আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধরাছোঁয়ার বাইরে শেয়ার কেলেঙ্কারির খলনায়করা

শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি এক মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসেও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোও হয়নি বাস্তবায়ন। কেলেঙ্কারির হোতাদের ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে অধিক তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা থেমে গেছে মাঝপথে। জড়িত পালের গোদারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ কেউ আবার পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বহাল রয়েছেন।

ফলে সরকার ক্ষমতায় আসার পরের বছর থেকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে তা আরও প্রকট হয়েছে। এখন পুঁজিবাজারে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের হাহাকার শোনা যায়।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর থেকেই পুঁজিবাজারে শেয়ারের দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। দৈনিক লেনদেন একপর্যায়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সূচক বাড়তে বাড়তে ৮ হাজারের উপরে উঠে যায়।

কিন্তু কারসাজির মাধ্যমে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের অতিমূল্যায়ন আর ব্যাংক থেকে সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটতে থাকা পুঁজিবাজার ২০১০ সাল থেকেই পড়তে থাকে। একপর্যায়ে দৈনিক লেনদেন নেমে আসে মাত্র ১৬৫ কোটি টাকায়। ওই পতনের ধারা থেকে এখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। পরিস্থিতি সামলাতে ও পতনের কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ ৬০ দিন অনুসন্ধান শেষে ওই কমিটি দোষীদের চিহ্নিত করে ১৪৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেয় সরকারের কাছে।

প্রতিবেদনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এবং পতনের মূলনায়কদের শাস্তি নিশ্চিত করতে মোট ২৬টি সুপারিশ করা হয়। তবে সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে বলা যাচ্ছে, সুপারিশের অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। যাদের কাছ থেকে পুঁজিবাজারকে দূরে রাখতে বলা হয়েছিল তারাই এখন বাজারের নিয়ন্ত্রক। শুধু তাই নয়, দোষীদের ব্যাপারে অধিক অনুসন্ধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও মাঝপথে এসে রহস্যজনক কারণে থেমে গেছে সংস্থাটির অনুসন্ধান প্রক্রিয়া। কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ বিএসইসি।

ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ নিয়ে বিভিন্ন সময় বেফাঁস মন্তব্য করেছেন। এমনকি খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনটি বিতর্কিত করতে একটি চক্র তার বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দেয়। ফলে শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অনেক বিনিয়োগকারী। বাড়তে থাকা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্দহত্যা পর্যন্ত করেছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শেয়ারবাজারের দুষ্ট চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে বাজারে কখনই আস্থা ফিরে আসবে না।

তার মতে জাতীয় নির্বাচনের আগে বাজারে আশানুরূপ কোনো প্রভাবও পড়বে না। কেননা তার সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের বিশেষ মনোযোগ ছিল না। যা দু-একটি বাস্তবায়ন হয়েছে তাও সময়মতো হয়নি। পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে অর্থমন্ত্রীও দায়িত্বশীল আচরণ করেননি বলে মনে করেন তিনি। ইব্রাহীম খালেদ এও বলেন, ২০১০ সালে যারা বাজার পতনের মূলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হলেও সরকার তা করেনি।

বরং উল্টো তাদের বাজারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে গঠিত খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত কমিটি ওই বছরের মার্চে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। এক মাস পর এপ্রিলে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সরকার। এরপর অধিক অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাইয়ের নামে কেটেছে তিন বছর। এ সময়ে কেবল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডি-মিউচুয়ালাইজেশন ও কিছু ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর ক্ষতিপূরণের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা ছাড়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কারসাজির সঙ্গে জড়িত এসইসির কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হলেও তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুসারে সংস্থাটি শক্তিশালীকরণে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুঁজিবাজারে অধিকতর মনিটরিংয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে শক্তিশালী ইন্সপেকশন ও সার্ভিলেন্স বিভাগ গঠনের সুপারিশ করা হলেও তা হয়নি। কারসাজি বন্ধে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে একটি নিয়মাচার তৈরির সুপারিশ ছিল, তাও বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠনের নামে দুটি পদ বাড়ানো ছাড়া নেওয়া হয়নি আর কোনো উদ্যোগ।

এদিকে সংকট উত্তরণে, বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে ও বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে সরকারি ২৬টি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা ঝুলে আছে বছরের পর বছর।

একের পর এক আলটিমেটাম দিলেও কোনো কোম্পানিই ঘোষণা অনুযায়ী শেয়ার অফলোড করছে না। এমনকি কোম্পানিতে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী, তাতেও কোনো কাজ হয়নি। শেয়ারও অফলোড হয়নি, কেউ গদিও ছাড়েননি। পুঁজিবাজারে গুজবনির্ভরতা কমাতে বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি বিনিয়োগ পরামর্শক নিবন্ধন প্রথা চালুর সুপারিশ ছিল তদন্ত কমিটির, দীর্ঘ তিন বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এখনো গুজবে ভর করে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেক বিনিয়োগকারী।

স্বচ্ছতা ও সুশাসন কায়েম করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যাংকারদের শেয়ার লেনদেন বন্ধ করার জোর সুপারিশ ছিল ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই সুপারিশ বাস্তবায়নেও শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। বরং ২০১২ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারির পর আমলাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে মাত্র ১২ ঘণ্টার মাথায় তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এদিকে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তেও তেমন কোনো গতি নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রায় এক বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে চাঞ্চল্যকর এ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান কাজ শুরু করলেও এখন এটি ফাইলবন্দী হয়ে আছে।

ফলে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে কেলেঙ্কারির হোতারা। পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি তদন্ত নিয়ে ধীরগতিতে এগোনোর জন্য খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই দুদককে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, শেয়ারবাজার নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান কাজ বর্তমানে স্থবির অবস্থায় আছে। আইনি বাধা থাকায় এটি আর এগোবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে কারসাজির মূলনায়কদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত অব্যাহত রাখতে আইনের পরিবর্তন আনতে হবে বলে জানান তিনি।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.