আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উত্তরবঙ্গের ডায়েরী

''যার সৃষ্টির স্থায়ীত্ব যত বেশী সে তত বড় মাপের কিংবদন্তী'' প্রতিবার ভ্রমনের আগে আমার ক্ষেত্রে যা হয়, এবারো তাই হলো ! যাওয়ার জন্য একদল লোক সাড়া দিলেও শেষমেষ আমার একমাত্র ভ্রমনসঙ্গী হলো আমার কাজিন ভ্রাতা, পাভেল ভাই। আমরা মোটে দুই। কি আর করা, অগত্যা এ নিয়েই আগানো যাক। আমাদের এবারের সফরসূচীর জেলাগুলো হচ্ছে রংপুর, দিনাজপুর আর বগুড়া। তিনদিনের কাটানো সেই ট্যুরের অভিজ্ঞতাগুলো ডায়েরীবন্দী করে শেয়ার করছি তবে.. ২৩/০৫/০৩ : সকাল ৬.৩০টা বাজতেই তড়াক করে উঠে পড়লাম।

আর বিলম্ব নয়। আমাদের প্রথম গন্তব্য রংপুর। গ্রীন লাইনের বাসের টিকেট আগে থেকেই কাটা ছিলো। প্লানিং মোতাবেক আমাদের বিকালের মধ্যেই রংপুর পৌছানোর কথা। এরপর কিছু স্পট দেখার প্লান।

কিন্তু বিধি বাম। যে বাস ৭.৩০টায় ছাড়ার কথা তা ছাড়লো শেষে ১০টারও পরে! রংপুরে নতুন চালু করা এ রুটের বিলাসবহুল গ্রীন লাইন ভলভো বাসের সার্ভিস একদমই ভালো নয়। পথের মধ্যে বাস নষ্ট হলো তিন/চারবার। আমাদের রংপুর সদর পৌছাতে পৌছাতে ৭.৩০টা। শহরে তখন তুমুল বৃষ্টি।

আজকের দিনটা তবে হোটেলে বসে ফক্স ট্রাভেলার কিংবা ক্লাসিক ক্রিকেট ম্যাচ দেখেই কাটাতে হবে। আমরা উঠলাম জাহাজ কোম্পানীর মোড়ের গোল্ডেন টাওয়ার হোটেলে। এ মোড়টিই রংপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র। রাতের ভূরিভোজ সারলাম বৈশাখী রেষ্টুরেন্টে। গুডনাইট.. ২৪/০৫/০৩ : সকাল সকাল উঠে পড়লাম।

নাহ, আজকের আকাশটা ফকফকা। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। সকালের নাস্তা সেরে রিক্সায় শহরটা এক চক্কর মেরে সোজা চলে গেলাম কারমাইকেল কলেজে। ১৯১৬ সালে স্থাপিত দেশের এই প্রাচীন কলেজের নাম অনেকবার শুনেছি। এই প্রথম চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো।

কলেজের বাংলা বিভাগ আর মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যটা সতিই দেখার মতো। এখান থেকে সোজা রিক্সা নিয়ে তাজহাট জমিদার বাড়ি। সেদিন বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার ডেট থাকায় রিক্সা পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো। জমিদার বাড়ির গেট খুললো সকাল ১০টায়। এ বাড়িটির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় এটিকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নির্মাণ করেন।

এই রাজা ছিলেন হিন্দু এবং পেশায় একজন স্বর্ণকার। বলা হয়, তার মনোমুগ্ধকর 'তাজ' বা মুকুটের কারণেই এ এলাকা তাজহাট এবং প্রাসাদটি তাজহাট জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত হয়ে আসছে। চারতলা এ বাড়ির গঠনশৈলী অনেকটাই মুঘল স্থাপত্য থেকে অনুপ্রানিত। বাইরের পর্যটকের অনেকেই এটিকে মিনি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভেবে থাকলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পূর্বে এটি রংপুর হাইকোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ২০০৫ সাল থেকে এটিকে রংপুর জাদুঘর বানানো হয়।

জাদুঘরের ভেতরে নজর কাড়লো আদি রংপুরের কিছু সংবাদপত্র, আর বাড়ির ভেতরের ইন্টিরিয়র। এছাড়া পুরোন দেবদেবীর মূর্তি দেখতে পাবেন সেখানে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে মিউজিয়াম দেখা শেষ করে ও ফটোসেশন সেরে এরপর রওনা হলাম দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। বিদায় রংপুর। রংপুর ছাড়ার পথে গঞ্জিপুরে চোখে পড়োলো ‘ভিন্নজগত’ পিকনিক স্পট এর সাইনবোর্ড।

আগে থেকে এখানকার ছবি দেখে বিশেষ আগ্রহ বোধ করিনি বিধায় এই স্পটটা বাদ দিয়েছিলাম। আড়াই ঘন্টায় পৌছে গেলাম দিনাজপুর সদর। বাসস্ট্যান্ড নেমে চলে গেলাম শহরের প্রাণকেন্দ্র মালদহপট্টিতে। উঠলাম ‘ডায়মন্ড হোটেল – ১’ এ। বড় প্রাচীন একটা শহর।

