আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিয়াস মজিদের কবিতা

বিস্মৃতি ও বিষাদটিলা

পিয়াস মজিদ আমাদের সময়ের কবি। তার অর্ন্তমুখী স্বভাব শৈশব থেকে এই পর্যন্ত তাকে ভয়ংকর একাকীত্বের মুখোমুখি করিয়েছে । বোধহয়, এই নৈঃসঙ্গ্যই তাকে দিয়ে রচনা করিয়ে নিয়েছিল এমন কিছু কবিতা যা একজন পাঠক হিশেবে আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করেছে। সে কারণেই তার কবিতাগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাওয়া। আশা করবো কবিতাগুলো আপনাদেরও বিস্মিত করবে।

- তারিক টুকু মার্বেল ফলের মৌসুম পিয়াস মজিদ ১. ছোট নদী পাহাড় বাগিচা রক্তের নির্ঝর। পাতা ও পাপড়ির অলিন্দ। সন্ধ্যার ঝিলিমিলি তারপর সমুদ্রকুহক; জলের বিষণœ রেখা। শ্যাওলার সবুজ গন্ডোলা। চাঁদচূর্ণ ছিটকে ছিটকে ভৌতিক আভা, নক্ষত্রক্ষত, মেঘমালার গোপন অসুখ।

মৃত্যু ও সুন্দরের যুগলবন্দি। লেট দেয়ার বি লাইট, লেট দেয়ার বি ডার্ক। জীবনের জটিল সারগাম। ধাতব ফুলের তোড়ায় তোমাকে অভিবাদন। বেঁচে থাকার এই রিক্যুয়াম, সোনাটায়।

২. পরিরা পিরিচে ঢেলে দিচ্ছে হিংস্র আলোর দ্যুতি। দৈত্যের ওপর লালগোলাপের ভার। যাদুদগ্ধ রাতের পোড়া ডানাকুলে ঋষিসমুদ্রের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে; নিখিলে নিখিলে কামজোয়ারের শ্যামজল। মারবেল ফলের মৌসুম শেষে শুষ্ক বাগিচা ঘুরে কুড়িয়েছি সান্ধ্যকুয়াশা, মৃত্যুসংকেত, ব্যাথার নিলাভ ঘূর্ণি। আড়ালে থেকে এই ধ্বংসদৃশ্য সায় দিয়ে গেছে সুবর্ণসিংহ এবং হিরাহরিণের দল।

কাকলিসমেত উড়ে গেল পাখি; তার পালকের খাপে পোরা রক্তঝোরা। আর সবুজ লণ্ঠনে দেখা যায় আজকের এই খুন, আয়রনি সব রূপহারা রাজহাঁসের নিরুপম কবর। ৩. চন্দ্রমন্থণের রাত আবার। খয়েরি খেলায় নীল নিমজ্জন শুধু। বুদ্ধগয়ার পথে হিংসাসূর্যের বিভা।

নরকের ফুল আছে গাছে। রক্তাভ উষার এলোচুল চুঁইয়ে তিক্ত সুরভি ঝরে । ডানে ত্রসরেণু, বায়ে পাপের ত্রিভুজ। সেদিকেই মৃত্যুময়ূর পেখম খুলে দেখায় খাঁজকাটা পরমের গুপ্তজ্ঞান। আমরা মূর্খদের রাজাপ্রজা পিশাচস্রোত ঠেলে উদ্ধার করি বিক্ষত সমুদ্রকণ্ঠা।

৪. শ্রীময় বসুধার উপর গ্রহণলাগা তপনের ভার। তারা আছে ঝিলমিল। তপন ও তারার সংঘাতে জ্বলছি । পাহাড় ভেঙ্গে টিলাপাখি ছুটেছে । কোথায় সে তিক্ত গোলাপের ঝাড়, পালকছেঁড়া নীল রাজহাঁস? হিমকুঠারের কোমল ঘায়ে যুগল গলছে করোটি ও কণ্ঠা।

