অথৈ তন্দ্রার ঢেউ
স্বপ্নে কোন রঙ থাকে না
মইনুল হাসান অফিস থেকে ফিরলো ভয়াবহ মাথা ব্যথা নিয়ে। সে বেশ ভারী একটা চশমা ব্যবহার করে, মাঝে মাঝেই তার মাথাব্যথাও ওঠে। কিন্তু এরকম তীব্র ব্যথা এর আগে কখনো উঠেছে বলে তার মনে পড়ে না। দুপুরের পর থেকেই ব্যথা করা শুরু হয়েছিলো, পরে ক্রমে তীব্রতর হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অফিস ছুটি হওয়ার বেশ আগেই বের হতে বাধ্য হলো।
ফেরার পথে চোখ খুলে রাখতে পারছিল না মইনুল হাসান, বিল্ডিং আর রাস্তাগুলোকে মনে হচ্ছিল দালির আঁকা সুররিয়াল ছবি- যেন একটার সঙ্গে আরেকটা লেপ্টে যাচ্ছে। বাসায় ফিরেই দুটো ট্রিপটিন খেয়ে শোবার ঘরের দরোজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো সে। যখন ওষুধের কল্যানে ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে তখনো সমস্ত মস্তিষ্কে বোতলবন্দী দৈত্যের মতো ব্যথা তড়পাচ্ছে।
বাবা! বাবা!
ছোট মেয়ে তিয়ার কণ্ঠস্বর। ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী অবস্থানেও চিনতে পারে হাসান।
আর কাঁধে ছোট্ট দুটি হাতের মৃদু ধাক্কাও অনুভব করে।
বাবা, ভাত খাবা না? ওঠো। খেয়ে আবার ঘুমাও।
ভুরু কোঁচকানো অবস্থায় চোখ মেলে মইনুল হাসান। ব্যথাটা আর নেই, মাথা কেমন শূণ্য শূণ্য লাগে।
পুরো ঘর অন্ধকার। তেমন কিছু দেখা যায় না তবে খুব অবচেতনে বুঝতে পারে কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে, কি যেন বদলে গেছে।
লাইটটা জ্বালা তো।
হঠাৎ তীব্র আলোর ধাক্কায় চোখ বন্ধ হয়ে যায়। একটু পরেই চোখ খোলে হাসান।
এবং আবার বন্ধ করে ফেলে। এবার আতঙ্কে।
আতঙ্কের কারন চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মইনুল হাসান দুটি আশ্চর্য ঘটনার মুখোমুখি হয়। এক. সে চশমা ছাড়াই সবকিছু খুব পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে আর দুই. সে সবকিছু দেখছে সাদা আর কালো; সাদাকালো টেলিভিশনে যেরকম দেখা যায় সেরকম। প্রথম ব্যাপারটি মূলত সুখপ্রদ ঘটনা হলেও দ্বিতীয় ঘটনাটি তার কাছে এতোটাই ভীতিজনক একটা অভিজ্ঞতা হিসেবে আসে যে প্রথমটা সে সামন্যতম খেয়ালও করতে পারে না।
হাসান চোখ রগড়ায়, আবার তাকায়, চোখের পাতা বারবার খোলে আর বন্ধ করে, মাথার দুপাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে এবং আরো নানা কসরত করে এবং শেষ পর্যন্ত কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে থাকে। মেয়ে তখনো তাকে ডাকাডাকি করে যাচ্ছে, মা তার সাথে সারাদিনে কি কি অন্যায় করেছে তাও খানিকটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু মেয়ের কথা সে পাশে বসেও শুনতে পায় না।
এই ঘটনার এক সপ্তাহের মাঝে যা যা ঘটেছে তা হলো মইনুল হাসানের প্রাথমিক আতঙ্ক অনেকটা প্রশমিত হয়েছে, আর তার ভেতর রঙ দেখার আকুলতা তৈরি হয়েছে এবং সে ক্রমাগত হাতাশ হয়ে পড়ছে। তবে হাসান ইতোমধ্যে তার যে চশমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এ ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করেছে এবং এটাকে নিজের প্রতি একটা স্বান্তনার উৎস হিসেবে সে ব্যবহার করে যাচ্ছে। তার স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়রা এই বিচিত্র অসুখ সম্পর্কে প্রায় সকলেই এখন জানে এবং তারা সকলেই বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
হাসানের কাছে বিস্ময়টাকে অকৃত্রিম মনে হলেও উদ্বেগটা কতখানি খাঁটি অনেক ক্ষেত্রেই তা নিয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ জেগেছে। আপাতত হাসান আল-ইসলামীয়া চু হাসপাতালে অপোরত, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর জন্য। গত দুইদিনে এ ধরনের পরীক্ষা বেশ কিছু হয়েছে এবং দেশের স্বনামখ্যাত চিকিৎসকরা সে সব পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে কিছুক্ষণ মাথা ঝাঁকিয়ে আরো কিছু টেস্ট-এর নাম লিখে গেছেন। এভাবেই চলছে চিকিৎসা প্রক্রিয়া।
এবারের চিকিৎসক - ডা. আশফাকুর রহমানও সমস্ত রিপোর্ট কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখেন এবং মাথা ঝাঁকান।
মইনুল হাসান ধারনা করে এবার ডাক্তারসাহেব টেস্ট-এর নাম লেখা শুরু করবেন, কিন্তু এবার তা ঘটে না। ডাক্তার রিপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে মইনুল হাসানের দিকে তাকান।
দেখুন আপনার কোন রিপোর্টে তো অস্বাভাবিক কিছু দেখি না। আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি আসলেই কালার দেখতে পাইতেসেন না?
