আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন মুনমুন হলুদ দিবসে

যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে

১. আতিকের বিয়ে মুনমুনের জন্য আটকে আছে। বয়স হয়েছে, ব্যবসা ভাল, কিন্তু বিয়ে করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে একাধিক বান্ধবী অবসরের বিনোদন। কারো কারো সাথে টুকটাক শারিরীক সম্পর্কও হয় তবে আব্রুজাত মফস্বলে তেমন মওকা মত পাওয়া দুস্কর। বান্ধবীরা কেউ বিয়ে করতে আগ্রহী, কিন্তু ছোটবোনের এমএ ডিগ্রী'র পরেও বিয়ে না হওয়াতে কাউকে কথা দিতে পারে না, এমনকি মানসিক সম্পর্কতেও জরাতে পারে না।

একজন ফোনে আক্ষেপ করে, তুমি কেবল মধু খেয়ে যেতে চাও, আছো তো বেশ আরামেই! আতিক জেল্লামেরে বলে, এখনইতো সময়, বিয়ে হলে একেবারে কেঁচে যাব! মেয়েটি বলে, তোমার কি কোনদিন ঘর হবে? আতিকের ভাবাবেগ ছোয় না। সে হেসে বলে, এখন কি ঘরের বাইরে? যাই বলুক আসল রহস্য সে জানে। বন্ধু, বান্ধবীরা জানে বহিস্তরূপটাই। সম্পর্ক তৈরীতে ভীরু, নৈতিকতা বোধে কিছুটা ক্ষয়িত, অস্থিরমনস্কতা, আর্থিক সঞ্চয়ে অমনযোগী এমন কিছু লক্ষণ তার মধ্যে ক্রমশ বেড়েই চলছে। বাসায় ফেরে রাত বারোটায় , সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠেই আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে আসে।

নিজস্ব একটা ঘরের অভাব বোধ করে প্রচন্ড, যা তার পিতামাতা সহযোগের বর্তমান চিত্রে নয়, একটু অন্যরকম; নিজের মত করে স্বপ্ন তৈরীতে বাঁধা থাকবে না। ২. মুনমুনের মত মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে হরদম। কিন্তু মুনমুনের হচ্ছে না। কারণটা তাদের সৈয়দ পরিবারের ঐতিহ্যের সূত্রে বাঁধা। অভিজাত ছেলে মেলে তো ভাল চাকুরী মেলে না।

জেলা একাউন্টস কর্মকর্তার মেয়ে সরকারী চাকুরীজীবি ছেলে ছাড়া বিয়ে হলে সামাজিক মর্যাদায়ও একটা ধাক্কা খাবে। সেজন্য বাছবিচার চলছে গ্রাজুয়েশনের পর থেকেই। মা বলে, তোর জন্য আতিক বিয়ে করছে না, ছেলেটা সারাদিন কাজ করে, কিন্তু মুখটা মলিন! মায়ের বুক চিড়ে বের হওয়া দীর্ঘনিশ্বাস মুনমুনকে হতাশ করে। সে বলে, ভাইয়া, বিয়ে করে ফেললেই তো হয়! কে তাকে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে! মা'র মেজাজ তিরিক্ষি হয়। সে বলে, ওকি তোর খারাপ চায়? তোকে ভালবাসে বলেই তো অপেক্ষা করছে।

মাঝেমাঝে মুনমুন হিন্দি সিনেমা দেখে আর ভাবে একটা কিছু তাকে করতেই হবে, নইলে পয়ত্রিশ ছুইছুই বিগব্রাদারের ছন্নছাড়া জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে না। তবে তার মনে খচখচ করে একটা আভিজাত্যবোধের মশলা। কেবল ভালোবাসে বলেই কি ভাইয়া অপেক্ষা করছে! বাবা-মা তেমন উদ্যোগ নিলে ভাইয়ার বিয়ে কবেই হতে পারতো! বয়স হিসাবে তো সে বড়ই, আগে বিয়ে হতেই পারে! আসলে তারা চায় না। আইবুড়ো মেয়ে রেখে ছেলের বিয়ে হলে সৈয়দ পরিবারে ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যে এখনও কলংক লাগে। এতগুলো মেয়ের সাথে আতিক যে ফস্টিনস্টি করে বেড়ায় তা লোকজনের চোখের আড়াল হয় কিভাবে! মফস্বল শহরে চাকুরী বলতে স্কুল, কলেজ।