সকালশেষে সহস্র সন্ধ্যা পায়ে পায়ে ঢুকেছে গান্ধর্ব ঝড়ে। মৃত্যু তোমার অমল রাগে আবার অজস্র তারা ও তপন। জ্বলে নিভে, ছড়ায় রক্তশোভা। ৫. এ নিশিপাওয়া প্রভাত। শূন্যে শুরু, শূন্যেই শেষ খাতার যত জটিল অঙ্ক।

পথে পথে স্বর্ণবেশ্যা ছিটিয়ে রেখেছে শুভতার জাল। লণ্ঠন জ্বেলে দেখা হবে জ্যান্ত-মরা বিকেল সকল। ঝিনুকচেরা লাবণি সহযোগে নৈশভোজ আজ। সমুদ্র কুপিয়ে পাই প্রকৃত জলতনু। হাতে পায়ে সীল, তিমি, হাঙ্গর প্রহার।

হিমশুশ্র“ষায় সে তখনো নিশি। প্রভাতে নতজানু সামান্য নিশি। ৬. তারাব্যাধ পেতেছে ফাঁদ। অনন্ত রাতের গাঢ়-তমস ফাঁদ। খুনবীথির বিজন বনে খরজলের ঝিল।

ঝিল জুড়ে মৃত্যুমুখর অজস্র শৈবাল। পুষ্পপ্রহারে হিমের পোশাক খসে গেছে। চারদিকে উঁচুনিচু রক্তরেণুর পাহাড়। এতসব হাওয়া; কোমল ঋষভ! উড়ে-পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হবে আজ। বীণা ভেঙে তুমি যদি ব্যাথার দুয়েকটা মঞ্জুল বাজনা... ৭. জলআঁধারে আলো নেমে গেল রাজহংস রূপে ।

মুক্তাপ¬াবনে ভেসে যাবে মধ্যরজনী গান। পিছে রেখে পারুলবন ফুটেছে থোকা থোকা রোদনের ফুল। হাওয়াও আজ হন্তারক। নিরঞ্জন নদীতে ধ্র“পদ, খেয়াল আর যত মিথুন। সুরের শত্র“ যে মেয়ে তারও হাতে বেলোয়ারি চুড়ি।

ক্ষণপ্রভা তারার নীলিমা দেখে নিদ্রা ভুলে এক অসুখী যুবা নির্বিকার গড়ে যাচ্ছে তাসের পাহাড়। কি সব অলংকারে রাতের গলায় অমিতাভ মৃত্যুর হার। ৮. এ সকাল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় । শৈবাল ঝড়ে চুরমার রূপালি হরিৎ কাচের পাখির গান। নগ্নদিগন্ত বাজায় সূর্যবেহালা।

লতাপাতার দেয়ালি জ্বেলে দাঁড়িয়েছ দেবদারু। সোনার কানন পুড়ে যায় তাতে। রজতের ছাই হয়ে ময়ূরীর নাচ অশেষ। খুলবে এবার সংবর্ত ব্যাথার পালক। অরণ্যসমুদ্র সবাই শুনবে নিশিথ প্রহার শেষে কি সুরে কাঁদে কূলহারা চাঁদ।

৯. ‘চাই আরোগ্য’ বলে মৃত্যুসদনে ভিড় করেছে সবাই-পরিযায়ী পাখি, মুকুটখসা রানী কিংবা নামহারা পতঙ্গ কোন। শেষ শ্রাবণের জলগুলো শীতের ভেলায় । দূরের লুণ্ঠনধারায় মাধবীর হৃত যত শ্বাস। তাকে ঘিরে গান হয়, ভোরে মেশে রজনী। অমাশেষে শুরু আরো এক হিরণ্যদুপুর।

কঠিন শিলায় গোলাপ তোমার কোমল গুপ্তঘাত। ঝিলিমিলি খোলা নিঝুম সন্ধ্যা; আগে পিছে কিছু কামুক সিদ্ধার্থ। আরোগ্য পড়ে থাকে । সূর্যাস্ত দেখার ছলে শশী ছুটে যায় মৃত্যুকুসুমটিলায়। ১০. সোনার পাহাড় থেকে দেখা যায় জটাময় চাঁদ।

