ধর্মীয় গুরুরা ক’জনকেই বলে,“মা, তোমাকে আদর্শ নারী হতে হবে, শিক্ষিত ও আদর্শ মা হতে হবে তোমায়। ”কাউকে উচ্চারণ করতে শুনিনি,“ওর পড়াশুনার দায়ভার আমি বা আমরা নেব। ” উৎসাহ দিয়ে কেউ কাউকে বলেনি যে, “পড়াশুনা চালিয়ে বাছা, বিপদে আপদে আমরা তো পাশে আছি। ” মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ বলে না যে,“ সাবাস জোয়ান , তোমাকেই হতে হবে আদিবাসি সমাজের কান্ডারী। ” বাগ্মিতায়, গায়কীতে, নেচে-কুদে শত হাজার তালি পাওয়া যায় তাৎক্ষনিক, কজনের ভাগ্যে সদুপদেশ জোটে? দুর্মূল্যের বাজারে এও বড় দু®প্রাপ্য জিনিষ! বৃষ্টিমুখর দিনে, কর্মহীন অলস মুহুর্তে আদিবাসি নারীরা খেজুর পাতার পাটি গাথে; কাথা সেলাই করে; কাশ গাছের ঝাড়– বানায়; মাথার ওকুন মারে; মাঠে, জলে-জঙ্গলে জ্বালানী খোঁজে চুলার, পেটেরও।

জীবিকার প্রয়োজনে কেউ কেউ বাঁশ-বেতের আসবাব পত্র বানায়। বই খাতায় নয় এসবেই তারা স্বপ্ন বোনে। স্বর্ণলতার মতো চিন্তা চেতনার হামাগড়ি চলে নির্দিষ্ট আবর্তে, পলু পোকার মতো। ভাবনার বারুদে ঠাসা থাকে অলস মুহুর্তের গর্ভাশয়। যতœ আত্তির অভাবে গর্ভপাত ঘটে বার বার অকালেই।

একসারিতে বসে নারী পুরুষরা নেশা করে কিন্তু কোনো নীতিনির্ধারনী কাজ, গ্রাম্য সালিশ বা পারিবারিক সমঝোতায় নারীর মতামত গ্রাহ্য করা হয় কতটা? অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মতামত বা কথা বলাটা এখনো অভদ্রতা বলেই গন্য হয়। মেয়েরা তো সেখানে একপ্রকার নিষিদ্ধ! আমাদের কিছু কিছু মেয়ে তাদের রুপচর্চা আর সাজপোশাকে যে সময় ব্যয় করে তার সিকি আনা সময় যদি তারা সমাজ, জাতি ও দেশের স্বার্থে ব্যয় করে তাতেও সমাজ উপকৃত হবে অনেকখানি। কপালের টিপ, চোখের কাজল যদি একটু সরে বা নড়ে যায় কিংবা অলংকার পোশাকে যদি ম্যাচিং না হয় তবে তাতে দর্শনকারীর চোখও পীড়িত হয়। অথচ সমাজে বিদ্যমান নানা রকম অসঙ্গতি, অনিয়ম, অবিচার দেখেও আমরা নির্বিকার থাকি। সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাপারে এখনো পিতা মাতারা নিষ্পৃহ।

নগদ অর্থ প্রাপ্তিতেই এদের আগ্রহটা বেশি। অর্থাগমের উৎস হিসেবে অনেকেই কিশোর বয়সেই শারীরিক শ্রমযুক্ত কাজে যেতে বাধ্য হয়। সস্তা শ্রমের বাজার হারানোর আশংকায় স্থানীয় ধনিক সম্প্রদায় আদিবাসিদের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখান না। ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিগনিত এসব সহজ সরল আদিবাসিরা এলাকার বিত্তশালী ও ক্ষমতাবানদের কথামত চলেন। আমাদের জনপ্রতিনিধিরাও কি সচেতন আর পরোপকারী! আদিবাসিদের মদ হাড়িয়া খাওয়ার জন্য পেয়ালা-পাতিলের সরবরাহ করেন ভোটের উপঢৌকন হিসেবে! এভাবেই সর্বনাশা বিভেদের বীজ বুনে দেন হাড়িয়ার হাড়ি-জলে! আর তাতেই সলিল সমাধি ঘটে চেতনার।

সম্পদ হারান, ঋণের দায়ে নিজের বসত ভিটা থেকে উচ্ছেদ হন । এভাবে সর্বস্ব খুইয়ে একসময় দেশান্তর হয়ে যান। এই হাড়িয়া মদ বানাতে আবার সেই নারীদেরই ব্যবহার করা হয়, তারাও বেশ উৎসাহের সাথে তা প্রস্তুত করে থাকেন। নারীদের দূর্ভাগ্য যে তাদের প্রস্তুতকৃত সুরাপান করে মাতাল স্বামীরা স্ত্রীদের উপর অকারনে চড়াও হয়। সংস্কৃতির ধুয়ো তুলে, সারাবছরই পুজা, পার্বণ, উৎসবের আয়োজন করে ঘটা করে সুরাপানের ব্যবস্থা করা হয়।