কিন্তু মুনমুনের শিক্ষকতায় চরম বিরক্তি। সে নিজের মধ্যে বিদ্রোহী হয়। তাকে ছাড়তে হবে ঘর। ৩. মুনমুন ঢাকা এসেছে বড় বোনের বাড়ী। কিছুদিন চাকুরীর জন্য চেষ্টা করে পেয়েও গেছে দেশী কোম্পানীর কাস্টমার কেয়ারে।

প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয়। মুনমুন জীবনটাকে নতুনভাবে দেখতে শেখে। অফিসের ট্রেনিং এ কলিগদের সাথে সিলেট ঘুরে আসে। ক্রমশ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যেতে একা একা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একজন কলিগ সবসবময় লেপ্টে থাকে।

মুনমুন বুঝতে পারে ছেলেটির চোখের ভাষা। সে রোমাঞ্চিত হয়। ত্রিশে এসে প্রেম করার সাধ হয়। ছেলেটি ইন্টারকমে বলে, আমার হাতে কাজ নেই, ইচ্ছে করলে আপনার কিছু কোয়েরি আমি রেসপন্স করতে পারি! মুনমুন কাজ করতে আলস্য বোধ করে না। তবে একজন হাত বাড়ালে সহজ হয়তো বটেই।

সে সাগ্রহে এগিয়ে দেয় কয়েকটা ফাইল। গুলশানে দুটো বাড়ীর এসি-ট্রাবল, ধানমন্ডিতে লিফটের কল একটা। মুনমুন ফোনে বলে, সো কাইন্ড অফ ইউ! ছেলেটি বলে, আরে না না! আপনার জন্য কিছু করতে পেলে ভাল লাগে! মুনমুনেরও ভাল লাগে। সে জানালার ভেনিসিয়ান ব্লাইন্ডটা ফাঁকা করে দেয়। রোদেলা দুপুরে দূরের রাস্তায় যানবাহনও তাকে মোহিত করে।

৪. মুনমুন আর ফারুক চুটিয়ে প্রেম করছে। চারদিকে এখন মুনমুনের উন্নতি, প্রেমিক কুপোকাত, কোম্পানীর মালিক প্রশংসায় গদগদ। মুনমুন বাড়ীর পছন্দ অপছন্দ কেয়ার করে না এখন। ফারুকের বাড়ী টাংগাইলে। গ্রাজুয়েশন করে চাকুরীতে ঢুকেছে।

মাস্টার্স মেয়ের বিএ পাস ছেলের সাথে সন্বন্ধ সৈয়দ পরিবার মেনে নিক বা না নিক তাতে কিছু যায় আসে না এখন মুনমুনের। তার উপরে ফারুকের মা আবার আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। ফারুকের বাবা সেই প্রথম স্বামী। আটবছরের সময় যখন বিচ্ছেদ ঘটে সেই থেকে সে বাবার সাথেই থাকতো। চারবছরের মাথায় বাবা মারা যাওয়ায় মা তাকে নিয়ে আসে।

কিন্তু মা'র নতুন সংসার তার ভাললাগেনি বলে পড়াশুনা শেষ না করে চাকুরীতে ঢুকে পড়ে। মুনমুন জানে এমন ঘটনা জানার পরে তার বাবা-মা তাকে স্রেফ ঘরবন্দী করে রাখবে। ফারুক কোনদিন বিকেলে মুনমুনকে বলে, আজকে তোমার হলুদ দিবস! মুনমুন অবাক হয়, কিভাবে? ফারুক বলে, বিকেলে ঠিকই দেখবে! মুনমুন জানে ফারুকের এই দিবস বিষয়টা। যেদিন বসুন্ধরা আবাসিকে ঘুরতে যাবে সেদিনটা হচ্ছে নীল দিবস। কারণ ঐদিন নীল আকাশ দেখতে হবে।

তবে সবদিনের নীল দিবস মানে যে বসুন্ধরা তা নয়। কারণ অন্য একদিন নীল দিবস বলায় সে মনে করেছিল বসুন্ধরায় যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন সে একটা নীল রঙের শাড়ী প্রেজেন্ট করলো! ৫. মুনমুনকে নিয়ে ফারুক ঘোরে হলুদ ক্যাবে। এটা হচ্ছে হলুদ দিবসের তাৎপর্য। ফারুক মুনমুনকে বিয়ের কথা বলে।

