ওল্ড হোম ব্যবসা এখন বেশ জমজমাট। প্রায় প্রতি পাড়ায় দুএকটা পাওয়া যাবে। খরচেরও রকমফের আছে। বিশেষ করে শহর থেকে একটু দূরে হলে খরচ কম। কোনো কোনো গ্রাম তো এখন ওল্ড হোম গ্রাম নামেই পরিচিত হচ্ছে।
রিয়েল এস্টেটওয়ালারাও এখন এদিকে মনযোগ দিয়েছে। লাভ খারাপ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কোনোটাই ফাঁকা থাকছে না। আগে থেকে বুকিং না দিলে এখন তো সিট-ই পাওয়া যায় না।
মেল ফিমেল আলাদা পাওয়া যায়।
আবার কনজুগালও। কনজুগালগুলো খুবই কস্টলি। যেহেতু ওখানে এক রুমে মাত্র দুজন। তাই এরকম ওল্ড হোম বানানোর দিকে ইন্টারেস্ট কম। এত খরচ করে খুব কম লোকই থাকতে আসেন।
কেবল যারা আগে থেকে ইন্সুরেন্স করিয়ে রেখেছে, তারাই পারেন থাকতে। সিঙ্গেলগুলোই বেশি ভালো চলছে। আরেকরকম বেরিয়েছে, সেমি কনজুগাল, পাশাপাশি দুটো ওল্ড হোম, মেল আর ফিমেল। ফলে সারাদিন দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে।
আগে থেকে প্ল্যান না করে রাখলে পরে সমস্যায় পড়তে হয়।
টেলিফোন, দালাল, মন্ত্রী-এমপির সুপারিশেও অনেক সময় কাজ হয় না। এখন তাই অনেকগুলোয় নাম লিখিয়ে রাখতে হয়। কোথাও কেউ মারা গেলে ওরাই ফোন করে। বাবার জন্য ওল্ড হোম পেতে বেগ পেতে হয়নি। সেসময় এত রাশ ছিল না।
’৭০-এর আগে কাউকে ওল্ড হোম নেয় না। তার আগে থাকতে চাইলে বাসাভাড়া করে থাকতে হবে। তাতে খরচ অনেক বেশি। এর ওপর কাজের লোক রাখা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, বিশাল ঝক্কি। তাই ৭০ পর্যন্ত নিজের কাছেই রাখা হয়।
বাবার এখন ৮০। বছর দশেক হল আছেন ওল্ড হোমে। প্রথমটায় মন খারাপ করতেন। কান্নাকাটি, অনুরোধ ‘আমি তো কোনো সমস্যা করি না’। কখনও আমার ছেলেকে ব্যবহারের চেষ্টা ‘ও তো আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না’, ইমোশনাল অ্যাঙ্গেল দেওয়া, ‘বাসার কোণায় পড়ে থাকব’Ñ টাইপ কথাবার্তা আরকি।
এখন আর করেন না। ওখানে কিছু বন্ধু-বান্ধব জুটেছে। আড্ডা দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে। মাসে একদিনের জন্য নিয়ে আসি। তখন মায়ের সঙ্গে রাজ্যের গল্প করেন।
ফেরত যাওয়ার সময় শুধু একটু মন খারাপ করেন।
মায়ের কালকে ৭০ হবে। যে কয়টাতে নাম লিখিয়ে এসেছিলাম তার দুটো থেকে ফোন এসেছিল। কয়দিন আগে মাকে নিয়ে দুটো থেকেই ঘুরে এসেছি। কোনোটাই মায়ের পছন্দ হয়নি।
এটা খারাপ, সেটা পচা। বিভিন্ন বাহানায় এড়াতে চাইছেন। আসল ইচ্ছা কনজুগাল-এ থাকা। বাবার সঙ্গে একসঙ্গে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়, অত টাকা নেই।
অনেকভাবে বোঝানো হয়েছে। বাবাও বুঝিয়েছেন। ‘থাকতে শুরু কর, পরে দেখবা আর খারাপ লাগছে না’।