বজ্রবৃক্ষের গলায় যখন নৃমুণ্ডের মালা। রক্তভাসানে সাত ভুবনের লতাপাতা, সমুদ্রচুল আর রূপালি যত রূপকের ভার। টিকলিপড়া মেয়ে উর্মিজন্ম পেয়ে ছুটে যায় মায়ামোহনায়। তার নাচের করাতে গলে গুপ্তপারদ। রাত্রিপ্রহারে বেঁকে যাওয়া ভোরের কণ্ঠে মরচে পড়া জ্যোৎস্নার ইতিকথা যত।

আর এমন হেমন্ত, বিকেলের এত মন্দাক্রান্তা ঢেউ তবু দেখো মীরা, অগ্নিরতেœ পুড়ছে কেমন তোমার ভজন। ১১. স্থিরস্রোতা সমুদ্রে ডুবেছ রাগবন্দেশ তুমি। আছি তোমার শুরু ও শেষের ঝনৎকারে। জনম থেকে জনমের মৃত্যুকলে¬াল। হরণের হাওয়া হয়ে ডুবেছি চাঁদ, সূর্য থাকে দর্শক।

কিংবা কোথাও লুকিয়ে খুলে দেয় শৈলবাসের দ্বার। তারপর তরুশীর্ষে জাগে নাটমন্দির এক। বিপুল নাদে শুষে ফেলে সে ধীর যত সমুদ্রঢেউ। তবু আহত গানের ব্যাথায় তুমি আর জোড়া লাগো না, পথপ্রান্তে পড়ে আছ ছিন্নভিন্ন সুর। ১২. কালো তীব্র তরণীতে শ্যামঝিল চলেছে।

সামনে হিমঘুঙুরের গোপন প্রদেশ। দিগন্ত ঝেঁপে নামে কাবেরিঝড়। ভোরের ঘন্টা ভেঙ্গে পাহাড়ে পড়েছে। পাহাড় আজ সুর। মেঘমেঘালিতে সুরের আজ লোপ।

বত্রিশ বাগিচা ঘুরে হাতে হাতে কেয়া আর চাঁদের পাতা। শেফালির সাথে ঝরেছে সূর্য। তারপর সোনালি তরল, রূপারঙ চুল। অনামিকায় পড়েছি নীলাভ তিমির তোমার। ১৩. ফেটেছে বরফ টিলা।

এবার শেষøান নটরাজ। চন্দ্রপ্রপাতে ভেসে যাওয়া কফিন ওফেলিয়ার। স্থিরবিজুরি আকাশে; সামনে সমুদ্রবিষ, মৃত্যুসৈকত, ড্রাগনের ঢেউ। বিচূর্ণ সব রাতের পাষাণ। হৃদফোয়ারার জলে তোমার ত্রিবেণী রূপের জনম।

ডুমুর পাতার পোষাক খুলে এই যে আদি নাচ। নীলিমাভুক মুদ্রার ভোর। ১৪. তারার ছুরি। নীলিমাকঙ্কাল। আত্মার অন্ধকার থেকে দীপজ্ঞান আসে।

তাকে তুলে নিয়ে গয়না নাও আজ প্রজ্ঞাপরম। খরজল কেটে কুটে সোনারু, রূপারু। সন্ধ্যাফুলের কনকআভায় শতধারা নাচ। রক্ততরঙ্গে আছি- নিরশ্র“ লোবান, সজল ধূপ। প্রহর সমাগত-খুনের শ্রী, সুরভির মর্গ, নীলিমাখনক।

ভূমিতে ঝড়; সমুদ্রতারার। ১৫. রক্ততিমি গিলে খায় সমুদ্র। হাতে পায়ে লাল নীল আর্ত জল। হিমচাঁপাস্রোতে ছিল নিঃস্ব নভেম্বর,পুলকখণ্ড আর মৃত্যুসহস্র। এই প্রথম রুদ্ধদামিনী মেলে দিল ডানা যখন শেষ শরতের সব পাষাণ পুষ্প কোমলে -ঋষভে ভাঙছে পোড়া পান্নার দগ্ধতনু।

পাতালপরিখার অসুখ ছুঁয়ে চলেছি শীর্ষসুখে। সন্ধ্যা হে, পূরবী গেঁথে গেঁথে এবার তমসতনু নিশীথের গান। ১৬. আজও তার গুপ্তপথে রক্তের অমোচন দাগ। না চাইলেও সেদিকে গেছে জোড়া জোড়া শিকারী চোখ। কিন্তু লালসা চূর্ণ করে গোলাপের বিকিরণ শুধু।

