আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধরাছোঁয়ার বাইরে অপরাধীরা

হরতাল-অবরোধে রাজধানীতে যানবাহন ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলাগুলোতে ঢালাওভাবে বিএনপিসহ ১৮ দলের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হচ্ছে। অবাস্তব এজাহারের এসব মামলার যথাযথ তদন্তও হচ্ছে না। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে বেশির ভাগ প্রকৃত অপরাধী ও তাঁদের নির্দেশদাতারা।

গত দুই বছরে অন্তত ২০টি মামলায় এ প্রবণতা দেখা গেছে। কিছু ঘটনায় নাশকতাকারীদের ছবি প্রকাশিত হলেও যথাযথ তদন্ত না হওয়ায় তাঁরাও শনাক্ত হচ্ছেন না।

ফলে অপরাধীদের সাজা পাওয়া নিয়েও সংশয় আছে। এর কারণ হিসেবে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ঘটনায় মামলা দায়ের থেকে শুরু করে তদন্ত, অভিযোগপত্র—সবই হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। পুলিশ আইনি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মাত্র।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, যখনই কোনো মামলায় প্রকৃত আসামিদের বাইরে অন্যদের ধরা হয়, তখনই মামলাটা নষ্ট হয়। প্রকৃত আসামিদের আইনের আওতায় আনা যায় না।

এতে আইনের প্রতি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

এমন মামলার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ও পরিদর্শক (একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) পর্যায়ের চারজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘রাজনৈতিক সহিসংতা’ বলে বিবেচিত কোনো মামলারই যথাযথ তদন্ত হয় না। তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। ঢাকায় ২০ বছরের বেশি কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ পরিদর্শক বলেন, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, এসব মামলায় তাদের মনমতো লোকদের আসামি করা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে এসব মামলা হয় আদালতে খারিজ হয়েছে অথবা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, নাশকতায় হতাহতদের পরিবার মামলা চালাতে আগ্রহী হয় না। ফলে পুলিশও তদন্ত করে সময় নষ্ট করতে চায় না।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে শেরাটন হোটেলের (বর্তমানে রূপসী বাংলা) সামনে বিআরটিসির দোতলা বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে হত্যা করা হলো। ওই ঘটনায় করা মামলায় ইচ্ছামতো লোকদের আসামি করা হয়েছে।

কারা আগুন দিল, কীভাবে দিল, কিছুই তদন্তে বের হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায়’ মামলাটি আংশিক প্রত্যাহার করা হয়।

পুলিশের এই চার কর্মকর্তার দুজন দাবি করেন, বিরোধী দলের নেতারা এসব জ্বালাও-পোড়াওয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা আরও নাশকতা চালাতে নেতা-কর্মীদের বলেছেন বা নাশকতার পর নাশকতাকারীরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন—এমন ফোনকলের রেকর্ড পুলিশের কাছে আছে।

পুলিশের সূত্র জানায়, গত বছর ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নাশকতার অভিযোগে ১২৮টি মামলা হয়েছে।

৪৭টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ৪৩টিতে ভাঙচুর, ৫৩ জন সাধারণ মানুষ ও ২৪১ জন পুলিশ সদস্যকে আহত করার ঘটনায় এসব মামলা হয়। মামলাগুলোতে এজাহারভুক্ত আসামি দুই হাজার ৮০০ জন, অজ্ঞাতনামা আসামি আরও ২৪ হাজার। এসব মামলায় দুই হাজার ৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ‘অবরোধ কর্মসূচির’ দিনে যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ৩৭টি মামলায় হুকুমের আসামি করা হয়। এর ৩৫টি মামলার বাদীই পুলিশ।

তবে ঘটনাগুলো কারা ঘটিয়েছে, তা এখনো জানতে পারেনি পুলিশ।

সম্প্রতি শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা মেরে ১৯ জনকে পোড়ানোর এবং মালিবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলার মামলায়ও ১৮ দলের নেতাদের আসামি করা হয়েছে। মামলা দুটির এজাহারের বিবরণীও প্রায় এক। কিন্তু যে বা যারা পেট্রলবোমা মেরে এই নৃশংসতা ঘটিয়েছে, তাদের কাউকে এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, চলতি বছর হরতাল-অবরোধে নাশকতার অভিযোগে নগরের ৪৯ থানায় সাত শতাধিক মামলা হয়েছে।

এসব মামলার ব্যবস্থাপনা নিয়ে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব মামলায় বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রচলিত তদন্ত প্রক্রিয়ার কিছুই অনুসরণ করা হচ্ছে না। এসব নাশকতার ছবি ও ফুটেজ দেখে মাত্র ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, গত নভেম্বরে বিস্ফোরক আইনে ১১১টি মামলা হয়েছে, যার বেশির ভাগই হয়েছে এসব ঘটনায়।

