আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওল্ড হোম ২

আজকে বোধহয় এবাড়িতে আমার শেষ দিন। বোধহয় বলছি কারণ আমি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত না। সার্টিফিকেট অনুযায়ী কালকে ষাট হয়ে যাবে। যদিও ষাট বছর দুই আগেই হয়েছে। চাকরীর পি এল আর এ আছি এখন।

কাল সেই একবছরও শেষ হবে। শরীর এমন কিছু ভেঙ্গে পড়ে নি, কাজকর্ম এখনও করতে পারছি। চাইলে এখনও নিজে কিছু করতে পারব। আলাদা বাড়ী ভাড়া করে থাকা কিংবা নতুন করে আবার সংসার শুরু করা। কিন্তু ইচ্ছা করছে না।

আসলে আমাদের জেনারেশানটা ষাট আসলেই মানসিকভাবেই অবসরে চলে যায়। ‘ওল্ড হোম’ ফেনমেনা। ‘ওল্ড হোম’ গুলোর জন্য বিভিন্ন সংস্থা এখন অনেক প্রফেশনাল হয়ে গেছে। ওল্ড হোমের জন্য ইনস্যুরেন্সও চালু হয়েছে। লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ে বরং এখন ওল্ড হোম ইনস্যুরেনস এর পলিসিই বেশী বিক্রি হয়।

আমরা, মানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখন মানসিকভাবে তৈরিই থাকি। খুব কম মানুষই পাওয়া যায় যারা ওল্ড হোমের ব্যবস্থা করিয়ে রাখেন নি। ওল্ড হোমে যাওয়া নিয়ে এখন আর কোন পরিবারে বচসা হতে দেখা যায় না। বেশ কিছু নিয়ম কানুন কড়া কড়া হয়েছে। মাসে একদিন জীবিত সন্তানদের পুরো পরিবার সহ দেখা করতে যেতে হবে।

একদিন বাসায় এনে রাখতে হবে, যদি চলাচলের মত সুস্থ থাকে। সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য দিকে। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, সকলেরই আয়ু কিছুটা বেড়েছে। ফলে ওল্ড হোম গুলো উপচে পড়ার অবস্থা। প্রায় বছর খানেক আগে থেকে বুকিং না দিলে, সিট পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রথমটায় যেমন ওল্ড হোম খুলার হিড়িক পড়েছিল, সেটা কমে এসেছে। কারণ অনেকেই এতো বেশিদিন বাঁচছে, যে ছেলে মেয়েরা আর তাঁদের দায়ভার টানতে রাজী হচ্ছে না। প্রায়ই দেখা যায়, মাসের টাকাটা বাকী পড়ছে। তাগাদা দেয়ার পরও কোন লাভ হচ্ছে না। অনেকগুলো ওল্ড হোম বন্ধ হবার জোগাড় হল।

তখন সরকার থেকে কিছু সাবসিডি দেয়ার ব্যবস্থা হল। সঙ্গে নতুন নিয়ম হল, এরপর নতুন কোন ওল্ড হোম খোলা হলে নিজ দ্বায়িত্বে খুলতে হবে। তাঁদের আর সাবসিডি দেয়া হবে না। ফলে ওল্ড হোম তৈরিতে ভাটা পড়ল। সাপ্লাই কমলে ডিমান্ড তো বাড়বেই।

বছর খানেক আগেই অনেকগুলো ওল্ড হোমে নাম লিখিয়ে এসেছি। কোথাও খালি হয় নি। নতুন কিছু ওল্ড হোম যেগুলো নন সাবসিডি টাইপের, সেগুলোতে আবার ইনস্যুরেন্স ছাড়া আপ্লাই করা যায় না। আমার ইনস্যুরেন্স যেটা ছিল সেটা আমাকে ভাঙ্গাতে হয়েছে। আমার স্ত্রীর হঠাৎ ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে।

অপারেবল স্টেজে ছিল। তাই চেষ্টা করা হয়েছিল বাঁচানোর। ওর ওল্ড হোম পলিসি ভাঙ্গিয়ে, অপারেশান আর কেমোথেরাপি চলছিল। এরপর হঠাৎ একদিন জ্বর, কেমথেরাপির জন্য শরীরের অবস্থা এমনিতেই নাজুক ছিল। অবস্থা খারাপ হতে সময় নিল না।

