(ইন্দোনেশিয়ার সুকাভুতিতে অনুষ্ঠিত ওপেন সোর্স এক্টিভিস্টদের সম্মিলনী ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ‘এশিয়া সোর্স ২’-তে আমিও অংশগ্রহণ করি। ফিরে এসে আমি এ লেখাটি রচনা করি। আপনার মতামত পেলে লেখাটি আরো ভালো করা যাবে। )_______________________________________
দুনিয়াব্যাপী কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের প্রপাইটরি সফটওয়ার ব্যবহারের ফলে বহুজাতিক সফটওয়ার কোম্পানিসমূহ তাদের মুনাফার পাহাড় ক্রমশ ভারী করছে। এ থেকে মুক্তি এবং সফটওয়ারের ওপর সামাজিক মালিকানা তৈরির প্রত্যয়ে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে উন্মুক্ত সোর্স মুভমেন্টের ১২০ জন যুবক একত্রিত হয় ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভা দ্বীপের সুকাভুতিতে।
প্রপাইটরি সফটওয়ার ব্যবহারের বদলে উন্মুক্ত সোর্স ব্যবহার ও উন্নয়নের জন্য এবং মুভমেন্টকে আরো বেগবান করার জন্য তাদের একীভুত কর্মকৌশল গ্রহণ করে।
ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভা দ্বীপের সুকাভুতিতে ২২-৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ওপেন সোর্স এক্টিভিস্টদের সম্মিলনী ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ‘এশিয়া সোর্স ২’। ২৫টি দেশের প্রায় ১২০ জন ‘ওপেন সোর্স’ এক্টিভিস্ট এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। কমিউনিটির ব্যবহারে সহজ এমন ০৬টি রেডি টু ইউজ সলিউশানও প্রকাশ হয় এ ক্যাম্প থেকে।
সম্মিলনীর প্রথম ও শেষ দিন উপস্থিত ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রী কুসমেয়েন্ট কেডিম্যান।
মন্ত্রী জানান, ইন্দোনেশিয়ার স্কুলসমূহে কম্পিউটার শিক্ষার জন্য বর্তমানে ওপেন সোর্স সফটওয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে। মাইক্রোসফট শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়ার জন্যে নামমাত্র দামে উইন্ডোজ দিলেও সরকার সাধারণ মানুষকে উন্মুক্ত সোর্স সফটওয়ার ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ যোগাচ্ছে। তিনি বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির ওপর আমাদের নিজ নিজ মালিকানা তৈরি করতে হলে অবশ্যই ওপেন সোর্স সফটওয়ার ব্যবহার করতে হবে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার ৫টি মন্ত্রনালয় এবং অধিদপ্তর ওপেন সোর্স সফটওয়ারকে সমর্থন দেবার জন্য ‘ইন্দোনেশিয়া- গো ওপেন সোর্স’ প্রকল্প বান্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এপ্লিকেশান তৈরি করা হয়েছে এবং তা বর্তমানে গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় ব্যবহার করছে।
আশা করা হচ্ছে খুব সত্বর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হবে।
সম্মিলনিতে বিভিন্ন দেশের তথ্য-প্রযুক্তি ও ওপেন সোর্স সফটওয়ার সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশের সফল কেসস্টাডিসমূহ উপস্থাপন করা হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের হিসাব ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ভোক্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ-সহ প্রয়োজনীয় ওপেন সোর্স সফটওয়ার সমূহ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনসমূহের জন্য ওপেন পাবলিশিং, অডিও-ভিডিও সম্পাদনা, নিরাপত্তা, উবুন্টু, ওপেন অফিসসহ প্রয়োজনীয় ওপেন সোর্স সফটওয়ার নিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আলোচনা হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও-সমূহ যাতে প্রপাইটরি সফটওয়ার থেকে ওপেন সোর্স সফটওয়ারে আসতে পারে তার জন্য এ সকল সফটওয়ারের ০৬টি প্যাকেট অংশগ্রহণকারীদের প্রদান করা হয়।