মানে? আপনার কি ধারনা আমি মিথ্যা বলতেসি?
মইনুল হাসান খানিকটা রাগ অনুভব করে।
না সেইটা বলি নাই।
আপনি হয়তো কোন কারনে বিশ্বাস করা শুরু করসেন যে আপনি রং দেখতে পান না। কিন্তু আসলে দেখেন। সাইকোলজিকাল বিশ্বাসটার কারনে বুঝতে পারতেসেন না। হইতে পারে ছোটবেলা থেকে সাদাকালা টিভি দেখসেন আর সেইটার ছাপ মনে থাইকা গেসে, এখন অসুস্থতা হিসেবে প্রকাশ পাইসে। ভাই আপনে এক কাজ করেন আপনে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।
যতোদূর সম্ভব আমরা চেষ্টা করলাম আপনার রোগ বের করার। আমাদের পক্ষে আর তেমন কিছু করা সম্ভব না।
মইনুল হাসান চেষ্টা করেও শান্ত থাকতে পারেন না।
চোখ দিয়া দেখতাসি আমি আর আমি বুঝতাসি না যে আমি রঙ দেখতাসি? বলেন যে আপনারা রোগ ধরতে পারেন নাই, আপনাদের কাছে ট্রিটমেন্ট নাই। সেইটা না বলে আমার এইটা মানসিক সমস্যা বলেন ক্যান? যেই রোগ ধরতে পারেন না সেইটাই মানসিক রোগ, না? বালের আলাপ করেন মিয়া... ...
হাসানের স্ত্রী বিব্রতভঙ্গীতে তাকে মোটামুটি টানাহেচড়া করে নিয়ে বের হয়ে আসে।
এরপর আরো তিন মাস কেটে যায়। এই তিন মাসে মইনুল হাসান বন্ধু, স্বজন, এবং শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে নানা বিচিত্র চিকিৎসার সন্ধান পেয়েছে, তার মাঝে কিছু পদ্ধতি চেষ্টা করেও দেখেছে, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। শেষ পর্যন্ত সকল শুভাকাঙ্খীই বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে মনের সুখে গালিগালাজ করে তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেয়। মইনুল হাসানও বিশ্বাস করে যে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করানো। কিন্তু নিজের আর্থিক অবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে সে অগত্যা সাদাকালো পৃথিবীকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আর যাই হোক, এই রোগের কারনে তো আর তার জীবন সংশয় নাই।
তার মানসিক অস্থিরতা অবশ্য কমে না। আকাশের দিকে তাকালেই মনে হয় আকাশ মেঘলা, তাই ধূসর। পরিবারের সবাই বসে টিভি দেখে আর তার টিভির সামনে গেলেই অসহ্য লাগে। কোন কিছু করার কোন উৎসাহ পায় না।
জীবনের সব স্বাদ যে বর্ণময়তায় তা তার মতো করে আর কেউ বুঝতে পারে না।
এরমধ্যে একদিন বাড়ি ফেরার পথে বাস থেকে নেমেই মইনুল হাসান রাস্তার উপর একটা জটলা দেখতে পায়। মইনুল হাসান একটু এগিয়ে যায়। মানুষের উত্তেজিত টুকরো টুকরো কথা থেকে বোঝা যায় যে কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন অ্যাক্সিডেন্টে আহত বা নিহত হয়েছে। এবং আশেপাশের সবাই আগ্রহভরে সেই মৃতদেহ দেখছে।
মইনুল হাসানও কি মনে করে জটলার ভেতরে ঢুকে পড়ে। একজন মানুষ নিস্পন্দ শুয়ে আছে রাস্তায়। উপুড় হয়ে। একপাশের চোখ দেখা যাচ্ছে। স্থির।
আর মাথা থেকে বের হওয়া রক্তের একটা প্রবাহ রাস্তার উপর গড়িয়ে যাচ্ছে। মইনুল হাসান দেখে সেই রক্তের ধারা। লাল। উষ্ণ লাল রঙ। তার সমগ্র সাদাকালো দৃস্টিসীমায় শুধু এই লাল রঙ অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে।
বহুদিন পর তার রঙতৃষ্ণ চোখ রঙ দেখতে পায়। মইনুল হাসান অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। যতোক্ষণ না একটা অ্যামবুলেন্স এসে মানুষটাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর হেঁটে হেঁটে বাড়িতে যায়। যাওয়ার পথে যেদিকেই তাকায় সেদিকেই দেখে অসংখ্য মানুষ ত্বকের নিচে রঙের স্রোত নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তার সমস্ত চেতনা সমগ্র অস্তিত্বে শুধু এই রঙ দেখার ইচ্ছা তীব্র তীব্রতর হয়ে ওঠে। তার চিন্তা কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে লাল রঙে। লাল, টকটকে উষ্ণ গতিশীল লাল রঙ।
অনেকদিন পর খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে মইনুল হাসান। পরদিন সকালে উঠে শেভ করার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেজরের ব্লেড লাগানোর সময় নিজের হাতের দিকে চোখ যায় তার।
শিরাগুলো সামান্য ফুলে আছে ত্বকের উপর। সে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারে এই শিরার ভিতর দিয়ে তুমুল উচ্ছ্বাসে ছোটাছুটি করছে রক্ত, লাল রক্ত। রঙ দেখার আকুল আকাঙ্খায় আচ্ছন্ন হয়ে আয়নার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে মইনুল হাসান। এই আকুলতা ক্রমশ তাকে গ্রাস করতে থাকে। তার ভেতরে কে যেন ক্রমাগত চিৎকার করতে থাকে- রঙ... রঙ... রঙ...!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।