সেমি কনজুগাল যে আমি ট্রাই করিনি তা নয়। যদিও আমার কষ্ট হত খরচ জোগাতে, তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।
যতগুলো সেমি কনজুগাল ওল্ড হোম ছিল সবগুলোয় নাম লিখিয়েছি। একইসঙ্গে দুজন মারা যাওয়া তো এত সহজে ঘটে না। আবার একজন মারা যাওয়ার পর যে বুকিং দেব, কিছুদিনের মধ্যে যদি আরেকটাতে আরেকজন না মরে? বুকিংয়ের টাকাটা নষ্ট হবে।
বাবা-মাকে নিয়ে একদিন বসেছিলাম। বাবাকে সেমি কনজুগাল-এ শিফট করতে চেয়েছিলাম।
পরে যদি পাশের ফিমেলটায় কেউ মারা যায় তখন বুকিং দিয়ে রাখা যাবে। বাবা রাজি হননি। একটা ফ্রেন্ড সার্কেল তৈরি হয়ে গেছে। উনি নড়তে চাচ্ছেন না। এদিকে যে দুটো থেকে ফোন এসেছে দুটোতেই মায়ের জন্য ২ মাস থেকে ফুল চার্জের টাকা দিচ্ছি।
ওখানে না উঠলে টাকাটা নষ্ট হবে। তার চেয়েও বড় কথা, আবার কখন ফাঁকা পাব এর কোনো ঠিক নেই।
এদিকে নতুন কিছু নিয়ম চালু হয়েছে। ইউথানাশিয়া বা মার্সি কিলিং। কেউ চাইলে নিতে পারে।
একটা ফরমে সই করতে হয়। ইঞ্জেকশন দেওয়ার ঘণ্টা দুএক পর মৃত্যু হয়। ফলে বাসায় ফেরত আসার সময় পাওয়া যায়। এরকম একটা সেন্টারে আমার বন্ধু কাজ করে। ওর সঙ্গে কথা বললাম আমার সমস্যা নিয়ে।
‘কী করবো বুঝে পাচ্ছি না’।
‘চিন্তা করিস না, ব্যবস্থা করে দেব। শুধু এই ফরমে সই নিয়ে রাখবি’।
নিয়ে রেখেছি। মা জানে, ওল্ড হোমে অ্যাপ্লাই করার ফরম।
কিন্তু ওখানে নিয়ে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু উপায়ও নেই। মা যেভাবে নিজের জেদে আটকে আছে। কনজুগালে রাখার মতো এত টাকা আমি কোথায় পাব? বেতন, ঘুষ সব মিলিয়ে যা পাই তাতে নিজের সংসার চালিয়ে অল্প কিছু হাতে থাকে। তার ওপর আবার টানতে হচ্ছে বাবার ওল্ড হোমের খরচ।
আমাদের দুজনের ওল্ড হোমের জন্য ইন্সুরেন্স নিয়েছি, তার লধাধংপৎরঢ়ঃ:াড়রফ(০)প্রিমিয়াম দিতে হয়। নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
মাকে অনেক রকম করে বুঝালাম। ‘আপাতত যাও। সেমি কনজুগাল কোনোটা পেলে তখন দুজনকেই শিফট করব।
বাবা অবশেষে কিছুটা নিমরাজি হয়েছেন। উনার নিজের ওল্ড হোম ছাড়তে। কিন্তু মা অনড়। কিছুক্ষণ আগে শেষবারের মতো বুঝালাম। রাজি নন।
উনি হয়তো ভাবছেন, রাজি না হলে আমার এখানেই থাকতে পারবেন। তা তো সম্ভব নয়। অনেকদিন তো দেখলাম, আর কত? আমার নিজেরও তো একটাজীবন আছে। চাওয়া-পাওয়া আছে।
একটু আগেই বন্ধুটিকে ফোন করেছিলাম।
‘আমরা আসছি’। আর মাকে বলেছি, তোমার যে কালকে জ্বর জ্বর বলছিলে? চলো, ডাক্তার দেখিয়ে আনি। মা-ও তৈরি। এখনই বেরোবো। ভালোয় ভালোয় সব শেষ করতে পারলে বাঁচি।
সংগৃহীত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।