সম্মিলনীর স্থানীয় আয়োজক ‘আইসিটি ওয়াচে’র নির্বাহী পরিচালক বোনা সিম্যানজুনটাক বলেন, প্রপাইটরি সফটওয়ার থেকে ওপেন সোর্স সফটওয়ারে কিছু পার্থক্য রয়েছে; এ জন্য উদ্ধুদ্বকরণের চেষ্টা করা দরকার।
তিনি আরো বলেন, এখনো অনেক মানুষ ওপেন সোর্স সর্ম্পকে জানে না। তাদেরকে ভালো মত জানাতে হবে। গ্রিস থেকে সম্মিলনীতে আসা সিমন হ্যাক্সিটালি বলেন, তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ ওপেন সোর্স ব্যবহার করছে তাদের অনেক বাড়তি প্রাপ্তি রয়েছে, যেমন ইন্দোনেশিয়া। এটি ব্যবহারের ফলে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ কমিয়ে আনার পাশাপাশি কমিউনিটির সর্মথন পাওয়া যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ওপেন সোর্স ব্যবহারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
কিছু কিছু দেশের এ সকল উদ্যোগ এখনো প্রারম্ভিক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু ওপেন সোর্স ব্যবহারের জন্য প্রায় প্রত্যেকের মাঝে এক ধরণের নীতি পরিবর্তন ও গ্রহণের তাগাদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে ১. জাপান তাদের ই-গর্ভানেন্স প্রকল্পে নিরাপত্তাজনিত কারণে ওপেন সোর্স ব্যবহার করছে। একই সাথে জাপানিজ সরকার তাদের পুরো পে-রোল সিস্টেমে লিনাক্স ব্যবহার করছে। ২. মালেশিয়ার সরকার ২০০১ সাল থেকে ওপেন সোর্সকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
২০০২ সালের এপ্রিলে মালেশিয়ার এসোসিয়েশান অব কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া ইন্ডাস্টি একটি পেপার উপস্থাপনের মাধ্যমে মালেশিয়াকে ২০০২ এপ্রিলের মধ্যে ‘অফিসিয়াল অ্যাম্বারেস ওপেন সোর্স সফটওয়ার’ অর্ন্তভুক্তির সুপারিশ করেন। একই সাথে ২০০২ সালের মালেশিয়ার সরকার ব্যয়সাশ্রয়ী ওপেন সোর্সভিত্তিক সফটওয়ার ‘কমনাস’ চালু করে। ৩. থাইল্যান্ডে ব্যাংকক পোস্ট একটি প্রবন্ধে প্রকাশ করে, থাইল্যান্ডের আইসিটি মন্ত্রনালয় ২০০৩ সালের মধ্যে সরকারের সকল সিস্টেমের ৫ শতাংশে লিনাক্স ইনস্টল করা হবে। ৪. তাইওয়ানের সরকার ২০০৩ সালে একটি ‘জাতীয় ওপেন সোর্স পরিকল্পনা’ গ্রহণ করে। পরিকল্পনা মোতবেক সরকার একটি সফটওয়ার কারখানা করবে যা ধীরে ধীরে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রপাইটরি সফটওয়ারের বদলে ওপেন সোর্স সফটওয়ার প্রতিস্থাপন করবে।
তাইওয়ানের কেন্দ্রিয় কম্পিউটার সেন্টার জাতীয় শিক্ষা কাঠামোকে ওপেন সোর্স সফটওয়ারের দিকে যাবাার জন্য একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ৫. ভারতের কেন্দ্রিয় শুল্ক-কর বিভাগ তাদের ১০০০ ডেক্সটপ কম্পিউটারে লিনাক্স ব্যবহার করছে। সরকারের সুপারকম্পিউটার, দি-ড্যাক, পুরোদমে লিনাক্স ব্যবহার করছে। এছাড়াও ভারতের প্রচুর ওপেন সোর্স প্রকল্প রয়েছে। এছাড়াও জার্মানি, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চায়না, পেরু ও ব্রাজিলে সরকারিভাবে ওপেন সোর্স ব্যবহার করছে এবং অনেকে ব্যবহারের জন্য নীতি প্রণয়ন করছে।
কিন্তু ওপেন সোর্স কী ও কেন জরুরি; এটি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। একটানা বললে ফস (ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়ার) হচ্ছে এ প্রোগ্রামে ব্যবহারকারীকে এ সফটওয়ার যে কোন কাজে ব্যবহারের জন্য স্বাধীণতা দেয়া হয়ে, একই সাথে ব্যবহারকারী এটি নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন এবং সফটওয়ারটির আসল অথবা রুপান্তরিত কপি বিতরণের স্বাধীণতা দেয়া হয়। ফ্রি ও ওপেন সোর্স সফটওয়ারকে নানা নামে ডাকা হয়; যেমন এটি একটি মুভমেন্ট, একটি খেয়াল, একটি সংক্রামন, একটি সাম্যবাদী চক্রান্ত, এমনকি হৃদয় ও আত্মার সংযোগ। কিন্তু একটি বিষয় নজরে আসার মত, উন্নয়নশীল দেশসমূহ মুনাফামুখী সমাজ থেকে নিজেদের সম্পদকে বদল করে নেবার ক্ষেত্রে ফস একটি কার্যকর বাহন।