আর স্বচ্ছ দেখা যায় ভোরের ভেতর সহস্র ধ্বংস, রাতের গভীরে কিছু বহুগামী তারা। এই মেয়ের তমস্রোতেই তপোবন, প্রমোদকানন। তুষারের তীব্র সাদা বেণী বেঁধে রিক্তহাত বসে আছি। পা থেকে ঝরেছে নাচ। মেয়ে, একটু জায়গা করে দাও।

সমস্ত সুবাস খুইয়ে নিঃস্ব দাঁড়িয়েছি তোমার গুপ্তপথে। ১৭. মৃত্যুমেখলা নদী-বুদ্ধপ্রণাম ভেসে চলে হিংসাজলে। ঐ তো চূড়া, দেবীর পাহাড়। সকাল ও সন্ধ্যার শুদ্ধ অমল শে¬াক। নম্রধীরে পুড়ে যাও প্রিয় রাগিনী সব।

এখন এতশত হাসি কান্নার ছাই। রাজেশ্বরীর পথে ঘাটে আমাদের ভাগ হয়ে যাওয়া হর্ষহল¬াবিষাদ। একা এক খঞ্জনার আর্তিতে ফোটে সবুজ পাতার বাহার। তারপর লক্ষ গণ্ডারের নিযুতস্রোত খুবলে খাবলে খায় দেবীর পাহাড়। নাশযজ্ঞ ফুরোলে নদীতে থাকে পাহাড়পোড়া আলো।

১৮. সমুদ্র শুয়ে আছে, আমার হাতে তার তরঙ্গের ধার। মুখের ভেতর চিত্রল সব উদ্ভিদের বাগান। হিমানির গুহা অনেক দূর। তার শীতল গায়ে এই শীতরাতেও জ্বলে ওঠে লালনীলসোনালি অজস্র আগুন। দশদিক থেকে প্রতœচোরেরা জড়ো হয় তাদের গুঢ় অভিসন্ধিসহ।

ওদিকে আবার শুরু ব¬্যাকহোলের সেই মরণনাচ। আর আমরা ছুটতে থাকি প্যারানয়েড মেয়ের পিছে এবং বিকেল পাঁচটার হাওয়াও এসে সায় দেয় আমাদের । তারপর কবরখানার মৃতরা, পানশালার মাতালেরা মিলেঝিলে রাতারাতি এক উৎকল্পনার মাঠ। সমুদ্রের শয়নভঙ্গি কুয়াশায় পুড়ে যায়। ১৯. ওই রহস্যটিলার ধারে তারার আশ্রম।

দিগন্তপতনের রাত; হাতে হাতে মধুর কৃপাণ। পাখির ডানাস্রোতে রাক্ষসেরও রক্ত ছিল। দক্ষিণের দিকে ক্রুশের ঝড়। পরির সজল হাড় গুহাগর্ভে; রজতরশ্মি হয়ে সে আজ দশরকম ফুলে লীন। মৃত সুবাসের কণিকায় তুমি তবে বিষকুম্ভ।

নুড়ির নৃত্যে ফোটে চাঁদপনা সূর্য। দিগন্তপতন শেষ; ফিরে ফিরে ফুলের বাহার আর নাচের সুবাস। ২০. ঘুরে ঘুরে আবার রক্তকেলির মৌসুম। জহরত স্রোতে ভেসে এসেছে আফ্রোদিতির কঙ্কাল, লিথির হাড়। পেছনে কতশত কনফেশনের কাল, জবাকুসুমের জঙ্গল, চিত্রলেখা ভোর।

আরোগ্যের অধিক মৃত্যুনিকেতন। দশতলা টাওয়ারে ছাতিমবন পেরিয়ে এসেছে সুবর্ণসিংহ। ঘাসপাতার সবুজ সিম্ফনি মধুবাজার ভেঙেচুরে ঢুকে গেছে সন্ধ্যার দেরাজে, কার্ণিশে। নরকের ক্বাসিদা গাইতে গাইতে সাজিয়ে ফেলছি আমার কফিন। দূরে দু’ফালি করে কাটা সমুদ্র; তোমার জন্যে বিভক্ত জলভাষা।