এখানকার বাড়িঘর এমনকি খাবার হোটেলও প্রায় একশো বছরের পুরোন সব বিল্ডিং এর ভিতর চলছে। ক্লাসিক জিনিসে আমার বরাবরই ঝোক। বেশ ভালোই লাগলো ব্যাপারটা। দুপুরের খাবার স্থান ‘জীবন হোটেল’। এটিই পুরোন বাড়ির মধ্যে বানানো! আবারো চলে গেলাম বাসস্ট্যান্ড।

উঠে পড়লাম বীরগঞ্জের বাসে। আমাদের গন্তব্য কান্তজীউ মন্দির। কন্ট্রাকটারকে বলে দেয়ায় আমাদের ঠিক জায়গাতেই নামিয়ে দিলো সে। সেখান থেকে বাম দিকে কিলো দুয়েক হাটলেই নাকি মন্দিরটা। যে নদীটি পার হতে হয় তার নাম ঢেপা নদী।

এই নদীর উপর একটা ব্রীজ হচ্ছে বিধায় কোন রিক্সা/ভ্যানই যেতে চাইলোনা। আমাদের মৃতপ্রায় নদীটি পার হতে হলো বাশের সাঁকো দিয়ে। ব্রিজ পার হয়ে বালির উপর দিয়ে যখন হেটে যাচ্ছি তখন মনে হচ্ছিলো এত ঝক্কি সামলে ঠাঠা রোদ মাথায় নিয়ে কোন বিদেশী পর্যটকের দায় ঠেকেছে যে তারা এখানে আসতে যাবে! তা এখানে হাজার রত্নই থাকুকনা কেনো। আমাদের পর্যটনশিল্প বিকাশের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা কতটা কার্যকরী মনে বড় প্রশ্ন থেকে যায়। হা হুতাশ মনে নিয়ে যেই ঢুকলাম মন্দির প্রাঙ্গনে সেই মন থেকে রোদে পোড়ার সব কষ্ট একেবারে গন।

তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষন মন্দিরের সৌন্দর্য দেখে। সারাবিশ্বময় যতগুলো টেরাকোটার প্রাচীন নিদর্শন আছে এটি তার মধ্যে অন্যতম একটি। এই তথ্যটি যেমন নেট ঘেটে জেনেছি, চাক্ষুস দেখার পর হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। এ কান্তনগর সম্পর্কে বহু পৌরাণিক উপাখ্যান প্রচলিত আছে। গবেষক মেহরাব আলী বহু বছর এ মন্দিরের স্থাপনা নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তার গ্রন্থানুসারে এক মিথ্যা অভিযোগে সম্রাট আওরঙ্গজেব দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথকে তলব করেন। প্রাণনাথ মুঘল দরবারে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে রাজা উপাধি লাভ করেন। এ ঘটনায় তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বৃন্দাবনে যান। সেখান থেকে তিনি একটি কৃষ্ণবিগ্রহ লাভ করেন। এরপর প্রায় ৩ একর জায়গাজুড়ে কান্তজিউ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

তবে মন্দিরের পাশের ফলক থেকে জানা যায় ১৭০২ সালে দিনাজপুর অঞ্চলের মহারাজা প্রাণনাথ এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন । তাঁর ছেলে মহারাজা রামনাথ ১৭৫২ সালে এর নির্মাণ শেষ করেন । এটি একটি নবরত্ন মন্দির । পুর্বে মন্দিরের নয়টি চূড়া ছিল কারুকার্য শোভিত। কিন্তু ১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে নয়টি চূড়া ধ্বংস হয়ে যায়।

মন্দিরের মূলকাঠামোটি ৫২ বর্গফুট । সম্পূর্ণ পোড়ামাটির তৈরি কান্তজিউ মন্দিরে রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণ কাহিনী ও সম্রাট আকবরের কিছু বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে মন্দিরের বিভিন্ন টেরাকোটাচিত্রে প্রাচীন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার নানাবিধ চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৮৭১ সালের তোলা ছবিতে কান্তজিউ মন্দির। এতে মন্দিরের নয়টি কারুকার্য শোভিত চূড়া দেখা যাচ্ছে ঘন্টা খানিক এখানে কাটিয়ে মন্দিরের সৌন্দর্য উপভোগ থেকে নিজেকে শেষমেশ বিরত করে ফিরতি পথে গ্রামের ধারের এক চায়ের দোকানে খাঁটি গরুর দুধের চা খেলাম।

গ্রামের মেঠোপথের পাশে বসে চা খাওয়া। আহ, এমন স্নিগ্ধ অনুভূতি বহুদিন পাইনি। দিনাজপুর সদরে ঢুকেই সোজা গেলাম রাজবাড়িতে। বাড়ির ঢোকার গেটটা বেশ। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখলাম দেশের বাকী অধিকাংশ রাজবাড়ির মত এটিরও বেহাল দশা।