আমারও গাফিলতি ছিল, হাসপাতাল নিতে একটু দেরী করে ফেলি। ফলে তৈরি হয় কমপ্লিকেশান। এরপর আই সি ইউ তে মাস খানেক জমে মানুষে টানাটানি করে ও মারা যায়। সেই খরচ মেটাতে, আমার পলিসিও ভাঙ্গাতে হয়। ফলে এখন আমার পক্ষে আর নতুন কোন ওল্ড হোমে আপ্লাই করা সম্ভব না।

আমার একটাই ছেলে। ও জানে আমি দিন রাত চেষ্টায় আছি একটা ওল্ড হোম জোগাড়ের। তাই এখনও কিছু বলছে না। কিন্তু আজকের পরে কি হবে জানি না। বাবা এখনও বেঁচে আছে।

বয়স প্রায় নব্বই ছুঁইছুঁই। খুব বড় কোন অসুখ এখনও হয় নি। বাবার টায় চেষ্টা করেছিলাম। ওখানে কয়েকজনের অবস্থা বেশ খারাপ। যেকোনো সময় হয়তো ফাঁকা হবে।

কিন্তু নমিনি সিস্টেম চালু করায় ওদের ছেলেমেয়েরা আগে সুযোগ পাবে। কারো ছেলে মেয়ে না থাকলে বা না চাইলে, তখন অন্য কোন অ্যাপ্লিকেশান এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। বাবাকে দেখতে এমাসের তিন তারিখে গিয়েছিলাম, সবাই মিলে। এখানে আনবার দিন পঁচিশ তারিখ। এখনও দশ দিন বাকী।

বাবার সঙ্গে একবার আলাপ করার কথা আগেই ভেবে রেখেছি। উনি যদি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। আজকে তাই দেখা করার দিন না থাকলেও দেখা করতে আসলাম। নীচে রিসেপশানে জানালাম। বাবা সামনের মাঠে হাঁটতে বেড়িয়েছেন।

নিয়মিত এক্সারসাইজের ওপর আছেন বলেই হয়তো এখনও বেঁচে আছেন। মাঠের দিকে এগোলাম। বেশিদূর যেতে হল না। বাবা তাঁর হাঁটাহাঁটি সেরে ফিরছিলেন। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল।

কি রে? কিছু হল? না বাবা। কি করবি তাহলে? সেটাই ভাবছি। সরকারী গুলোতে যাবি? ও বলা হয়নি। কিছু সরকারী ওল্ড হোম আছে। সেখানে ফ্রি।

ফ্রি আর সরকারী হলে যা হয়, অবস্থা একেবারে যাচ্ছে তাই। সাধারণতঃ নিম্নবিত্ত, গরীব এরাই থাকে। থাকা খাওয়া ফ্রি এই যা। তবে বেডের ব্যবস্থা নেই। বিশাল কিছু রুমে, একশ জনের থাকার ব্যবস্থা।

যে যেখানে পারে ঘুমাচ্ছে। ডে শিফট ও আছে। মানে সকাল হলেই রাতে যারা ঘুমিয়েছে তাঁদের রুম ছেড়ে দিতে হবে, আরেকদল ঘুমাতে ঢুকবে। নতুন যারা ঢুকে তাঁরা ডে শিফটে ঘুমায়। নেহাত নিরুপায় না হলে কেউ যায় না ওখানে।

সরকারী গুলোতে থাকা সম্ভব না বাবা। এখানে কিছু করা যায় না? দুই জনের অবস্থা বেশ খারাপ, হয়তো যেকোনো দিন মারা যাবে। কিন্তু ওদের দুজনেরই নমিনি আছে। দুজনেরই ছেলে আপ্লাই করে রেখেছে। আমার তাহলে কি হবে বাবা? সরকারীগুলোতে কিছুদিন থাক।

সম্ভব না বাবা। তুমি একবার অবস্থা দেখলে বুঝতে পারতা। বাবা বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি একটা ব্যবস্থা চিন্তা করে রেখেছি। কি ব্যবস্থা? তোকে আমার নমিনি করে রেখেছি।

সে তো তুমি মারা গেলে। বাবা ঠোঁট বাঁকা করে একটু হাসলেন। আমি যে আজকে মারা যাবনা তাই বা তোকে কে বলল? সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। কালকে সকাল সকাল চলে আসিস। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।