২১. সেরেনাদ রোদের । বজ্রের ডাইরি জুড়ে মেঘের গর্জন। কাছে কোথাও সমুদ্র ছিঁড়েখুড়ে মধ্যভোরের হাওয়া। খয়েরি পাতার স্তুপে পরীর গোলাপি পদচ্ছাপ। লক্ষ বছরের ঠাণ্ডা কফিন ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছ তুমি রূপসী খুনি।

দ্বিধার মুদ্রা গেছে খসে, অন্ধকারের পরোয়ানা দু’হাতে। এমন তোমার প্রবেশ; সবুজ বনভূমে যেন কিছু গোপন কুঠার। তারপর বুনো চাঁপার চিতা, সুগন্ধি ছাই আর উড়ন্ত মাধুরী কণা। রোদ না মেঘÑ কে পাঠক এই রক্তভাষার? ২২. চাঁদমারি, মেঘদল, স্বর্ণধূলো বায়ে রেখে ছুটছিলাম পশ্চিমে; বালি জমে জমে যেখানে রতেœর কারুময় পাহাড়। লাল নীল মারবেলের স্তুপের পরেই পুষ্পলুণ্ঠকের দুর্গম গুহা।

ক্ষণগন্ধা বকুল, গোলাপের রক্তিম চুলি¬ আর চামেলিস্রোতে ডুবতে ডুবতে একটা ডুমুরের ডাল আঁকড়ে বেঁচে থাকলাম কয়েক অধিবর্ষ; সঙ্গে আমার সবুজ হলুদ ঘাতক যত। হু হু শোঁ শোঁ শব্দস্রোত চারদিকে। গর্জন করছে কে-বনঝাউ না সমুদ্র? ২৩. ছুরিবৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠি- ধারালো আপেলে দাঁত বসিয়ে মৃত্যুকে খাই। সংশয়ের স্রোতে ভেসে ভেসে পৌঁছে যাওয়া সেই দ্বীপে যেখানে নিরক্ত প্রেম আর রক্তাক্ত পাথরের স্তুপ। মেঘমল¬ার রাগে রাজকুমারীর গোপন প্রত্যঙ্গ শুকিয়ে আসে।

সন্ধ্যার শ্বাসমূলে-লাইটহাউসে, জলের গভিরে- মাছের মহলে ঘুমিয়ে পড় তোমরা- লেডি ল্যাজারাস, হিংস্র ড্রাগন, মাতা মরিয়ম কিংবা স্মৃতিবকুল। তারপর আয়না-আত্মঘাতি চেহারা। দূরে বিষমাখা টিলা। কাঁটার মুকুট তো মাথায় আর ঐ যে আমার রাঙা চিতা। ২৪. রক্তাভ সমুদ্র।

ঝিনুক কুড়োতে গিয়ে সৈকতে খুঁজে পেলাম শত শত লিবিডো কঙ্কাল। কাছে কোন বনে, রহস্যসবুজে লেপ্টে গেছে নিষ্ঠুর এপ্রিল, গত জনমের গ¬ানিগাঁথা এবং তারাবিদ্ধ রাত। তীব্রগন্ধা কুরচি ফুল হাতে পাহাড় ডিঙিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন। যাদের আয়ু আটকে আছে চামেলির শুকনো পাপড়িতে। হাজারদুয়ারি মহল ছেড়ে চন্দ্রগ্রস্থ নর্তকীর দল ঢুকে পড়ল সাপের সভায়।

আর এরকম ধ্বংসরেখার সামনে বিষণœ শিল্পী; বাটিতে একফোঁটা রঙও নেই। ২৫. ফুটেছ এইমত তমসাকুসুম। আর সেই ডাকিনী খুলে দিয়েছে বিষের নির্ঝর। বাড়ি ফিরছি, কলসভরা সুধাজল । সাত সমুদ্র কোমল কাঁধে বয়ে নেবে শঙ্খধূলো, বালির ভাসান।