নভেম্বরে ৮০টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। একই সময়ে ৫৮৫টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং পুলিশ ২৯১টি ককটেল উদ্ধার করে। ২০২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই গ্রেপ্তার হয় ঘটনাস্থল ও পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায়। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে সাজা দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি করা মামলাগুলোতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘটনায় উসকানি দেওয়া, ষড়যন্ত্র ও অর্থায়নের অভিযোগ আনা হচ্ছে।



অবাস্তব এজাহার, দায়সারা অভিযোগপত্র: গত বছরের ২৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অদূরে ফ্যালকন হলের সামনে ৩ নম্বর রুটের একটি মিনিবাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক ইসমাইল মজুমদার ৪৪ জনের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করেন। মামলার ১ ও ২ নম্বর আসামি ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা ওই মিনিবাসের কন্ডাক্টর সোহেল মিয়া ও চালকের সহকারী জসিমউদ্দিন। বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপি, ১৮ দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতা।

এজাহারে বলা হয়, ২৯ এপ্রিল রাত নয়টা পাঁচ মিনিটে উল্লিখিত ৩৬ জন আসামি ছয়-সাতটি মাইক্রোবাসে এসে বাসটির গতিরোধ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালান।

এ সময় তিনি (বাদী) ভাঙচুরকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। ভাঙচুরের ভয়ে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে গেলে একজন আসামি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন। তবে ঘটনার পর ঘটনাস্থলে মিনিবাসটির চালক আবু বকর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উত্তরা থেকে আসার পথে সামনের একটি চাকা পাংচার হলে তিনি বাসটি ওই স্থানে থামান। সহকারী জসিম ও কন্ডাক্টর সোহেলকে নিয়ে তিনি ওই চাকা খুলছিলেন। এ সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত বাসের পেছন দিকে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।

দুর্বৃত্তদের তাঁরা দেখেননি। ঘটনার একই বর্ণনা দেন কয়েকজন যাত্রীও।

এ ঘটনায় ১১ দিনেই তদন্ত শেষ করে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিদের মধ্যে বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দিন খোকন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান ও সাধারণ সম্পাদক মীর শরফত আলী, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আমীরুল ইসলাম, বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধানসহ ১ থেকে ৩৬ নম্বর আসামিরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, ফজলুল হক, কামরুজ্জামানসহ ১ থেকে ৮ নম্বর আসামি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনা, ইন্ধন ও পরিকল্পনায় জড়িত।

তাঁরা মাইক্রোবাসে এসে বাসটির গতিরোধ করেন। এরপর ১ ও ২ নম্বর আসামি সোহেল মিয়া ও জসিম উদ্দিন বাস ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন।

চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের ডাকা হরতালের আগের রাতে উত্তরায় বাসে অগ্নিসংযোগের মামলার এজাহারও এমন অবাস্তব। ওই ঘটনায় বাসযাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা রাসেল মাহমুদ (২৯) পুড়ে মারা যান। আহত হন রাসেলের বাবা সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজন।

এ ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানার উপপরিদর্শক জাকির হোসেন বিএনপির ৮৬ জন ও জামায়াতের আটজন নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করেন।

এজাহারে বলা হয়, টহল উিউটিকালে তিনি দেখেন, আজমপুর ফুটওভারব্রিজের ২০০ গজ উত্তরে জেএম পরিবহনের বাসটিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া করেন অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জন জামায়াত, শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাসী। উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে দেখে তিনি আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখেন আজিজুল বারী, এস এম জাহাঙ্গীর, মো. মিলন, এম কফিলউদ্দীন... (নাম উল্লেখ করা হয় ৯৪ জনের)সহ অজ্ঞাতনামা আরও ২০-২৫ জন বাসটিকে ধাওয়া করে আজমপুর বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ পাশে বটগাছের সামনে নিয়ে এলে চালক বাসটি থামিয়ে দেন। তখন আসামিরা গাড়িতে পেট্রল ঢেলে যাত্রীদের পুড়িয়ে মারার উদ্দেশ্যে আগুন ধরিয়ে দেন। অথচ প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় লোকজন, আহত ব্যক্তি, নিহত রাসেলের বাবা জানিয়েছিলেন, বাসে কে আগুন দিয়েছে, তাঁরা দেখেননি।



এ বিষয়ে ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, এই অপরাধগুলোর ধরন একই রকম। আবার অপরাধ সংঘটনের প্রক্রিয়া ও কারণও প্রায় একই ধরনের। এ কারণেই মামলার ধারাগুলো প্রায় একই ধরনের।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.