মুনমুন মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। সেও চায় বিয়ে করে ফেলতে। কিভাবে বিয়ে করতে চাও, জিজ্ঞেস করে ফারুককে। ফারুক বলে, চলো দুজন দুজনাকে বিয়ে করে ফেলি। তারপরে লোকজন ডেকে একদিন খাইয়ে দেব! মুনমুন এমনই চাইছিল।

পারিবারিকভাবে ফারুককে সাথে বিয়ে মেনে নেবে না তার বাবামা। তারচেয়ে এই ভাল। সে বলে, তাহলে চলো আজিই বিয়ে করে ফেলি! ফারুক নেচে ওঠে। দুজনের কমন বন্ধু ভাস্করকে ফোন করে। ভাস্কর আশ্বাস দেয় রাতের মধ্যে বাসর সাজিয়ে দেবার।

মুনমুন আর ফারুক নিজেদের পোষাক, মিস্টি আর মালা কিনে উপস্থিত হয় ভাস্করের বাসায়। কাজী আসে। আসে আরো কয়েকজন বন্ধু। বিয়ে হয়ে গেলে, রাতে মুনমুন বাবাকে ফোন করে। বলে, বাবা আমাদের জন্য দোয়া করো, তোমাদের না জানিয়ে আমি বিয়ে করে ফেলেছি।

ছেলেটির নাম ফারুক, ও.... অপরপ্রান্তে ফোন ছুড়ে দেয় বাবা! ৬. মুনমুন প্রাথমিক মানসিক দুরাবস্থা কাটিয়ে এখন ফারুকের সাথে স্থির হয়েছে। পরের দিন সকালে দুজন ভাস্করের বাসা থেকে অফিসে চলে এসেছিল। তারপরে রাত্রে আর বোনের বাসায় ফিরে যায়নি। সোজা উঠে এসেছে ফারুকের ছো্ট্ট বাসায়। সৈয়দ পরিবার থেকে আর কেউ যোগাযোগ করেনি।

মুনমুন অবাক হয়ে ভাবে তাদের রিএ্যাকশন এমন হলো কেন। সে ভেবেছিল, বাবা-মা এ নিয়ে অনেক লংকাকান্ড করবে। কিন্তু তা তো দূরে থাক, আরেকটা ফোন পর্যন্ত করলো না। ফারুক স্বান্তনা দেয়, ওসব কিছু না, চোট পেয়েছো তো সেজন্য একটু সময় লাগবে! মুনমুনের সাথে বড় বোনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সে খবর পায়, বড় ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন চলছে জোরেশোরে।

পাত্রী ঠিক হয়ছে। মুনমুনের অদ্ভুত লাগে। তার এভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলাতে প্রকারন্তরে সৈয়দ পরিবার বোধহয় হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। মনে মনে হয়তো খুশীই। তাহলে কেন তার খবর নিচ্ছে না! ৭. আতিকের মা ছেলের বউয়ের জন্য তার সমস্ত গয়না তুলে রেখেছে।

ছেলের আয়ের উপর নির্ভরশীল বাবামা এখন ঐতিহ্য অটুট রেখে ছেলের বিবাহ দিতে পেরে আপ্লুত। নিজেদের মধ্যে মুনমুনকে নিয়ে আলোচনা ঐটুকুই, একটা দীর্ঘনিশ্বাসের মত। মেয়েটা কি করলো? আমাদের সময় দিতে পারলি না! আমরা তো ছেলে দেখছিলামই! আতিক একদিন বলে, মুনমুনকে খবর দেই! রে রের করে ওঠে বাবামা। তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? ও কি আমাদের মান সম্মান কিছু রেখেছে? আতিক আর বেশী এগোয় না। তার মনে হয় মুনমুন ভাল থাকলেই হলো।

মনে মনে তাকে ধন্যবাদও দেয়, পথ পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য। একদিন বিয়ে হয় আতিকের। বাসর রাতে মুনমুনের ফোন আসে আতিকের মোবাইলে, বলে, ভাইয়া, তোর বউকে আমার আদর দিস, তার জন্য একটা লালটুকটুকে শাড়ী কিনেছি! আতিকের কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। সে তার আদরের ছোট বোনটিকে বলে, কুটুস, তোর সংসার কেমন চলছে! মুনমুন বলে, তোমাদের জামাই কিন্তু তোমাকে সালাম দিয়েছে! আতিকের কেন যেন সন্দেহ হয়, তার জন্যই কি মুনমুন সৈয়দ পরিবারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিয়ে করেছে! আতিকের নব্য বিবাহিতা স্ত্রী ঘোমটা সরিয়ে দেখে তার স্বামী চোখ মোছে পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.