জটখোলা চৌষট্টি কলার পরিমাপে বাজাও তোমার গুপ্তসরোদ। তার পা বেয়ে গলায় উঠুক রক্তগুল্ম। লতাপাতা, চক্রে বাঁধো ওকে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব; দাও আমাকে হিংস্র দিগন্তজন্ম। ২৬. জ্যোৎøাধোয়া পেভমেন্টে রাক্ষুসীর পায়চারি; বাগিচায় ফুটেছে ফুল রক্তচাঁপা।

ঘুমের গভীরে শতজল ঝর্ণাধ্বনি আর লক্ষ গিগা অন্ধকার। নীল লেগুন থেকে মৃত্যুসুরভি বাতাসের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে মেঘের মহলে। উত্তরে যেওনা- জুলাইয়ের চব্বিশ, কাঁদছে ওফেলিয়া। দক্ষিণে যেওনা- সমুদ্রে শুয়ে আছে ক্ষতিকর ক্ষার। পশ্চিমে সত্যপোড়া ছাই- গগনে মিথ্যাময়ী শিখা।

পুবে ভূমণ্ডল ছেঁড়াখোড়া- এইমাত্র কবরে নামল পাতাবাহারের লাশ। দূরে বুনো অর্কিড; কণ্ঠে সং অফ সলোমন। ২৭. ঈগল বাজাচ্ছে পিয়ানো। আমার দিকে ধেয়ে আসছে ক্রুদ্ধ কিছু গোলাপ। নাচের শিক্ষিকা শীতনিদ্রায়; রাতটা তার ঘুমন্ত মুদ্রার পাহারাদার।

অনেক দূরে রেশম ও বালিময় অধিত্যকায় হস্তমৈথুন, সফল সঙ্গম কিংবা জাতকের গল্পরা অপেক্ষা করছে- কবে আসবে প্রার্থিত পাঠক? বর্ণগন্ধ নেই এমন সব ঝরা বকুলে মাঠের পর মাঠ ডুবে থই থই। হিংস্র এক পরি রক্তকাঁটার ঝোপ থেকে স্বর্ণছুরি নিয়ে ছুটছে কোথায়? নিহত নদীটা মিলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রস্রোতে। ২৮. ঐ ঘরে যাদুভষ্ম। ছাইয়ে অঙ্গারে স্বর্গ স্ট্রিট, নরক লেন। দরজাটা খুলে কে ঢুকল? পাপ ও পূণ্যের সওদাগর।

আজ রাতেই বসবে তোমাদের লাভালাভের মুশায়েরা। বাইরে কামিনী আর নিশীথ-হাওয়ার ঝাড়। গন্ধের লোভে জীবনানন্দের ট্রাঙ্ক ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে উৎপলা, মাল্যবান। ২৯. যেদিকে কসাইখানা সেদিকেই ফুলের দোকান। রক্ত আর পাপড়ির পাহাড়।

প্রতিদিন ওদিকে যাই। ব্যাগ ভরে কিনে আনি মাংস ও গোলাপ। খবরের কাগজে একদিন নন্দীগ্রাম, একদিন কুইন্সপার্ক। কিন্তু আমি রোজ মাংস খাচ্ছি, গোলাপের গন্ধ শুঁকছি। গোলাপে মাংসে সফল হচ্ছে মানবজীবন।

৩০. এই বর্ষার অপরিণামী হাওয়া; ঝুম ঝুম জলের ঘুঙুর। আধডোবা সবুজের আড়ালে একরাশ ধূসর সাম্পান। এত এত অপমৃত্যুর খসড়া জমেছেÑকায়রোর সরাইখানাও সে শোকে নীল হয়ে আছে। দেবীর রূপের আগুনে ডাইনির রতির পালক। আমার বুক চিরে খঞ্জর।

খঞ্জরের গা বেয়ে রক্ত। রক্তের লালে তুমি ও তোমার কোমলগান্ধার। ৩১. দুঃখের ভারে ধ্বসে পড়ছে পাহাড় আর আমি হোটেলকক্ষে বসে শুনি অন্ধকার সমুদ্রগর্জন। চোখ বলে যা ছিল তা খুলে টুলে রেখে আসছি জলের প্রান্তে। সিÑবীচে বসেছ মেয়ে তুমি আর পড়ে যাচ্ছ নরকের দিনলিপি।