আমাদের দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের প্রায় ৯৫.৫% (অনুমান) প্রপাইটরি সফটওয়ার ব্যবহার করে।
উইন্ডোজ, অফিস, এডোবসহ বহুল ব্যবহৃত প্রায় সকল সফটওয়ারই পাইরেটেড, চোরাই। আমরা যারা এ সফটওয়ারসমূহ ব্যবহার করছি এটি এক ধরণের অপরাধ এবং আত্মগ্লানির বিষয়। কেননা আমরা চুরি করছি। কিন্তু আমাদের যারা কম্পিউটার ব্যবহার করি আমরা তারা যদি বলি আমরা আর চোরাই সফটওয়ার ব্যবহার করবো না তাহলে উইন্ডোজ ও এমএস অফিস-এর আসল কপি কেনার জন্য আমাদের প্রতি কম্পিউটার ব্যবহারকারীকে অন্তত: বাড়তি আরো ৭০০ ডলার শোধ করতে হবে। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪৯ হাজার টাকা।
আমাদের যে সামর্থ্য তাতে আমরা ২০-২৫ হাজার টাকার মধ্যে একটি কম্পিউটার ক্রয় করছি। কিন্তু যদি আসল সফটওয়ার কিনতে হয় তাহলে আরো ৪৯ হাজার টাকা-সহ মোট ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি কম্পিউটার কিনতে হবে। যা আমাদের বেশিরভাগ কম্পিউটার ব্যবহারকারীর পক্ষে কেনা অসাধ্য হয়ে পড়বে।
তাহলে কী আমরা চোরাই সফটওয়ার ব্যবহার করবো? চোরের মত থাকবে? নাকি বাড়তি টাকা দিয়ে সফটওযার কিনে বিল গেটসের পকেট তাজা করবো। ইতোমধ্যে মাইক্রোসফট বাংলাদেশে তাদের অফিস নিয়েছে।
আগামিতে তারা কপি রাইট আইনের বলে পাইরেটেড সফটওয়ারসমূহ ধরবে এবং আসল সফটওয়ার কেনার জন্য আইনীভাবে বাধ্য করবে। যদি তাই হতে থাকে তাহলে প্রতি বছর সফটওয়ার বিক্রি করে বিদেশী কোম্পানিসমূহ আমাদের দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিবে। বিদেশ থেকে কম্পিউটার সরঞ্জাম করে আমরা যত টাকা খরচ করি তারচে কয়েক গুণ বেশি টাকা সফটওয়ার কেনার বদলে আমরা বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে হবে।
এ থেকে বাঁচার এটাই রাস্তা, তা হচ্ছে উন্মুক্ত প্রোগ্রামিং সংকেত (ওপেন সোর্স) ব্যবহার করা। মালেশিয়া, ভারত, ইন্দোশিয়া, ফিলিপাইনের মত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, এনজিও, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে ওপেন সোর্স সফটওয়ার ব্যবহার শুরু করতে পারি।
ওপেন সোর্স সফটওয়ার ব্যবহারের ফলে আমরা অনেকগুলো সুবিধা পেতে পারি। প্রথমত: প্রপাইটরি সফটওয়ার কিনতে গিয়ে আমরা বাড়তি কয়েক হাজার টাকা বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে না। দ্বিতীয়ত: এটির প্রোগ্রামিং সংকেত উন্মুক্ত। তাই এ সফটওয়ারসমূহ চাহিদামত পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করা যাবে। তৃতীয়ত: এটি ব্যবহারের ফলে চোরাই মাল ব্যবহারের যে আত্মগ্লানি তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
চতুর্থত: ইতোমধ্যে একটি গ্র“প অপারেটিং সিস্টেম ‘উবুন্ট’র বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এর ফলে যাঁরা ইংরেজি জানেন না তাঁরাও বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবে।
তাই আমাদের দরকার রাষ্ট্রীয়ভাবেই উন্মুক্ত সোর্স সফটওয়ার ব্যবহারে এবং তা উন্নয়নে উৎসাহ দেয়া এবং সমর্থন যোগানো। দেশকে আর্থিক সয়ম্ভরতা অর্জন ও দারিদ্র্যকে ইতিহাসে পরিণত করার ক্ষেত্রে এটিও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। আশা করি সরকার আমাদের পাশে থাকবেন এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।