আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লেকের ধারে জমে উঠলো নিস্তব্ধ রাত (তাজিংডং-5)

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের তাবু আর্মিরা ঘেরাও করে রেখেছে। ভয়ে ভয়ে একজন বের হলাম। উদ্ধত অস্ত্র, গুলি করে কিনা ঠিক নাই। কথা বলে বুঝতে পারলাম, ভয় নাই। আমাদের তাবুটা ওদের খুব পছন্দ হয়েছে।

তাই সবাই তাবুর চারপাশ দিয়ে এক চক্কর ঘুরে দেখছে। সময় করে তাদের ক্যাম্পে দেখা করে আসতে বললো তারা। সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গার পর টয়লেটের খোজ করছিলাম। কিন্তু কারো কথাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। সবাই কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছে? টয়লেট নাই, তাই কি হয় নাকি! বাধ্য হয়েই জঙ্গলে যেতে হলো।

আশপাশে কোনো মানুষ নাই দেখে নিশ্চিন্ত মনে এক ঝোপের ভেতর বসলাম। কিন্তু টয়লেট যখন মাঝপথে (going on) তখন সম্বিত ফিরল ঘ্যোৎ ঘ্যোৎ শব্দে। শুকর এসে হাজির। জোরে ধমক দিলাম, একু পরে আয়। এখনই খেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? কিন্তু কে শোনে কার কথা।

ইশ হাতের কাছে যদি একটা লাঠি থাকতো! অবস্থা বেগতিক দেখে ওভাবেই পাচ ছয় পা এগিয়ে যেতে হলো। বললাম, গু খা শুওরের বাচ্চা। এরপর অবশ্য আর কখনো লাঠি হাতে বসতে ভুল হয়নি। আমাদের তাবুর কাছেই মন্থনদার বাড়ি। মন্থনদা সহ এই গ্রামের প্রায় সবাই বম।

তাদের বাড়ির কয়েকটা বাচ্চাকে বিস্কুট দেয়া হলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি মজার ঘটনা, বিস্কুটগুলো এদিক ওদিক পড়ে আছে। বুঝতে পারলাম, এরা এখনও বিস্কুট খাওয়া পছন্দ করেনা (সম্ভবত শুরুই করেনি)। গত কয়েকদিনের পরিশ্রমের পর আজকে বগা লেকেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সকালে চিড়া, গুড় এবং বিস্কুট খেলাম।

দিনের আলোয় ভালোভাবে দেখলাম, অসম্ভব সুন্দর বগা লেক। চারপাশে সবুজ পাহাড় আর মাঝখানে নীল পানি। কেউ বলতে পারেনা এর গভীরতা কতো। সরকারি গেজেটে নাকি আছে 125 ফুট। বগা লেকের একদম লাগালাগি পাহাড়টা কয়েকশ ফিট উচু।

এর উপরেই আর্মি ক্যাম্প। সকালেই ঘুরতে গেলাম। এ জায়গার আর্মিরা বেশ ভালো। চা নাস্তা খাওয়ালো। কয়েক বন্ধুর সিগারেট কেনার দরকার ছিল।

তার ব্যবস্থাও হলো। শুনলাম পরিবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নাই বললেই চলে। মাসে একবার হেলিকপ্টার আসে। তাতে চিঠিপত্র এবং রেশন থাকে। কয়েকজন তাদের বাসার জন্য লেখা চিঠি খামে ভরে আমাদের হাতে দিয়ে দিল।

ঢাকায় গিয়ে পোস্ট করে দিতে হবে। হেলিকপ্টার আসতে দেরি আছে। তাল গাছের মতো লম্বা একজন আর্মি তার পরিচয় দিল এভাবে, মামা আমি কমান্ডো। একজন কমান্ডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে আমরা ধন্য হলাম। আর্মিরাও যে আমাদের মতো মানুষ তা বুঝতে পারলাম।

একজন জানালো এখানে তার 40 বার ম্যালেরিয়া হয়েছে। মশার কামড় থেকে বাচার জন্য তারা এক ধরনের তেল ব্যবহার করে। আমরাও একটা মলম নিয়ে গেছিলাম। সন্দেহ হলো আমাদেরও ম্যালেরিয়া হবে না তো? পাহাড়ের উপর থেকে বগা লেকের কিছু ছবি তোলার পর নেমে আসলাম নিচে। বগা লেকে একটা ভাঙ্গাচোরা নৌকা ছিল।

সেটাতে করে লেকে ঘুরলাম। গোসল করলাম। সাং লিয়েনের মুখে শুনলাম, স্থানীয় ধারণা মতে বগা লেকের সৃষ্টি রহস্য। পুনর্জীবন দানে সক্ষম কোন এক শিকারী কিভাবে রাজার মেয়েকে জীবন দান করে, তাকে বিয়ে করে এবং নিজের মৃতু্যর পর অজগরে পরিণত হয়। বর্তমানে বগা লেকের পূর্বাবস্থায় এখানে যে গ্রাম ছিল, সে গ্রামের লোকদের অজগর কিভাবে অত্যাচার করত এবং অবশেষে সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে কিভাবে তাকে মারার পর খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো এবং অজগরের অভিশাপে সৃষ্টি হলো বগা লেক।

দুপুরে বগা লেকের পারে কিছুক্ষণ অলস সময় কাটানোর পর ঘুরতে ঘুরতে গেলাম লেকের অপর পাড়ে। সেখানে পাহাড়ের ঢালে একটা ছোট পাহাড়ি গ্রাম খুজে পেলাম। গ্রামে মোট 20-25 টা বাড়ি। এখানে পাহাড়ি অনেক মোটা আর লাল আখের গাছ দেখলাম। একটা চেয়ে নিয়ে আমরা ভাগ করে খেলাম।

রাতে গেলাম স্থানীয় গীর্জাতে। নববর্ষের অনুষ্ঠান এখানে এখনও চলছে। রুমাতে যে গান শুনেছিলাম এখানেও সে ধরনের গান চলছে। একটা শোভাযাত্রার মতো হলো। অনুষ্ঠান শেষে পরিচিত হলাম কয়েকজন পাহাড়ি যুবকের সঙ্গে।

তাদের মধ্যে একজন খুব ভালো গান গায়। হাতে তৈরি একটা গিটারও আছে তার। অবাক হলাম তার মুখে বাংলা গান শুনে। নচিকেতার গান শুনে শুনে শিখেছে বলে জানালো। বাংলা গানে তার উচ্চারণ অবশ্য ঠিকমতো হচ্ছিলো না।

তবে পাহাড়ি গানগুলো খুব ভাল লাগছিল। গাইড সাং লিয়েনের কাছ থেকে অর্থ বুঝে নেবার চেষ্টা করছিলাম। নিস্তব্ধ এলাকা, কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ে গিটার বাজানো গান শোনার অভিজ্ঞতা ছিল অদ্ভূত সুন্দর। রাত বাড়লে পাহাড়িরা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। তখনও আমরা বগা লেকের পাড়ে।

লেকের নিস্তব্ধ পানির পাশে আমরা বাংলা গানের আসর জমাই। রক্তে বয়ে চলেছে পাহাড়ি সুরার অনুভূতি। বন্ধুরা গান ধরে, সঙ্গে আমিও। পাহাড়ের কোনে কোনে জমে ওঠা কুয়াশাগুলোকে মেঘ বলেই মনে হয়। মনের মাঝেও জমে ওঠে কুয়াশার মতো আবেগ।

(ছবি: বগা লেকের ধারে এক কিশোরী)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.