কিন্তু তোমার রোদচশমায় বিন্দু বিন্দু হীরকতুষার। এসবই নেপথ্যে রেখে পাহাড়চূড়া, সমুদ্রতট ছিন্ন করে একে একে বেরুতে লাগল সা রে গা মা পা ধা নি সা, চমনবাহার আর বুনো যত ফুল। সন্ধ্যার শ্বাসমূলও নড়েচড়ে ওঠে একটু, ঝড়ের চিরকূট হাতে পৃথিবীতে ধেয়ে আসে আরও একটি রাত। ৩২. পাথরের পেয়ালায় গণিতশ্রেষ্ঠার রক্ত পুরে ভাবছিলাম সূর্যক্ষতের কথা। মালির অজান্তে কত নষ্ট গোলাপে ভরে ওঠো বাগান।

তার কাঁটা ও সুরভির রেখা ধরে জন্ম নেয় আমার ঝুলন্ত চিতা। রোদের অনেক ছায়াবাজি খেলা শেষে আকাশ কিছুটা একা হলে মিনার্ভা তোমার প্যাঁচার উড়াল। চাঁদের চোরাবালিতে পা ডুবিয়ে ভুলে যেতে থাকব কোন এক সূর্যের গল্প। গণিতশ্রেষ্ঠা মিলিয়ে যাবে গানের øিগ্ধ ছায়ায়। ৩৩. ভোর হতে না হতে একে একে জড়ো হল প্যান্ডোরার বাক্স, রুগ্ন ভেড়ার পাল, মৃত ঘাসফুল।

পৃথিবীর ্এইরকম ধাতব আবহাওয়া; দুপুর না গড়াতেই সিন্দুকে গুপ্ত প্রেমিকের লিপ্সা। ছায়াবীথি পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলে রক্ততরূর বনে আগুন দাউ দাউ। লাল ছাইয়ে ছেয়েছে নীলবর্ণ আকাশ। রাত হয়ে আসল,জলসাও শেষ। হাত পা বিঁধে আছে কোমল কিছু সুরের কণায়।

তোমার গানে গানে জেগেছিল মলিন রঙিন এতসব দৃশ্য। এখন আবার সেই রিক্তশ্বাস। দৃশ্যহীন জলসা ঘরে রাতের পর রাত। ৩৪. তোমার গোপন কুঠার ভেদ করে চলে গেছে গোলাপের হৃৎপিণ্ড। যখন রূপের ক্ষুধা নিয়ে গাছে ঘুমুচ্ছে কাঠবেড়ালি।

গেল রাতে সেই ডাকিনী মায়ার খেলায় এক হাড়িতে চড়িয়েছে সাপের ডিম, কচ্ছপের মুণ্ডু, গণ্ডারের চামড়া। রান্নার ভুতুড়ে গন্ধ স্বপ্নেও হানা দিল। যুদ্ধ শিবির, আব্রাহাম, বিপাশা, দেবযানি, কচে ভরে উঠেছে ব্যক্তিগত ড্রয়িং খাতা। কুয়াশার কারণে হয়নি একখন্ড মেঘের নির্মাণ। ৩৫. আমাদের জন্যে ছিল দশায় পাওয়া কিংবা মখমলশয্যা।

এর কোনটা না নিয়ে লাল আপেলের বন পেরিয়ে ক্রমশ ঢুকে পড়েছি খয়েরি ফিরোজা ফুলেদের সভায়। পেলব অন্ধকারের বুক চিরে যেখানে জ্বলছিল কিছু নিষ্ঠুর মোমবাতি। বাতাসের শিরায় শিরায় মুদ্রিত দেখলাম নীলকুঠারের গল্প। অল্প দূরে অপূর্ণা হৃদ আর সেটা ছিল সিডার বৃক্ষ পতনের রাত। নূরজাহান, তোমার সুরের বাগিচা ডানে রেখে সামনে যেতেই জড়িয়ে গেলাম সেই প্রেতিনীর চুলের জটে; তার চোখের কাঠামো থেকে পায়ের পাতায়।