মাননীয় সরকার, পরিব্রাজক বানাইয়া দু-দন্ড মনের শান্তি দিলেনা ! রাতের ভূরিভোজ রুস্তম হোটেলে। এখানকার গরুর মাংশটা সারা দিনাজপুরখ্যাত। ২৫/০৫/০৩ : আমাদের ভ্রমনের আখেরী দিন। সকালে উঠে ক্লাসিক ধাঁচের আরেকটি পুরোন বাড়ির হোটেলে নাস্তা সেরে অটোরিক্সায় চেপে গেলাম রামসাগর। রামসাগর কোন সাগর নয়, এটি আকার ও সৌন্দয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় দীঘি ! বরিশালের দূর্গাসাগর, কুমিল্লার ধর্মসাগর, দিনাজপুরের ধর্মসাগর।

এ দেশ যেন সাগরে সাগরে একাকার। :p বিশাল এই দীঘিতে অটোরিক্সা চেপেই পুরোটা চক্কর মারতে সময় লাগলো প্রায় আধঘন্টা ! কত বড় দীঘিরে বাবা ! মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। কান্তজীউ মন্দির এবং ধর্মসাগর উভয়েরই নির্মাতাই মহারাজা রামনাথ। এটির নির্মানকাল ১৭৫০-১৭৫৫ সাল। এ অঞ্চলে প্রচন্ড খরা ও দুর্ভিক্ষ চলছিল ‌এবং রাজা রামনাথ "কাজের বিনিময়ে খাদ্য" কর্মসূচীর মাধ্যমে মানুষদের সাহায্য করেন এবং দীঘিটি খনন করান।

এতে প্রায় ১৫ লক্ষ শ্রমিক অংশ নেয় এবং সেসময়ের মূদ্রায় মোট ব্যয় দাড়ায় ৩০,০০০ টাকা। লিচুর মৌসুম চলছে, আর লিচুর স্বর্গরাজ্যে এসে লিচু না নিয়ে গেলে চলে। দিনাজপুর শহরের সদর থানার পাশের সবচেয়ে বড় লিচু মার্কেটে প্রমান সাইজের কয়েক গন্ডা লিচু সমেত দিনাজপুর পরিত্যাগ করলাম। পরবর্তী গন্তব্য বগুড়া। বাসে সময় নিলো ৪ ঘন্টা।

আমরা নামলাম বগুড়া সদরের আগে মহাস্থান নামক এলাকায়। এখান থেকে কিছুদুর রিক্সায় গেলেই মহাস্থানগড়। দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম এখানেই। সাথে বগুড়ার দেশখ্যাত ‘দই’ দিয়ে এলাকার আমেজ ধারন করলাম। প্রথমেই ঢুকলাম মহাস্থান জাদুঘরে।

জাদুঘরের সংগ্রহ বেশ সমৃদ্ধ। হিন্দু দেবতা সূর্যর কালোপাথরের মূর্তির আধিক্য চোখে পড়লো সেখানে। এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। এখানে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন সাম্রাজ্যের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশ নিদর্শনই যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

আর আছে প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগরের ম্যাপ। এরপর গেলাম জিয়ত কুন্ডে। এটি পুর্বে একটি গভীর কূপ ছিলো। এটির সম্পর্কে একটা মজার প্রবাদ প্রচলিত আছে। বলা হয়, শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়ারের ( এ অঞ্চলে মুসলিম শাষন প্রতিষ্ঠাকারী) সঙ্গে যুদ্ধের সময় পরশুরাম এ কূপের পানির সাহায্যে মৃত সৈনিকদের পূনজীবিত করতে পারতেন, শাহ সুলতান কূপটির অলৌকিক ক্ষমতা জানতে পেরে একটি চিলের সাহায্যে এক টুকরা গো-মাংশ নিক্ষেপ করেন।

এতে কূপটির অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়! সত্যি, সে যুগের রাজারা পারতোও বটে! এরপর দেখলাম শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়ারের মাজার এবং সর্বশেষে বেহুলার বাসর ঘর। এই বেহুলা লক্ষীন্দরের কাহিনী সবাইকে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রাচীন বাংলার সুবিখ্যাত মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গলের প্রধান দুই চরিত্র বেহুলা লক্ষীন্দরের কথিত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বাসরঘর এটি। যদিও এতে শেষরক্ষা হয়নি, কাহিনী এমনটিই বলে। মহাস্থানগড়ের বিখ্যাত কটকটি চিবাতে চিবাতে পথ ধরলাম বগুড়া সদরের।

ঠনঠনিয়ায় নেমে ঢাকায় ফেরার বাসের টিকেট কেটে নিয়ে বগুড়া শহর ঘুরতে বেরুলাম। সত্যি, শহরটা বেশ উন্নত। ইমপ্রেসিভ ! রাতের খাবার খেলাম শহরের বিখ্যাত হোটেল আকবারিয়া’তে। এখানকার প্রত্যেকটি আইটেমই লা জবাব। ঘড়িতে রাত ১২টা।

ঢাকার বাসে চড়ে বসলাম। বাসে এসির আমেজে গায়ে ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে ভাবতে লাগলাম গত তিনদিনের কথা, আর বিড়বিড় করে বললাম... উত্তরবঙ্গ, আবার দেখা হবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.