আনন্দের হিল্লোলে মাতোয়ারা হয়ে যায় আদিবাসি-পাড়া, মহল্লা। দুধ বিক্রি করে মদ-হাড়িয়া পানি খেয়ে উন্মাতাল হয়ে দাম্পত্য কলহের ঘটনাও কম ঘটে না। ক’টা পরিবারের অভিভাবক চায় তার সন্তান সমাজসেবী বা জাতিসেবক হোক। সমাজ, জাতির মাতব্বররাই কি চায় তাদের ক্ষমতা, যশ, প্রতিপত্তি-প্রভাব ছাপিয়ে অন্য কেউ উপরে ওঠুক। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব হারানোর আশংকায় উদ্বিগ্ন, স্থবির প্রাচীন সমাজ প্রগতিশীলদের পথে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

উদীয়মান যুব তরুন সম্প্রদায়কে অংকুরেই ধ্বংশ করা হয় নানা প্রতিবন্ধকতা আর প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে। ফলে তারা বাপদাদার পেশায় থেকে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যারা প্রতিকুলতা কাটিয়ে শিক্ষিত হন, অর্থকড়ি কামান, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হন তারাও সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত আদিবাসি সমাজকে টেনে-ঠেলে তুলতে সাহস দেখান না। এদের মধ্যে থেকেই যে দু-চার জন নারী ওঠে আসেন তারাও পৃষ্ঠপোষকতা, নিরাপত্তা, সঠিক দিকনির্দেশনা ও আনুকুল্যের অভাব এবং প্রতিকুল পরিবেশের কারনে পিছিয়ে পড়েন। সমাজ বিনির্মাণে যুব তরুন সম্প্রদায়ই দক্ষ কারিগরের ভুমিকায় অবতীর্ন হয়।

ন্যায়, সত্য, সুন্দরের পূজারীরুপে তারা যদি অভিজ্ঞদের পরামর্শে কায়িক, বাচনিক, মানসিক ক্রিয়াকলাপ সংগঠনে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হয় তবে যেকোনো কাজে অবধারিত ভাবে সফলতা আসে। বুদ্ধি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বয়স বিবেচনার দাবী রাখে বৈকি তাই বলে তো আর প্রাচীনদের গোড়ামী, কুসংস্কারগুলোকে লালন করা যায় না। অবশ্য নতুনদের বেয়াড়াপনা, উচ্ছৃংখলতাও সমান ভাবে পরিত্যাজ্য। উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নারীদের মধ্যে একনিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর বড় অভাব। নারীদের একত্রিত হবার জন্য কোনো প্লাটফরম নেই।

আমাদের উচ্চশিক্ষিত অগ্রজরা এখনো উত্তরবঙ্গে কোনো একক সংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি। জনগণের সাথে গাঢ় সম্পৃক্ততাই বা আছে ক‘জনের? এসব ব্যাপারে কারো কোনো গরজ নেই যেন। ব্যক্তি বিশেষের সামান্য উদ্যোগ চোখে পড়ে বটে তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। হিল উইমেন্স ফেডারেশন সহ অন্যান্য আদিবাসি নারীদের অধিকার বিষয়ক যেসব সংগঠন রয়েছে সেসবের সাথে উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নারীদের কোনো আন্ত-সম্পর্ক নেই। উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নারীরা ইচেছ করলে তাদের সাথে মতবিনিময় করে তাদের আদলে সংগঠন তৈরী করে কর্মতৎপরতা চালাতে পারে।

ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে পুরুষ সর্বস্ব সংগঠন মুখ থুবড়ে পড়বে। কালো-সাদা, লম্বা-বেটে, মোটা-স্লিম ফিগার আকারের মানদন্ডে নারীর মূল্যায়ন নয়, নারী স্বকীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শণ করে আমরা যদি নারীকে অবজ্ঞার চোখে না দেখে নারী সত্তাকে যথাযথভাবে মুল্যায়ন করি, নারীর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে অনুকুল পরিবেশ দিই তবেই নারী হয়ে উঠবে পরশ পাথর! দৈন্যতা স্বীকারে পুরুষের কৃপণতা/অক্ষমতাই সামগ্রিক উন্নয়নের ধারায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। পোশাকের হ্রস্ব-দীর্ঘতা নয়, নয় এ্যারোমেটিক কসমেটিকস বা আতর সুগন্ধির ¯েপ্র-পালিশ, নারীর ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্বই হোক আত্মরক্ষার ঢাল বর্ম। আসুক অনুজ, বাড়–ক বেগ, উবে যাক যতো উৎকন্ঠা আর উদ্বেগ। জেগে ওঠুক প্রাণ নির্ভিকতায়, রত হোক নারীর যোগ্য আসন প্রতিষ্ঠায়।

বিজ্ঞ পাঠক, অর্ধেক স্বচ্ছ পানি পূর্ণ কাঁচের গ্লাসের খালি অংশটাই চোখে বেশি পড়েছে, পূর্ণ অংশটাকে দৃশ্যমান করতে কেউ একজন তাতে রং ঢালুন, যাতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.