মলিন তারাভর্তি অনেক সিন্দুক নিয়ে সে যাত্রা বাড়ি ফিরলাম। ৩৬. টিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবেনা শশী। কুসুম গায়ে মাখবে না ফাল্গুনের বৃষ্টি। সাপেরা ছুটছে অরণ্যের সেই অংশে, ফুল যেদিকে ফণা বাড়িয়ে আছে। দক্ষিণের খুনি হাওয়া হল¬া করতে করতে ধাওয়া করল যাকে পায়ের ছাপে সে রেখে গেছে মানুষ ও জন্তুর ব্যবহৃত বিবর্ণ জীবনের ধুলো।

রেখা আর রঙের কাটাকুটিতে তাকে আহত হরিণ নাম দিয়ে গেল ফ্রিদা কাহলো বলে এক পাগলি মেয়ে। ৩৭. তরী ও তীরে কালো কবুতরের ঝাঁক, মৃত মধ্যমার হাড়। ও লোমশ তারা, তোমার হিংস্র বিভায় অনুগত ভৃত্যের মত করে যাচ্ছি মৃত্যু ও মেঘের কারুকাজ। আমাকে সায় দিয়েছে বহুগামী দেব, সমকামী পরি। আর কে একজন কুয়াশার মুন্ডু হাতে ফেরি করে বেড়াচ্ছে ছিন্নভিন্ন বসন্তের বার্তা।

দূরে ক্যাথিড্রালের ঘন্টাধ্বনি; আরো আড়ালে রূপালি দানবের কান্না। ৩৮. শ্যামাপাখি ডাকছে প্রেতঝরনার দিকে। খরতর ঢেউ নিয়ে বসে আছ শান্ত সাগর। তোমার তলদেশে মৃত্যুমৃণাল, সেবাদাসির সাজঘর আর অনেক অনেক সবুজ পাথর। কারো ঘুমের কাছে আমার জাগরণবেলা, বোবা-বধির ফাল্গুনহাওয়া।

ফণিমনসার ঝোপে মাতাল জিরাফের সিমেট্রি ঘিরে বেজেছিল যে রক্তবীণা তার দু'ফোঁটা একফোঁটায় ডুবে যাচ্ছে আজ সমস্ত স্বর্গসরণী, নরকপ্রান্তর। ভোরের খাতা নিয়ে বসে আছি; পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় দিপালি ও অমারাতের অজস্র লীলাভাষ্য। ৩৯. গোলাপের লাল অন্ধকার থেকে তুমি কতদূর মৃত্যুর শিখর? লক্ষ লক্ষ বিপন্ন নক্ষত্রের জানা আছে পিরানহা, প্রেমিকা ও মাতা মেরির ঠিকানা। যখন জন্মান্ধ যুবরাজকে ঘিরে নৃত্যপর ধানফুল, মধুমাছি, রূপালি রাক্ষস। মেয়েদের পায়ে পায়ে সোনা হীরার শৃঙ্খল।

সুকৃষ্ণ রাত খুলে ফেলেছে তার পোশাকআশাক। কয়েকটা ন্যাড়া শিমুলগাছ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে দূর মাঠে মৃত হিমের সৎকার। ৪০. গন্ধবণিকের মহল্ল¬া ছেড়ে তুমি বারবার ঢুকে পড়ছ বাদাম বাগানে। খুলবে যেন রহস্যের রেশমি সব গিঁট। আর অতিকায় দেব এক সুরের পাহাড়টা মাথায় করে এনে রাখল নক্ষত্ররঙ পরির পায়ে।

পুড়ছে বনকুসুম, বইছে হিমহাওয়া। খোলা থাকছে চব্বিশ ঘন্টা আপেল এবং মৃত্যুবিতান। শিলাস্তর থেকে মেঘের মিনারে কারা বসিয়েছে এত এত খুলি ও হাড়ের পূজা! কাছে অন্ধকার নদী, দূরের পেভমেন্টে স্বর্ণটিপ পড়া প্রেতিনীর দল। চিত্রল ছুরি হাতে তারা সব চলেছে কোথায়? আমারও যে চাই রক্তিম সুরভির ভাগ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.